চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নাটকের কথা নির্ভার অপূর্ণতার অন্তর্কথন

সুমন টিংকু

২৫ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

নিস্তব্ধতা ভেঙে একাকিত্ব কখনও কখনও সশব্দে সামনে এসে দাঁড়ায়। এই যে একাকিত্ব, সে কি কোন এক গহনে ডুবে থাকা নিজেরই অপ্রকাশিত ছায়াসঙ্গী নাকি তার প্রতিদ্বন্দ্বী? ‘নির্ভার’ নাটকে যে আগন্তুক চরিত্রটি মঞ্চের আলো আঁধারিতে উপস্থিত হয়, সেই চরিত্রটিতো তেমনই একজন। আগন্তুক চরিত্রটি শিশিরের বিবেকেরই প্রতিরূপ, কিন্তু সাথে সাথে এ ছায়া চরিত্রটিতো শিশিরেরই একাকিত্বের আর্তনাদ, অন্তর্গত বেদনা এবং তার ভিতরের রক্তক্ষরণ। সর্বোপরি, এক অমোঘ এবং অনস্বীকার্য সত্য। শাদা চোখে আগন্তুক চরিত্রটির ব্যাপ্তিকাল এই নাটকে খুব দীর্ঘ নয়, কিন্তু তার ছায়া কি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে পুরো নাটক জুড়ে। আগন্তুক যেন শিশিরের যাপিত-জীবনের অন্তর্কথক। যেখানে শিশির নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায় এবং অভিযোগের তীর আগন্তুকের হাতে তুলে দিয়ে নিজেই বিদ্ধ হতে থাকে। আত্ম-বিশ্লেষণ এবং আত্ম-সমালোচনার ঝর্না জলে স্নান করে নিয়ে এ যেন নিজেকেই শুদ্ধ করে নেয়ার প্রচেষ্টা আর এভাবেই যেন শিশির চরিত্রটি নির্ভার হওয়ার চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে।

‘নির্ভার’, কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়ের ১২ তম প্রযোজনা। শান্তনু বিশ্বাস রচিত এবং নির্দেশিত নাটক। প্রধানত দুটো চরিত্র শিশির এবং শাহিনের দাম্পত্যের টানা-পড়েনকে ঘিরেই নাটকের কাহিনীর পথচলা। কিন্তু, এ যেন আমাদের চারপাশের অগণন চরিত্রের কথোপকথন ।
এই নাটকে শিশির-শাহিনের অসম্পূর্ণতার কান্না অনেকের কান্নার কোরাস হয়ে বাজে, যার অনুরণন দর্শককে একটা ধাক্কা দিয়ে আলোড়িত করে। নিঃসন্তান দম্পতির একাকিত্ব কানের কাছে সব সময় বিষাদের সবটুকু সুর মিশিয়ে অপূর্ণতার গান গেয়ে চলে, যা একঘেয়ে এবং ক্লান্তিকর।তা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার জন্যেই শিশির শাহিনের কোলে তুলে দেয় তুতুলকে। অনেক কিছু না পাওয়ার বেদনাকে ছাপিয়ে তুতুলকে বুকে জড়িয়ে তাকে কাছে পাওয়ার আনন্দের নির্যাসটুকু নিয়ে শাহিনও যেন নির্ভার হয়ে উঠে। জীবনের সুখময় সঙ্গীতের সুরটা শুনতে শুরু করে শাহিন। মাতৃত্বের অভাব

যেন নিমেষেই ভুলে যায়। নিজের সবটুকু দিয়েই শাহিন ভালোবাসে তুতুলকে।
এদিকে, শিশির খেয়াল করে, তুতুল এবং শাহিনের পারস্পরিক বোঝাপড়া এক সুতোয় এসে মিলে যাচ্ছে। এতে সে আতঙ্কিত হয়, কারণ, তুতুল কোন স্থায়ী সমাধান নয় এবং একদিনতো তুতুলকে ছাড়াই শাহিনকে বাঁচতে হবে। তাই, তুতুল এবং শাহিনকে পরস্পর থেকে বিচ্ছেদ করার মত এক কঠিন অথচ সঠিক সিদ্ধান্ত শিশিরকে নিতে হয়। বরং সে হাসপাতাল থেকে একটা সন্তান দত্তক নেয়ার জন্য শাহিনের ইচ্ছেকে জাগ্রত করার চেষ্টা করে। কিন্তু, তাতেও নানা বিপত্তি। হাসাপাতাল থেকে সন্তান নেয়ায় নানা প্রশ্ন এবং জটিলতার মারপ্যাঁচ শাহিন শিশিরকে মনে করিয়ে দেয়, যা শিশিরকে ক্রমশ ক্লান্ত করে। মানুষ কখনোই নিজেকে পরাজিতের ভেলায় ভাসাতে রাজি নয়। অক্ষমতা এবং অসম্পূর্ণতাকে মেনে না নেয়ার একটা শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে থাকাটা মানুষের স্বভাবজাত। ঠিক তেমনই এক চরিত্র শাহিন। যে কিনা ভিতরে ভিতরে পুড়ে চলেছে, কিন্তু তার ধোঁয়ার কু-ুলী গোপন করতে সে আপ্রাণ প্রচেষ্টায় রত। শুধু তাই নয়, বরং সে কারও অনুকম্পা কিংবা অনুগ্রহ মেনে নেয়ার জন্যও প্রস্তুত নয়। তাই সে একটা চাকুিরর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তার জন্য অধ্যাপক স্বামীর প্রতি তার অনুযোগের বুদ্বুদ প্রায়শ উঁকি মারে। অনেক কিছু না পাওয়ার দহনে দগ্ধ শাহিনকে আমরা অস্থিরতার পাঁকে হাঁসফাঁস করতে দেখি। স্বামী শিশিরের উপর তার নিয়ত অভিমান কলহে রূপ নেয়। শাহিনকে এক পর্যায়ে আমরা সংসার ত্যাগ করার দৃশ্যও দেখতে পাই। আর দশজন সাদামাটা নারীর মত করেই নাট্যকার এই চরিত্রটিকে সাজিয়েছেন, কিন্তু খুব সতর্ক এবং সপ্রতিভভাবেই চরিত্রটির ব্যক্তিত্বে নাট্যকার একটা নিজস্বতার প্রলেপ দিয়েছেন। তাইতো, তুতুলকে তাদের ঘরে আনার ব্যাপারে সে প্রথমেই আপত্তি জানায় এবং হাসাপাতাল থেকে বাচ্চা দত্তক নেয়ার প্রসঙ্গ এলে এর নানা দিক বিশ্লেষণ করে নৈতিকতার দায় থেকে শাহিন প্রতিবাদ করে বসে।

শাহিনের চরিত্রে শুভ্রা বিশ্বাস নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। থিয়েটারে তাঁর দীর্ঘদিনের অবিরাম পথচলার পদছাপ ক্রমশ তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার ভাঁড়ার পূর্ণ করে চলেছে, তাঁর চরিত্র রূপায়ণে সাবলীলতাই সেটি বলে দেয়।তবে, শিশিরের সঙ্গে অভিযোগের তীর হানার পর্বগুলোতে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন বলেই মনে হয়েছে। মনের ভিতর দীর্ঘদিনের জমে থাকা বাষ্প হঠাৎ বেরিয়ে পড়লে অনেক সময় মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, কিন্তু শাহিন এবং শিশিরের কথোপকথন দেখে আমাদের বুঝতে বাকী থাকে না, তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায়ই মতানৈক্য হয় এবং তাকে ঘিরে নিয়মিত বিতর্কের ইঙ্গিতও আমরা পাই। তার উপর, তাঁরা যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করছেন তাতে শিশিরের কথায় বা কার্যকলাপে শাহিনের ড়াবৎ ৎবধপঃ করার যুক্তি কতটুকু সেটা অভিনেতা শুভ্রা বিশ্বাস পুনরায় ভেবে দেখবেন বলে আস্থা রাখি।

অপরদিকে শিশিরের চরিত্রে শান্তনু বিশ্বাসের পরিমিত অথচ নান্দনিক অভিনয় চরিত্রটাকে অন্য একটা মাত্রা দেয়ার পাশাপাশি তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করে। এই ধরনের চরিত্র রূপায়ন খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। সাধারণত যেটা দেখা যায়, এই ধরনের চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা হয় অতি অভিনয়ের জালে আটকা পড়েন নতুবা প্রয়োজনীয় অভিনয়ের সীমানা ছুঁতে ব্যর্থ হন। সে বিবেচনায় শান্তনু বিশ্বাস এক চুলও বাড়তি বা কমতির দোষে দুষ্ট নন। একটা দৃশ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, যেখানে শাহিনের সঙ্গে শিশিরের কলহ বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে ঠিক এমন সময় শিশিরের চা পানের তৃষ্ণা জাগে এবং শাহিনও প্রতিদিনকার অভ্যস্ত তায় চা-টা বানিয়ে আনে এবং তারপর মান ভঞ্জন ও কৃতজ্ঞতার মিশেলে শিশিরের চায়ে চুকচুক করে চুমুক দেয়ার অভিনয়টুকু, যার ব্যাপ্তি মাত্র কয়েক সেকেন্ড, অভিনেতা হিসেবে শান্তনু বিশ্বাসের জাত চিনিয়ে দেয়। ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র একটি মুহূর্ত অথচ কি ডিটেইলেই না তিনি কাজটি করেছেন। শুধু এটি নয়, সংলাপ প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে তাঁর কি পরিমিতি বোধ। অনেকে ঁহফবৎ ঃড়হব এ অভিনয়ের অভিযোগ তাঁর দিকে তুলতে পারেন, আমি বলব সে দায়টুকুর ধার ঘেঁষারও তাঁর প্রয়োজন নেই। তাঁর জায়গায় তিনি সঠিক। আমরা শিশিরের বাড়ির ভিতরের (রহঃবৎরড়ৎ) যে ধৎপযরঃবপঃঁৎধষ ফবংরমহ দেখতে পাই, তাতে বাড়িটিতে পুরোনো একটি বনেদী পরিবারের আভাস পাই। সেই বাড়ির একজন শিক্ষিত উত্তরাধিকার শিশির। পরিবারের বনেদীয়ানা এবং শিক্ষার আভিজাত্য দুটোই শিশিরের চরিত্রে বর্তমান, যার রূপায়নে শান্তনু বিশ্বাস সর্বতোভাবে সফল। নাটকের আর একটি চরিত্র আগন্তুকের রূপদানকারী অভিনেতার সংলাপ প্রক্ষেপণ যথার্থ, কিন্তু তাঁর অতিরিক্ত হাত নাড়ানো এবং জায়গা বগল (সড়াবসবহঃ) দৃষ্টর শ্রান্তিতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। হতে পারে, নির্দেশক হয়ত শিশিরের অনর্জ্বালাকে এমনই শ্রান্তিহীন দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু, আলো আঁধারির মধ্যে এমন একটি ভিতরের চরিত্রের অত্যধিক নড়ন-চড়ন ব্যক্তি শিশিরের অবস্থানকে ছাপিয়ে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আগন্তুকের দৃশ্যের আলো আঁধারির আবহ ঠিক জমে ওঠেনি। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আগন্তুক আলো-ছায়ার দেয়াল ভেদ করে তীব্র আলোর কেন্দ্রে এসে দাঁড়াবেন। এছাড়াও, অন্যান্য দৃশ্য যেমন দর্শকের সাথে শিশিরের অথবা দর্শকের সাথে শাহিনের সংলাপ বিনিময়ের দৃশ্যগুলো কিংবা শাহিন বাড়ি ছেড়ে যাবার পর শিশিরের একা একা বসে থাকা এবং পুরো একটি ঘর- কেমন বিরান, কেমন মন খারাপ করা একাকিত্ব, এই বিষয়টাকে আলোর মাধ্যমে দারুণ জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়, যেখানে দর্শকও কখনও শিশির, কখনও শাহিনের অন্তর্কান্নায় নিজেদের চোখ ভেজাবে। কিন্তু, কোথায় যেন আলোর খেলার একটা অপূর্ণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই, আলোক পরিকল্পকের আরও একটু নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি রয়েই গেল। এছাড়াও, বেশ কিছু মুহূর্তে পর্যাপ্ত আলোর অভাব নাটকের দৃশ্যায়ন এবং তার আবেদনকে ক্ষুণœ করেছে বৈকি। কিন্তু, দৃশ্য অনুযায়ী আবহ সঙ্গীতের নির্বাচন যেন এইসব অভাব বোধকে ছাপিয়ে যায়। সঙ্গীত পরিকল্পককে অভিনন্দন। দৃশ্যের দাবী মেনে যথার্থ সঙ্গীত আয়োজন দৃশ্যগুলোকে প্রাণ দিয়েছে। কখনো আবেগে আপ্লুত করেছে, আবার কখনো ব্যথার শ্রাবণে ভাসিয়েছে। এত কথা লেখার পর একটি বিষয় আমাকে ব্যথাতুর করে তুলেছে, শান্তনু বিশ্বাসের মত একজন বহুমাত্রিক প্রতিভাতে আমরা বড় অসময়ে হারিয়ে ফেলেছি। ‘নির্ভার’ নিয়ে লিখতে গিয়ে ব্যথায় ক্রমশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছি।

‘নির্ভার’ নাটকটির মত নৈমিত্তিক বিষয় নিয়ে এমন একটি চমৎকার পা-ুলিপি নির্মাণ নাট্যকার হিসেবে শান্তনু বিশ্বাসের প্রজ্ঞাকে আবারও উন্মোচিত করে এবং সাথে সাথে এটি একটি ভালো প্রযোজনা হিসেবে নাট্যাঙ্গনে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে বলেই আমার ধারণা। ‘নির্ভার’ নাটকটিকে কালপুরুষ নিয়মিত প্রযোজনা হিসেবে সচল রাখবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। কালপুরুষ এর জন্য শুভ কামনা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট