চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ফিরে দেখা বাংলা চলচ্চিত্র

জীবন থেকে নেয়া

চেতনার রূপকথা

বিধান রিবেরু

২৭ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৫৬ পূর্বাহ্ণ

‘আজকালকার নিখুঁত সিনেমা, যেগুলো কারিগরি ও শৈল্পিক বিচারে দক্ষতার প্রমাণ দেয়, সেগুলোর প্রায় সবকটাই প্রতিক্রিয়াশীল।’-হুলিয়ো গার্সিয়া এসপিনোজা
কিউবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার হুলিয়ো গার্সিয়া এসপিনোজা নিজের বিখ্যাত ‘খুঁতওলা সিনেমার খোঁজে’ প্রবন্ধে একহাত দেখে নিয়েছেন মার্কিন ও ইউরোপীয় নির্মাতাদের। নিখুঁত ছবি নির্মাণের যে পূর্বধারণা, সেটাকে পুঁজি করে যাঁরা ওই ধরনের কারিগরি ও শৈল্পিক মান সামনে রেখে নিখুঁত ছবি নির্মাণে হাত দেন, তাঁদের এবং মধ্যস্বত্বভোগী সমালোচকদের ভালো ধোলাই দিয়েছেন এসপিনোজা। তাঁর বাহাস হলো আত্মকেন্দ্রিক, বাণিজ্যিক ও তারকা ব্যবস্থানির্ভর সিনেমার বিরুদ্ধে। তিনি শিল্পের ইতিবাচক বিকাশের পক্ষে। এলিট সংস্কৃতির দ্বারা চালিত সিনেমার ধারণা বা পূর্বধারণার উল্টো স্রোতে দাঁড়িয়ে একজন নির্মাতা, একজন শিল্পী বিদ্যমান রুচির যে বৃত্তচাপ, সেটি ভাঙতে কতটা সমর্থ হচ্ছেন, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। স্বাপ্নিক বিপ্লবীর মতো ওই নির্মাতা শুধু শিল্পী হিসেবে নন, মানুষ হিসেবে, সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে, নিজের নির্মাণে কতটুকু হাজির থাকছেন, সেটাই বড় বিষয় এসপিনোজার কাছে।
‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তির পর ১৯৭০ সালের ৮ মে সাপ্তাহিক চিত্রালীতে আহমদ জামান চৌধুরী একটি সমালোচনা লেখেন। চৌধুরী সেখানে বলেন, ‘জহিরের ছবির সম্পাদনার স্বাচ্ছন্দ্য আছে, কিন্তু সামগ্রিক দক্ষতা অনুপস্থিত। ফলত কোন শট কতক্ষণ বিরাজ করবে, সে সম্পর্কে সমীকরণ সর্বদা নেই। শহীদবেদি, মিছিলে গুলি ও কয়েকটি রোমান্টিক দৃশ্য তাই আবেদন ছড়াবার আগেই শেষ হয়ে যায়।’
এসপিনোজার ধোয়া তুলে ও চৌধুরীর সমালোচনাকে পাশে সরিয়ে রেখে বলতে চাই, জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’, ১৯৭০ সালের যে সময় মুক্তি পায়, শুদ্ধ সে সময়কার রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই নয়, নির্মাণের দিক থেকেও নির্মাতার সততা ও মেধার পরিচয় আমরা পাই। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এটাও আন্দাজ করা যায়, জহির রায়হান ঠিকঠাকভাবেই সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত পূর্ববঙ্গবাসীর কথাই তো বলা হয়েছে ‘জীবন থেকে নেয়া’-তে। সে জন্যই ছাড়পত্র পেতে সমস্যা হয়েছিল, এমনকি শুটিংয়ের সময় থেকেই নানাভাবে এই ছবির কাজ বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা করে কর্তৃপক্ষ।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবীর ১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’র ওপর ইংরাজি ভাষায় সমালোচনা লিখেছিলেন, সেখানে ওই ষড়যন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। তার পরও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই, রাজনৈতিকভাবে উত্তাল একসময়ের মধ্যে মুক্তি পায় এই ছবি। যে ছবির নাম অনায়াসে হতে পারত ‘এক গোছা চাবি’। কারণ, পুরো ছবিতে চাবির গোছা দৃশ্যে ও সংলাপে এসেছে মোট ১৫ বার। এর মধ্যে শুধু সংলাপে এসেছে নয়বার। কাজেই বলা যায়, ‘জীবন থেকে নেয়া’র একটি কেন্দ্রীয় জায়গায় রয়েছে চাবির গোছা, ক্ষমতার মেটাফোর হিসেবে। যাঁরা ছবিখানা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, একটি পরিবার, সেখানে বড় বোন একদিকে, তিনি বড় ‘দজ্জাল’। আর বড় বোনের স্বামী, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীরা আরেকদিকে। এরা ‘নির্যাতিত’। রাষ্ট্রের যেমন আয়-ব্যয়ের হিসাব আছে, পরিবারেরও আছে, দুই জায়গাতেই রয়েছে প্রধান ব্যক্তি। সেই ব্যক্তি পরিবারের সদস্যদের ভালো-মন্দ দেখে, সেই বিচারে সংসার পরিচালনা করে। বলতে পারেন, রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র সংস্করণ পরিবার। বুঝতে অসুবিধা হয় না, জহির রায়হান কেন পরিবারের গল্প ফাঁদতে গেলেন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হুমকি, ধমক ও অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদে যখন পূর্ব পাকিস্তান ফুঁসছে, তখন এই ছবিতেই একটি বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে পরিবার। যদিও রাজপথের আন্দোলনও আমরা দেখি এতে।
চলতি প্রবন্ধে জহির রায়হানের ব্যবহৃত মেটাফোর বা রূপকের আলাপ তো হবেই, পাশাপাশি কথা হবে সমালোচকদের সমালোচনা নিয়ে। চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সমালোচক আলমগীর কবীর বলছেন, জহির রায়হানের ছবিতে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের মেটাফোর হিসেবে হাজির হয়েছে দজ্জাল বড় বোন। দুটি সমান্তরাল গল্প এগিয়ে নিয়ে গেছেন জহির এই চলচ্চিত্রে। ঘরের বাইরে দেখা যায়, বড় স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে বিক্ষোভ করছে মানুষ। আর পরিবারের ভেতরে সদস্যরা জোটবদ্ধ হচ্ছে পারিবারিক শাসকের পতন ঘটানোর জন্য। তারা পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে ফেলে ঘরের দেয়াল। পাকিস্তানের সেনাপতি আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নানা কৌশল করতে থাকেন। তার মধ্যে সবচেয়ে হাস্যকর কৌশলটি ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি ‘অভিন্ন ভাষা গঠন’ ও পাকিস্তানের সব ভাষা রোমান হরফে লেখার প্রস্তাব। সমালোচক আলমগীর কবীর বলছেন, আইয়ুব খানের নানা কূটকৌশল চলচ্চিত্রের পরিবারেও দৃশ্যমান। সেখানে ছোট দুই ভাই বিয়ে করে দুই বউ সংসারে আনলে বড় বোনের আধিপত্য ও ক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ে। সেই ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে নানা হাস্যকর পদক্ষেপ নেয় বড় বোন ওরফে রওশন জামিল। দেখা যায়, এক ভাই ও নববিবাহিত স্ত্রীকে আলাদা থাকতে বাধ্য করছে বড় বোন। কিন্তু আরেক ভাইয়ের বিয়ের পর ছোট বউ সংসারে এলে বুদ্ধিতে এঁটে উঠতে পারে না বড় বোন। একপর্যায়ে চাবির গোছা হারাতে হয় তাকে। কিন্তু সেই চাবির গোছা পুনরুদ্ধারে নানা ছক কাটতে থাকে সে। দুই বউ, যারা পরস্পর আপন বোন, সুযোগ বুঝে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দিয়ে একদিন কাজ হাসিল করতে চায় বড় বোন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। কারাগারে যেতে হয় তাকে। দ্বন্দ্বটা ছিল এক শিশুকে নিয়ে, যার নাম মুক্তি। দুই বোনেরই বাচ্চা হয় একই সময়। বড় বোনের বাচ্চা মারা গেলে ছোট বোন নিজের কন্যাশিশুটিকে দান করে বড় বোনকে। কিন্তু বড় বোন সেই সত্য জানে না। সে জানে, অনুজের শিশুটি মারা গেছে। সত্যিকার মা হিসেবে ছোট বোন চায়, শিশুটিকে কাছে কাছে রাখতে। বড় বোনকে কানপড়া দেয় রওশন জামিল। বাচ্চামরা নারীর কাছে শিশু নিরাপদ নয়। আবার ছোট বোনকেও সে শিখিয়ে দেয়, নিজের বাচ্চার হক কেন ছাড়বে সে। ব্যস, শুরু হয়ে যায় দ্বন্দ্ব। মুক্তিকে নিয়ে স্বৈরাচারী বোনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয় ওই দুই বোন ওরফে রোজী ও সুচন্দা। রোজী বড়, সুচন্দা ছোট। রোজী একসময় সত্য জানতে পারে। অন্যদিকে নিজের কৃতকর্মের জন্য সাজা পায় স্বৈরাচারী রওশন জামিল। রোজীর বড় ভাই আনোয়ার হোসেন তখন আন্দোলনের জন্য গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে। পরে ছাড়া পেয়ে তিনি চুমু খান মুক্তির গালে। দারুণ মেটাফোর। পুরো জাতির সংকটকে জহির রায়হান তুলে আনেন একটি পরিবারের ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে। কিন্তু মেটাফোর হিসেবে এমন পরিবারের ব্যবহারকে দুর্বল জায়গা বলে চিহ্নিত করেন আলমগীর কবীর।
কবীর সমালোচনায় আরো বলতে থাকেন, জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে অনেক দুর্বল দৃশ্যের একটি হলো আদালতে স্বৈরাচারী বড় বোনের অপরাধ প্রমাণের দৃশ্যটি। যেখানে বড় বোনের উকিল স্বামী খান আতাউর রহমান প্রমাণ করেন, রোজীর হাত দিয়ে কৌশলে তিনি সুচন্দাকে বিষ পান করাতে চেয়েছিলেন। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার যে পরিকল্পনা, সেটি করেছিল বড় বোন, মুক্তিকে পুঁজি করে। এই পরিকল্পনা যুক্তি, সাক্ষী ও বুদ্ধির জোরে প্রমাণিত হয় আদালত কক্ষে। একেই দুর্বল দৃশ্যগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেছেন আলমগীর কবীর। তিনি বলেন, আদালতে যুক্তি-তর্ক ও ‘প্রমাণাদি’ আরো সুচিন্তিতভাবে হাজির করা উচিত ছিল। শুধু তাই নয়, চলচ্চিত্রে দারিদ্র্যকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন কবীর। কিন্তু আমি তো দেখি, আনোয়ার হোসেনের পরিবারে দারিদ্র্য দেখানো হয়েছে। দুই বোনের বিয়েতে তেমন ধুমধাম চোখে পড়ে না, এমনকি বাড়ির চাকর মধুর সংলাপেও দারিদ্র্য ধরা পড়ে। দুই বোনের সংসার সামলাতে যে মধুর হিমশিম খেতে হয়, সে তো স্পষ্টই রয়েছে জহিরের ছবিতে। তাহলে কবীর কি ভালোভাবে লক্ষ করেননি জহিরের চলচ্চিত্র?
জহির রায়হান বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সচেতনভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লেখালেখিও করেছেন। সেসব কর্মযোগ আমলে নিয়ে আপন বুদ্ধিজীবী (পড়তে পারেন অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল) হিসেবে জহির রায়হান যে বক্তব্য তুলে ধরতে চেয়েছেন ‘জীবন থেকে নেয়া’তে, সেটার কাছে বোধ করি চলচ্চিত্র সম্পাদনার ক্ষেত্রে আহমদ জামান চৌধুরীর যে অভিযোগ ‘সামগ্রিক দক্ষতা অনুপস্থিত’ এবং আলমগীর কবীরের যে ‘দুর্বল’ জায়গা চিহ্নিতকরণ, তা আর ধোপে টেকে না। যে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে ক্ষমতার লোভে উন্মাদ হয়ে উঠেছে সামরিক কর্মকর্তারা, যে সময় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের চরম অবিশ্বাস করছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা, যে সময় চলছে চরম রাজনৈতিক উত্তেজনা, তখন জহির রায়হানের এমন সাহসী চলচ্চিত্র নির্মাণ ও মুক্তি। সমালোচকরা যতই খুঁত ও দুর্বল জায়গা বের করুন না কেন, হুলিয়ো গার্সিয়া এসপিনোজার দোহাই দিয়ে বলতে চাই, তথাকথিত ‘খুঁত’ ও ‘দুর্বল’ জায়গা নিয়েও যদি এমন প্রগতিশীল ও সাহসী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়, তাহলে এমন চলচ্চিত্রই আমার দরকার, আমাদের দরকার, নিখুঁত-নির্ভুল কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল চলচ্চিত্রের কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই। ‘জীবন থেকে নেয়া’ নিজের বক্তব্যের জোরেই টিকে গেছে চার দশকের বেশি সময়। আধুনিক সময়ে যেসব ছবি কারিগরি ও সম্পাদনায় নিখুঁত বলে ধরা হচ্ছে বাংলাদেশে, সেগুলোর মধ্যে কটি ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো অতটা শক্তিশালী রাজনৈতিক বক্তব্য সমৃদ্ধ, এই প্রশ্ন থাকল। শাসকের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচেষ্টাকে ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি মেটাফোরের ব্যবহার বিবেচনায় ‘জীবন থেকে নেয়া’ এখনো অতুলনীয়। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে শাসকগোষ্ঠীকে নিয়ে কটাক্ষ করার যে সাহস জহির রায়হান দেখিয়েছিলেন, তা এখনকার নির্মাতাদের মধ্যে কি দেখা যায়? ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো ‘খুঁত’ ও ‘দুর্বল’ চলচ্চিত্রকে যদি প্রাথমিক আদর্শ বয়ান ধরে কেউ নির্মাণে নামেন, তাহলে সেটি প্রকৃত অর্থে এই ভূখ-ের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী চলচ্চিত্র নির্মাণের পথ নির্দেশ করবে বলে মনে হয়। এই মনে হওয়া ভ্রমও হতে পারে। সে তো সময়ই বলে দেবে। তবে শেষ করার আগে বলতে চাই, যাঁরা ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি দেখেছেন, তাঁদের আবারো ওই ছবির ফ্রিজশটগুলো দেখার অনুরোধ করছি। ফ্রিজশটের কী অসাধারণ প্রয়োগ!

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট