চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তাসের নোঙর

বিবিকা দেব

২৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

দিনের আলোর সমস্ত কোলাহল থেমে গিয়ে নিস্তদ্ধ পৃথিবী। তখনও আকাশ জুড়ে কমলা রঙের আভাস বিরাজমান। হাট থেকে আনাজপাতি কিনে ঘরে ফিরছে ঘরের বড় কর্তা। ছোট ছোট বাচ্চারা পিছু নিয়েছে। বাজার থেকে কিনে আনা বাতাসা কিংবা জিলাপির মিষ্টিগন্ধে মুখে তুলবে এই আশায়। ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে লোভনীয় খাবারের দিকে। সন্ধ্যার ভরা বুকে সূর্যটা এখনো ডুব দেয়নি। দিব্যি ডিমের কুসুম হয়ে আকাশের বুকে ভাসমান। একপাল ভেড়া নিয়ে ফিরছে ক্লান্ত রাখাল। তৃণভর্তি পেটে ভেড়াগুলো হেলে দুলে এগোচ্ছে। গর্ভবতী কয়েকটি ভেড়া পিছনে পড়ে আছে। ¯্রােতের বিপরীতে নৌকা যেমন এগোয়। দিনটাকে গিলে সন্ধ্যাটা সবে আসন পেতে বসেছে।

অতি করুণ একটা সুর কানে ভেসে আসে। এটা কোন কোকিলের মিষ্টি সুর নয়। এক দুঃখিনী মায়ের কান্নারত বিলাপের সুর। সেই কান্না সুর সবার মুখস্থ। বিনায়কের মায়ের বিলাপ। এই বলে কেউ কেউ দীর্ঘ নিঃশ^াস ত্যাগ করে। স্মৃতির ওপারে হাতছানি দেয় বিনায়কের ফিনফিনে ঠোঁটের ছোট্ট গোঁফ আর কোঁকড়া চুলের হাসি।
বিনায়কদের পারিবারিক অবস্থা খুবই স্বচ্ছল ছিল। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে বিনায়ক আদরের। মাঠভরা ধান। চারটে জোড়া বলদ আর পুকুর ভরা রুই, কাতলা, কই, পুঁটিতে অবাধ বিচরণ। সেই পুকুরে বিনায়ক ছোট বড়শী ছিপ ফেলে বসে থাকতো। রুই কাতলা তো দূরে থাক, একটা চুনোপুঁটির দেখা পেত না। বড় ভাই বোনরা এটা নিয়ে রাগাতো। বিনায়ক সাঁতার ভালোবাসে। তাইতো পুকুরে নয়, ঝাঁপিয়ে পড়তো হালদার স্বচ্ছ জলে। দুধ শাদা গায়ের রঙ। হালদার জলে আরো ¯িœদ্ধ দেখাতো। কোঁকড়া মাথায় চুল। পাতলা ছিপছিপে এক হারা লম্বা গড়ন। গ্রামের বড় ছোট সবাই সমীহ করে।

হঠাৎ একদিন বিনায়কদের বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। হালদার বুকে প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় থেকে নেমে আসে ঢল। নদীর জল তখন ঘোলাটে আর বেশী ¯্রােত। তেমনি মানুষের ঢল নেমেছে। মৃত চোর দেখার জন্য।
যে সব আবাদী জমি আছে তাতে মাস কলাই, মসুর, তিল, ধান, সরিষা থেকে শুরু বিভিন্ন সবজির চাষ করে। বিনায়কদের সরিষার ফলন বেশি হয়। মাড়াই থেকে শুরু করে রোদে শুকিয়ে গোলায় তোলার পর্যন্ত অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ধান আর সরিষার গোলা আলাদা। এমনিতে বনেদি পরিবার। তার উপর ছেলের চাহিদা পূরণ করতে চেষ্টা করে। বিনায়ক সম্পূর্ণ আলাদা। ছেলেটা প্রতিদিন সকালে ও বিকালে নদীর পাড়ে নিভৃতে বসে থাকে। ¯্রােতের ঢেউ, মিহি তরঙ্গ উদাস দৃষ্টি সবই নিজের মধ্যে ধারণ করে। পানির নিজস্ব ঘ্রাণ, রঙ যদিও নেই। তবু কল্পনায় নিতে চেষ্টা করে।
গভীর নিসুতি রাতে সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। চোর এসেছে কেউ টের পায়নি। বাড়িতে ঢুকতে না পেরে সরিষার গোলায় ঢুকে পড়ে। সরিষায় পা পিছলে যায় ভেতর দিকে। তাই চোর বোধয় আর বের হতে পারেনি। নাকে মুখে সরিষা ঢুকে ভোরে মৃত্যু হল। শুধু হাত দুটো উপর থেকে দেখা যাচ্ছে। পরের দিন সকাল বেলা পাশে মই দেখে বিনায়কের মায়ের চোখে পড়ে। গিয়ে দেখে চোখ আঁতকে ওঠে। হাক ডাক করতে করতে গ্রামের লোকের ভীড় বেড়ে গেছে। চোরকে এক নজর দেখার জন্য।
লাশ সরিষা থেকে উঠানো হয়। দেখে তো হতবাক। রসু চোর এক নামে খ্যাত। কারো গাছের নারকেল কারো গাছের খেজুর রস সহ কলসি, বাগানের আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস পাওয়া যায় না। তখনি গ্রামের একমাত্র রসু চোরের উপর পড়ে। বেচারা রসু যতই বলুক সে এই চুরি করেনি। কে শুনে কার কথা। কয়েক ঘা পিঠে সহ্য করতে হয়। মা-বাবাহীন রসু অনাদরে অনাহারে ছোট চোর থেকে বড় চোর হয়ে ওঠে। অবশ্যই পরে বিনায়কদের খরচে রসু চোরকে সমাধী করে। এই নিয়ে হাট বাজারে গ্রামের সর্বত্র গুঞ্জন শুরু হয়। কিছু দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। রসু চোরকে নিয়ে এত মাতামাতি তা এক সময় হাওয়াহীন বেলুনের মতো চুপসে যায়। অনেক দিন যাবত বিনায়কের মন ভালো নেই। এমনিতে ভ্রমণ বিলাসী মানুষ। এবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সমুদ্র ভ্রমণে যাবে।

চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে নীল জলের ঢেউ। চোরাবালির ¯্রােত। বিশাল সমুদ্রের দমকা বাতাস। শরীরটাকে শীতলতায় শিউরে ওঠে। বিনায়কের অলিক স্বপ্নের ভেতরজীবন-যাপন। কিন্তু তা হলো নাছোড়বান্ধা মা। কিছুতেই বিনায়ক’কে দুচোখের আড়াল করতে চাই না। যেন চোখের আড়াল হলেই বিপদ এসে হানা দেবে। যতই মায়ের আপত্তি কিন্তু বিনায়কের সাহস আরো দুর্বার।
মা বাবাকে না জানিয়ে যাওয়ার দিন তারিখ ঠিক করেছে। বিনায়ক ঠিক করে রাতে ভাত খাওয়ার পর মাকে বলবে। মা-বাবাকে রাজি করাবে। রাত গভীরে স্বপ্নের ক্যানভাসে অথৈই জলের মাঝখানে জাহাজটা ছোট্ট ডিঙি নৌকার মতো হেলে দুলে যাচ্ছে। বাতাসের সংস্পর্শে জলের রাশি ছিটকে পড়ে জাহাজের পাটাতনে। পেছন দিকে গভীর জলে বুদবুদ ফেনা সৃষ্টি। মেঘের রাজ্য। সবুজ গাছপালা অতিক্রম করবে। কখনো সোনালী মন্দির চোখে পড়বে। পাখিদের ওড়াওড়ি কখনো বন্যপ্রাণির বিচরণ প্রত্যক্ষ করবে। ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে মন।
মা গায়ে হাত দিতেই বিনায়ক ঘুম চোখে উঠে পড়ে। দেখে কপালে ও থুতনিতে ঘাম জমে আছে। মা বলল কিরে এত সকালে তুই ঘামছিস কেন ? বেশী রোমাঞ্চিত হলে বিনায়ক হাত পা কাঁপে। প্রচুর ঘাম হয়। বাবা রাশভারী লোক। বিনায়কের যাওয়ার ব্যাপারে কিছুই বললেন না। নিরুত্তর বাবাকে দেখে মন আরো ভেঙে পড়ল। স্থির যখন করেছি সমুদ্র ভ্রমণে না যাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবো না। একদিন সকাল বেলা বিনায়কের ব্যাগ দেখে মা প্রশ্ন করে। কোথাও যাচ্ছো নাকি ? বিনায়ক মাকে জড়িয়ে বললো হ্যাঁ বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। মা বললো কই আগে বলোনি। মা তেমন কিছু নয়। অনিকের বড় দিদির বিয়ে। তুমি চিন্তা করো না। মাত্র তো দুদিনের ব্যাপার আর বেশী দূরে নয়। এইতো ভাটিয়ারীতে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আচ্ছা মা তোমরা আমায় সমুদ্র দেখতে দিচ্ছ না। তাই বলে পাহাড়ও দেখবো না। আচ্ছা ঠিক আছে আর বলতে হবে না। কিন্তু মা আমার হাতে তেমন টাকা নেই। যদি তুমি কিছু দাও।

আচ্ছা দেখি কি করা যায়। বলে মা বিনায়কের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এক হাজার টাকার একটি চকচকে নোট নিয়ে আসে।
মাকে প্রণাম করে গন্তব্যের উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
বুকের ভেতর অজানা ভয় বিরাজ করে। নিজেকে সান্তনা দেয়। ফিরে গিয়ে চিঠিতে মাকে সব জানিয়ে দেবে। মা হয়তো রাগ করবে প্রথমে। পরে বাবাকে বুঝিয়ে বলবে। বিনায়ক সরকার হাট থেকে বাসে বড়দীঘির পাড় নামে। এরপর লোকাল টেম্পো যোগে ভাটিয়ারী যাবে। দু’পাশে উঁচু নিচু পাহাড়। অসংখ্যা গাছপালা। যেন সবুজে সবুজে কানাকানি। মাঝে মাঝে লাল মাটির বুকে উপরে ওঠার সিঁড়ি। কোথায় গিয়ে থেমেছে অজানা বিস্তৃত পাহাড়ি পথ। সীমাবদ্ধ পাহাড়ের লেক উঁচু-নিচু পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত লেকের স্বচ্ছ নীল জল। এত নীল জল বিনায়ক আগে কখনো দেখিনি। বিমোহিত চোখে যেন সমস্ত নীল একসাথে আহোরণ করবে। যতই দেখে ততই প্রকৃতির মুগ্ধতা।
আসলে বিধাতার সৃষ্টির এতই বিশালতা কল্পনা করা যায় না। সবুজ পাতার ফাঁকে সূর্যটা মুখের উপর খেলা করে। একবার কাছে আসে আবার সরে গিয়ে পাতার ফাঁকে লুকিয়ে পড়ে। রোদের এই লুকোচুরিতে বিনায়ক যেন অবোধ শিশু। ইচ্ছে করে এসব খেলা দেখে দেখে দিন পার করে। স্বচ্ছ নীলাভ আকাশে মেঘেদের একই অবস্থা। উড়ে উড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আবার ফিরে এসে ঠোঁট ফুলিয়ে হাসছে। রোদের প্রশ্রয় পেয়ে গাভাসিয়ে দেয় বাতাসের সঙ্গে। বাতাসও বাধ্য হয়ে বয়ে নিচ্ছে দূর দূরান্তে। গাড়ি ছুটছে নির্বিঘেœ। বিনায়কের মন মেঘেদের সাথে নিজের খেয়ালে উড়ছে। সম্বিত ফিরে বিনায়কের গন্তব্যপথ অতি নিকটে। সারিবদ্ধ জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে বাধ্য ছেলের মতো। শুধু বিশাল দেহটা ঢেউয়ের তালে তালে আপন মনে দুলছে। বিনায়কের পুলকিত মন ঢেউয়ের ছন্দে ছন্দে মিলেমিশে একাকার। দিনের শেষে রাত আসে। রাতের কোলে চড়ে আসে ভোর। এভাবে এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে জাহাজ নোঙর করে। তেমনি বিনায়কের মনে ও নোঙরের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে।

মা বাবাকে মুঠোফোনে জানিয়ে দেয় জাহাজের সান্নিধ্য থাকার কথা। ছোটখাটো একটা হাতের কাজ ও পেয়ে যায়। যাক ভালোই হল। সারা দিন-রাত সমুদ্রের ঢেউয়ের কথা শুনবে। ঢেউয়ের মিতালী আছড়ে পড়ে ভাঙা তীরে। জাহাজের সারেং থেকে শুরু করে বাবুর্চি পর্যন্ত ফুট ফরমাশ খাটে। তবু ভালো অন্তত সমুদ্রের বুকে ভেলা হয়ে ভাসবে। জাহাজের হুইসেল অবিকল শাটল ট্রেনের হুইসেলের মতো লাগে। শুনতে বেশ ভালো লাগে। দুচোখের স্বপ্নগুলো শাটল ট্রেনের মতো ছুটছে। কখন কোন স্টেশনে থামবে জানি না। এভাবে দিন মাস পার হতে থাকে। এদিকে মা-বাবার সাথে ফোনে প্রতিদিন কথা হয়। ফোনে উপারে আঁচলে চোখ মুছে মা। বারবার বাড়ী ফিরে আসার তাড়া দেয়। উদ্ভাসিত আলো আর অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়।

বসন্ত ঋতু শাদা কাশফুলের মতো বুড়ো হতে থাকে। উদ্মাদিনী কালবৈশাখীর আগমন। সমুদ্রের সর্বাঙ্গে কালবৈশাখীর ঢেউয়ের অবাধ্য তেজ। ফুলেফেঁপে টইটম্বুর। দিক বেদিক হয়ে ছুটতে থাকে এক নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। তীব্র বাতাসের ¯্রােত। জাহাজ দুলতে থাকে ঘষামাজা ডিঙি নৌকার মতো। চারদিকে আতংকের চিৎকার। কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঠের তক্তা নিয়ে। পেট ফুড়ে আসছে পানির ¯্রােত। আতংকে চোখের আলোয় আসন্ন বিপদে অন্ধকার আরো ঘনিভূত হতে থাকে।
ভেতরে কেবল প্রাণ শূন্য। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মাথায় কিছুই আসছে না। নির্বিক নিরেট মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বিস্ফোরিত চোখে এসব প্রত্যক্ষ করে বিনায়ক। বিভীষিকাময় অন্ধকার রাতে বাঁচার কোন সম্ভবনা নেই। তবু হাতড়ে খুঁজে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার সম্বল। ততক্ষণে জাহাজ ডুবে উল্টে যায়। বিনায়ক অজানার উদ্দেশ্য বাঁচার তাগিদে সাঁতারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভোরের আলো ফুটে। ঝলমলে আকাশ। উঠোন কোণে চারদিকে হাহাকার। মৃত্যু¯্রােত অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। জাহাজডুবির খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিনায়কের অপেক্ষায় থেকে মায়ের চোখে ছানি পড়ে। বাবা গত হয়েছে অনেক বছর। কেউ পেয়েছে ঠিকানা। কেউবা বিনায়কের মতো না ফেরাতে হাহাকার…

শেয়ার করুন