চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

নাওজিশ মাহমুদের বাঙালি : জাতি ও জাতীয়তাবাদ গ্রন্থটির পাঠোত্তর কথা

র্কুরম হোসাইন

২৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদী চেতনাটি প্রতিষ্ঠা পাবার পর প্রতিটি জাতি এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। নিজেদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সমাজনীতি-রাজনীতি-অর্থনীতি জাতীয়তাবাদী চেতনায় সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আত্ম-সচেতন হয়ে ওঠে। আমরা সকলে জানি জাতীয়তাবাদী চেতনাটি তাত্ত্বিক আকারে প্রকাশিত হয়েছে বেশি দিন হয়নি। কিন্তু পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজ লুপ্ত থাকে অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বীজতলায়।
লেখক নাওজিশ মাহমুদ ‘বাঙালি : জাতি ও জাতীয়তাবাদ’ (প্রাচীন যুগ) গ্রন্থটিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতি গড়ে ওঠার পেছনে অতীতের যেসব উপাদান ও উপকরণ নিয়ে গঠিত হয়েছে তা অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন।
এ ক্ষেত্রে যে কটি বিষয় মলাট বন্দী করেছেন তার সার-সংক্ষেপ হলোÑ
১. ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, জাতি গঠনের ক্ষেত্রে যেসব অনুষঙ্গ প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম একটি জাতির সংগ্রাম করার প্রক্রিয়া। এ সংগ্রামের ভিত্তি ভূমি হচ্ছেÑ প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে গড়ে ওঠে উক্ত অঞ্চলের খাদ্য অভ্যাস। যেসব খাবার সহজে পাওয়া যায় সেগুলো খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে উক্ত অঞ্চলের মানুষ। সেখান থেকে গড়ে উঠে জীবন-ধারণের বৈশিষ্ট্য, সমাজ, ভাষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, নেতৃত্ব, রাজ্য ও ধর্ম।
২. পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত নৃ-গোষ্ঠীর নানা প্রক্রিয়ায় সংমিশ্রণের ফলে একটি জাতিগোষ্ঠী আত্ম-শক্তিতে বলীয়ান হয়ে স্বকীয়তায় দাঁড়াবার চেষ্টার মাধ্যমে অনিবার্যভাবে সামষ্টিক চেতনার জন্ম হয়। উক্ত চেতনাটি শাসকের প্রতিষ্ঠিত সুবিধাবাদী ও চিরকাল ক্ষমতায় থেকে যাবার চেতনার বিরুদ্ধে কখনো কখনো অবস্থান নেয়।
৩. বাঙালি জাতি গঠনের অন্যতম উপকরণ ভাষা। তবুও বাঙালির একটি নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস রয়েছে। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বাঙালি জাতি। এ কারণে বাঙালিকে মিশ্র বা শঙ্কর জাতি বলে থাকে। পৃথিবীর অনেক জাতি ক্ষেত্রে তা সমানভাবে প্রযোজ্য।
৪. ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা ভাষা পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষার চর্চার মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার পরিচয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। বাঙালি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা অনন্য ভূমিকা রাখে।
৫. বাঙালি জাতির উত্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া কঠিন। জাতি হিসেবে গণ্য করার জন্য ভাষা একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। যা অন্যান্য জাতির মতো বাঙালি জাতির জন্য ধ্রুবসত্য।
৬. তামা আবিষ্কারের পর নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সে-সূত্রে বাংলায় তামার আধিক্যের কারণে এখানে নগর সভ্যতা বিকাশে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। বাংলার গ্রামীণ সমাজ থেকে নগর সভ্যতার উত্তরণ। পৃথিবীতে নগরের সৃষ্টি উক্ত প্রক্রিয়ায় ঘটেছে।
লেখক নাওজিশ মাহমুদ বাঙালির এসব বিষয়-আশয়গুলোর আদি অবস্থা এবং তার স্বরূপ ব্যাখ্যা করা চেষ্টা করেছেন। ‘বাঙালি : জাতি ও জাতীয়তাবাদ’ (প্রাচীন যুগ) গ্রন্থটি মুখবন্ধসহ মোট ১৫টি বিষয় দিয়ে সাজিয়েছেন। বিষয়গুলো হচ্ছেÑ ক. বাঙালি : জাতি ও জাতীয়তাবাদ, খ. বাঙালির জাতির গঠনে উপকরণ অনুসন্ধান ও প্রতিবন্ধকতা, গ. বাঙালির নৃতাত্ত্বিক, ইতিহাস বৈশিষ্ট্য ও ভাষা, ঘ. প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভূ-তাত্ত্বিক গঠন ও বাঙালি, ঙ. প্রাগৈতিহাসিক যুগ : ভারতবর্ষ ও বাঙালি, চ. প্রাগৈতিহাসিক যুগ : সমাজ, সংস্কৃতি ও বাঙালি, ছ. প্রায়-ঐতিহাসিক/তা¤্র যুগ : সিন্ধু সভ্যতা ও বাঙালি, জ. লৌহ যুগ : আর্য সংস্কৃতি ও গঙ্গ রাজ্য, ঝ. ভারতে মৌর্যদের উত্থান ও পতন এবং বাংলায় এর প্রভাব, ঞ. মৌর্যোত্তর ভারত এবং বাংলা, ট. গুপ্ত সা¤্রাজ্যের যুগে ভারত ও বাংলা, ঠ. গুপ্তোত্তর যুগে হর্ষবর্ধন ও বাংলায় শশাংকের উত্থান, ড. বাঙালি জাতি গঠনে প্রাচীন যুগ এবং ঢ. প্রাচীন যুগ থেকে মধ্য যুগে উত্তরণ। সূচিপত্রে উল্লেখিত বিষয়গুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যুগের পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন লেখক তাঁর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
লেখক মুখবন্ধের শুরুতে বলেছেÑ “এই বই কোন ধারাবাহিক ইতিহাস নয়।” কথাটি সত্য, কিন্তু ধারাবাহিক ইতিহাস না হলেও ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহকে তিনি গভীর পাঠের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রকাশ ও প্রমাণ করার চেষ্টা আছে। তিনি এ গ্রন্থে নিজের বয়ানে বলেনÑ “আমাদের ইতিহাসবিদরা সেন আমল পর্যন্ত প্রাচীন যুগ হিসেবে গণ্য করেছেন। সুলতানি যুগ তথা মুসলিম যুগ থেকে থেকে মধ্যযুগ শুরু করেছেন। আমি মনে করি, শশাঙ্কের মৃত্যু পর বাংলার ইতিহাস তাঁর নিজস্ব ধারা ও স্বকীয়তা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।”
বাংলার অতীত ইতিহাস নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের অনীহা দেখা যায়। তারা সর্বদা আত্ম-পরিচয় সংকটে ভুগে। আত্ম-পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তিও কম নয়। লেখক সেদিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং বাঙালি জাতি উত্থানের পেছন ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসের মোড়ে মোড়ে নানা উপাদান ও উপকরণ মিশ্রণে দ্রবীভূত হয়ে আজকের অবস্থান। এসব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। লেখক সেদিকেও নজর দিয়েছেন।
জাতীয়তাবাদী চেতনা গঠনে লেখক বাঙালির খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ভাষা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা অনুষঙ্গ নিয়ে যথাযথ ও সময়োপযোগী আলোচনা করেছেন। এতে পাঠক সহজে অনেক বিষয় জানতে পারবেন নিঃসন্দেহে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, এ বিষয়টি পাঠককে লেখক নাওজিশ মাহমুদ স্মরণ করিয়ে দিলেন।
লেখক নাওজিশ মাহমুদ ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভারতের দেরাদুনের টান্ডুয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর চেতনা সূর্যের আলোর মতো শাণিত এবং কোন আপোস নেই।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক থেকে বিজয় দিবস পর্যন্ত এ অঞ্চলের মানুষের ঘটনা প্রবাহ সঠিকভাবে পাঠ ও উপলব্ধির ভেতর নিহিত আছে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবার প্রেরণা ও সম্ভাবনা। সহজ ও সরল ভাষায় লেখা বইটি যে কোন পাঠকের আশা করি ভালো লাগবে। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ নভেম্বর, ২০১৯ সালে। প্রচ্ছদ করেছেন রাজিব হাসান, মূল্য : ১৩০ টাকা মাত্র। পরিবেশক : বাতিঘর, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ভবন, জামাল খান রোড, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট