চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ঝুলে গেছে গতরাতে

আহমেদ মনসুর

১৭ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:০১ পূর্বাহ্ণ

শুকতারা ভবন, বান্ডেল রোড, পাথরঘাটা। পুরোনো দালান। দেয়ালের বাইরের পলেস্তারা খসে পড়েছে, ভেতরটা যদিও বহাল তবিয়তে, তবে দেওয়ালের চুন-রঙ উঠে গেছে সেই অনেককাল আগে। চারতলা ভবনের আটটা বাসার সবগুলোতেই ব্যাচেলররা ভাড়ায় থাকে। বাড়িওয়ালা থাকেন গির্জার দক্ষিণপার্শ্বে আরেকটা বাসা ভাড়া নিয়ে।

শুকতারা ভবনে রাতদিন হাঙামা লেগে থাকে। গান, মাস্তি, হল্লাতে সরগরম। মাঝেমাঝে আশ-পাশের ফ্যামিলি বাসাগুলো হতে বাড়িওয়ালার কাছে অভিযোগ যায়। বাড়িওয়ালা এসে হুমকি দিয়ে যান। “এরকম অভিযোগ শুনে শুনে, বাবারা আমি আর পারবো না। সবাইরে বের করে দিয়ে কিছু কাজকাম করে ফ্যামিলি ভাড়া দিবো; বলে দিলাম।” প্রতিটি ঘরে গিয়ে বাড়িওয়ালা শামীম বক্স গতবাঁধা এই নোটিশটি শুনিয়ে দেন। সকলে তখন নীরব থাকে, যেন তাদের চেয়ে ভদ্রলোক পৃথিবীতে আর নেই। সবার পক্ষ থেকে কেউ একজন এগিয়ে গিয়ে বলেÑ “আঙ্কেল এবারের মতো মাফ করে দেন আমাদের। কথা দিলাম আমরা এরপর এতটাই ভদ্র-সভ্য হয়ে থাকবো আর কেউ আপনার কাছে অভিযোগ নিয়ে যেতে পারবে না।”

“তাই-ই যেন হয়।” খানিকটা রাগত স্বরে বলেন শামীম বক্স।
সে যাত্রায় বেঁচে গিয়ে সকলে আবারও ফেরত যায় পুরোনো চরিত্রে। কয়েক মাত্রা উপরে ওঠে শুরু হয় নাচা-গানা, চিল্লা-ফাল্লা আর মোজ-মাস্তিয়ানা। পাশের ভবনের দৌলত চাকলাদার তখন মনে মনে বলেনÑ “কুকুরের লেজ চুঙাতে যতক্ষণ থাকে, বের হলেই যায় বেঁকে।”
ভবনটিতে যারা থাকে সকলেই চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কেউ কেউ পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেও থেকে যায় আরো ক’বছর। বিয়ে থা করলে আলাদা বাসা নিয়ে চলে যায় অন্যত্র।
৩য় তলার গির্জামুখী বাসাটায় থাকেন তিনজন। ওরা স্কুলফ্রেন্ড। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, পড়াশুনা শেষ করে এখন চাকরিও করে একই কোম্পানীতে। ছাত্রাবস্থায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো জনা-দশেক বন্ধু নিয়ে গ্রুপস্টাডির নামে গভীর রাত অবধি মোজ-মাস্তি করে, আড্ডা মেরে ভোর হতে হতে ঘুমিয়ে পড়তো যে যেখানে জায়গা পেত। যেকোন ছুটির আগের রাতে বসত তাসের আসর। মাঝেমাঝে এর সাথে যোগ হতো ‘অনুপ্যের ফট্টি’ মানে ইকবাল রোডের বিখ্যাত বাংলা মদ কিংবা হাজারী লেইন এর কেরুর বোতল। সায়ন এদের মধ্যে সবচেয়ে রসিক। দুই তিন পেগ গিলেই সে মোটামুটি বোম হয়ে যায়। কথায় পেয়ে গেলে তো আর কথাই নেই। রেকর্ডারের মতো খালি বাজতে থাকে। স্টকের সমস্ত মজাদার, রগরগে গল্পগুলো বলতে থাকে একে একে। মাঝেমাঝে খেই হারিয়ে ফেলে। কোন্ কথা থেকে কোন্ কথায় লাফ দেয় বাঁদরের মতো নিজেই বুঝতে পারে না।

বৃহস্পতিবারের রাত। শুক্রবার অফিস নেই। কাজেই এই রাতটা একান্তই নিজেদের। যেন চাঁদ রাত, মোজ-মাস্তির উজ্জ্বল বার্তা নিয়ে সূর্যটাকে পশ্চিমাকাশে ডুবিয়ে দিয়ে নামে সন্ধ্যা। ছাত্রাবস্থায় বাংলা আর কেরু খেলেও ওরা এখন চাকুরে। কেউ এখনো বিয়ে করেনি বলে হাতে পয়সা থাকলেও খরচের পথ নেই। তাই ওরা এখন একেকবার একেকটা চেকে দেখে। কখনও ভ্যালেন্টাইন, হান্ড্রেড পাইপার, রেড ওয়াইন, হোয়াইট ওয়াইন, পাসপোর্ট, কখনও বা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। এসবের ভালো খবর থাকে রোমেলের কাছে। পর্যটন বারের কোন্ একজনের সাথে ওর ভালো খাতির নাকি।

অফিস হতে ফেরার পথে একটা ভ্যালেন্টাইনের বোতল সাথে করেই নিয়ে এলো রোমেল। সায়ন আর মামুন ঘুরে এসেছে কাঁচাবাজার হয়ে, একটা মুরগি সাথে কোল্ড ড্রিংকস আর চিপসের কয়েকটা প্যাকেট। সায়ন বলেÑ “মুরগিটা ছোট ছোট পিস করে তেলে পোড়া পোড়া করে নিতে হবে। লাল পানির সাথে একটু একটু করে খেতে দারুণ স্বাদ।”
যথারীতি জমে গেলো আসর। মোবাইল ফোনে হালকা মেজাজের গানের ফোল্ডারটি অন করে লাল পানি খাওয়ার সরঞ্জামাদি সাজিয়ে গোল করে বসলো ওরা তিনজন। “থাকতো যদি একজন রূপবতী সাকী কত মজা হতো, মহল একেবারে জমে যেত। জানিস তো শুরা-সাকি-গানা, এ তিন ক্যা লিয়ে নাজরানা” Ñসায়ন বলে। মামুন একটু মুখচোরা স্বভাবের হলেও আসর জমে গেলে চুপ মেরে থাকবে এমন আদমি সে নও। একেবারে রাকঢাকহীন রগরগে বাণীর খই ফোটে তার মুখে। সে বলেÑ “আহা! মিলন হবে কতো দিনে, সেই উর্বসীর সনে। উরুসন্ধির রোমশ কাঠবিড়ালীর সনে।”

“তুই শালা একেবারে ফাসেক। যার জবান এমন সব অশ্লীল বাক্য প্রসব করে অবলীলায়, তার পেছনে ইকতিদা করা সম্পূর্ণ হারাম। কবুল হয় না তার কোন ইবাদতও। গেল জুমার খুতবায় খতিব সাহেবকে এমনটাই বলতে শুনেছি।” বলে রোমেল। “আহ-হা-হা-হা-হা; আপনি যে একেবারে হযরত আফলাতুন ফকির রহমতুল্লাহি আলাইহে। শালা বোতলে বোতলে মদ গিলিস আর করিস কিনা নূরানী-ইরফানী তকরীর? শালা মাতাল কোথাকার!” জড়ানো কণ্ঠে মামুন বলে।
এমন সময় কে যেন দরজার কড়া নাড়ে। তড়িৎ ওরা মদের গ্লাস রেখে দেয় হাত থেকে। কড়া নাড়ার শব্দ পুনরায় শুনতে একযোগে ছয়টি কান খাড়া হয়। এবার একটু জোরেই শব্দ হয়। এতক্ষণে পানি গিলে তাদের সামান্য নেশাটেশা হয়েছিলো। কড়া নাড়ার শব্দে নিমিষেই তা কেটে যায়। বাড়িওয়ালা যদি হয় তো এখনই গ্যাট্টি-গুট্টি গোল করে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এই ভয়ে তিনজনের গলা শুকিয়ে কাঠ। বোতলটা কোনরকম সরিয়ে রেখে মামুন দরজাটা খুলে দিতেই মুহূর্ত বিলম্ব না করে তাদের বয়সী এক তরুণ চট করে ঘরে ঢুকে দরজার খিল আটকে দেয়। আচমকা তিনজনই ভড়কে যায়। এ কোন আপদ আবার!
ছেলেটি মামুনের পা ধরতে চেয়েও কি মনে করে ধরলো না, হাত দুটো ধরেই কেঁদেকেটে একশেষ। সায়ন আর রোমেলও এগিয়ে আসে। “আপনি কে ভাই? এখানে কেন? কি চান?” সায়ন জিগ্যেস করে ছেলেটিকে।
“আগে আমাকে একটু বসতে দিন ভাই। অনেক দূর অবধি দৌড়ে এসে হাঁফিয়ে গেছি। আগে একটু দম নিতে দিন, তারপর খুলে বলছি সমস্তই। আমায় একটু পানি খেতে দিবেন?” এ বলেই ধড়াস করে ফ্লোরে বসে পড়ে ছেলেটি।

“অবশ্যই দেবো।” সায়ন বলে। গ্লাসে ঢালা আছে লাল পানি। এখন তা ফেলে দিয়ে কিংবা গলাধকরণ করে গ্লাসটা ধুয়ে পানি দিতে দিতে দেরি হয়ে যাবে। তাই মালের গ্লাসটাই ছেলেটির দিকে এগিয়ে দেয়। ছেলেটি পানিটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে চোখ-মুখ খানিক্ষণের জন্য বন্ধ করে রাখে। “এ কি খাওয়ালেন ভাই, যেন অমৃত, প্রাণটা ভরে গেল।” বলে ছেলেটি। মামুন তাকায় রোমেলের দিকে, রোমেল মামুন আর সায়নের দিকে। তিনজনই মুচকি হাসে। রোমেল বলেÑ “আপনি এখানে বসুন ভাই। কি নাম আপনার তা তো জানা হলো না।” ছেলেটি জবাব দেয়, “আমার নাম আকিব। এখানে কেন এলেন এত রাতে?” মামুন প্রশ্ন করে।
“আমার প্রেমিকা শ্রাবন্তী। আজ তার বিয়ে। আমাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়ে আমার সমস্তই লুট করে নিলো। অথচ বিয়ে করছে অন্য একজনকে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারিনি। বোতলে পেট্রোল ভরে ছিপি ফুটো করে একটা ফিতা ঢুকিয়ে এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে দেশলাই, দাঁড়িয়ে ছিলাম রাস্তার ধারে যেখান দিয়ে শ্রাবন্তীর হবু বর আসবে ওদের বাড়িতে। কাছাকাছি আসতেই ফিতায় আগুন দিয়ে ছুঁড়ে মারি ফুলে সজ্জিত গাড়িতে। একটা শব্দ হলো, মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে গেলো পুরো গাড়িতে। মনে হয় শ্রাবন্তীর বর-সহ গাড়িতে আরো যারা ছিলো সকলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। বিশ্বাস করুন শ্রাবন্তীকে আমি এখনো ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই ওর কোন ক্ষতি করার কথা ভাবতে পারিনি। তাছাড়া ওর হবু বরের উপর আক্রমণটাও করেছি একেবারে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। আগেই বলেছি আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি এতটুকু।” কথাগুলো দম না ফেলেই বলে গেল আকিব। সায়ন বলেÑ “তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনি এখানে এলেন কি করতে?”
“শুনুন তাহলে, বলছি সমস্তই।” একটা ঢোক গিলে কাপড় চোপড় গোছগাছ করে নিয়ে বয়ানের আসনে আসীন হলো আকিব। বয়ান শুরু হয় তারপর, “আমি যখন জলন্ত পেট্রোলের বোতলটি ছুঁড়ে মারছিলাম তখন এর অদূরেই দু’জন টহল পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি খেয়াল করিনি। আগুন জ্বলে উঠতেই তারা আমাকে তাড়া দিতে শুরু করে। তাড়া খেয়ে আমি হতবিহ্বলের মতো আগপিছ না ভেবে যেদিকে পথ দেখেছি দৌড়াতে আরম্ভ করেছি। আপনাদের এই বিল্ডিং এর নিচ পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়ালাম। কাতল মাছের মতো কয়েকবার খাবি খেয়ে পিছনে তাকিয়ে পুলিশের টিকিটিও দেখতে পেলাম না। ঘুষের টাকায় মাছ-মাংস গিলে ওদের থলথলে ভুঁড়ি মেদ-চর্বিতে একেবারে টুলুটুলু, দৌড়াবে কি করে বলুন!” বলতে বলতে আকিবের চোখে ভর করলো নিদ্রা দেবী। হাই তুলতে তুলতে আকিব বলেÑ “ভাই আমাকে একটু ঘুমোনোর জায়গা দিতে পারেন? শ্রাবন্তীর চিন্তায় টানা কয়েকদিন না ঘুমিয়ে আর পুলিশের তাড়া খেয়ে আমি ভীষণ টায়ার্ড।”

বাসাটা তিন রুমের। আকিবকে মামুনের রুমে শুতে দিয়ে ওরা গিয়ে বসে সায়নের রুমে। বিছানা পিঠ স্পর্শ করতেই আকিবের ক্লান্ত শরীরের শ্রান্ত চোখে নিমিষেই ঘুম নেমে আসলেও নিদ্রাদেবী পালিয়ে গেছে সায়ন-মামুন-রোমেলের চোখ হতে। ওদের পানসল্লা চলতে থাকে। বিষয়বস্তু আকিব। “ছেলেটি যা বলছে তা যদি সত্যি না হয়, যদি কোন কুমতলব নিয়ে এখানে এসে থাকে তাহলে কি হবে?” বাকি দু’জনকে প্রশ্ন করে রোমেল। মামুন বলেÑ “তা তো ভেবে দেখিনি। সেটা তো হতে পারে। আচ্ছা ধর, ছেলেটি কুমতলব নিয়েই এখানে এল, এখন তোরা বলতো দেখি তার কুমতলবটা কেমনতর হতে পারে?” সায়ন জানতে চায়। মামুন বলেÑ “আমার মনে হচ্ছে আমরা ঘুমিয়ে গেলে ছেলেটি বাসার সমস্ত কিছু বগলদাবা করে পগারপার হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের এখন ঘুমিয়ে গেলে চলবে না।”
“তা হতে পারে, অন্যকিছুও তো হতে পারে” Ñবলল সায়ন। রোমেল বলেÑ “যেমন?” সায়ন বলেÑ “সে এতক্ষণ যা বলল তা যদি সত্যি হয় এখন সে মানসিকভাবে বিগড়ে আছে। রাত গভীর হলে ওঠে বসবে প্রথম। মোবাইল ফোনটা অন করে তার বাবার নম্বরে একটা এসএমএস পাঠাবে। বাবা আমার জন্য কোন চিন্তা করো না। আমি আমার বন্ধুদের বাসায় আছি। শুকতারা ভবন, ৩য় তলা, বান্ডেল রোড, পাথরঘাটা। তারপর বোতলের অবশিষ্ট লাল পানিটুকু ঢকঢক করে গিলে ফেলবে। কাপড় শুকোতে যে দড়িটা ঘরের ভেতরে টাঙানো, ওই দড়িটা সে আস্তে খুলে নেবে। ফ্যানের সাথে একমাথা বেঁধে অন্য মাথা পেঁচিয়ে নেবে গলায়। এই যে টুলটা দেখছিস খাটের উপর এটা রেখে তার উপর সে দাঁড়াবে। গলার সাথে ভালো মতন দড়িটা পেঁচানো হয়ে গেলে টুলটা এক পা আলগা করে অন্য পা দিয়ে টেলে দেবে। তারপর আলগোছে ঝুলে যাবে সিলিং এর সাথে। পাখির ডাকে ভোর হলে প্রথমে মামুন চোখ খুলবি। আমাদের না ডেকেই তুই যাবি ওই রুমে। গিয়ে আর ফিরে আসবি না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবি ওখানেই। তারপর রোমেল আর আমার ঘুম ভাঙবে দরজায় কড়া নাড়ায় শব্দে। দরজা খুলে দেখবো একজন মাঝবয়েসী ভদ্রলোককে। তিনি বলবেন, আমি আকিবের বাবা, আকিব এখানে আছে লিখে এসএমএস করেছিলো গত রাতে। পুরোটা দিন বাসায় ছিলো না ও, এসএমএস পেয়ে সাথে সাথে কল দিয়েও মোবাইল বন্ধ পাই। টেনশানে পুরোটা রাত ঘুমাতে পারিনি আমি আর ওর মা। তাই ভোর না হতেই তোমাদেরকে ডিসটার্ব করতে চলে এলাম। কিছু মনে করো না তোমরা। এরপর আকিবের বাবাকে সাথে নিয়ে মামুনের রুমে যেতেই আমাদের চোখগুলো উঠে যাবে কপালে।”

এসব শুনে মামুন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। বায়ুচড়া রোগীর মত মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। রোমেল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সায়নকে বলেÑ “ছেড়ে দে বন্ধু। জিন্দা অলীর মতন আগে আগে সমস্ত ভেবে লাভ নেই। নিয়তির উপর ছেড়ে দে। যা হবার হবে, নে চল এবার ঘুমিয়ে পড়ি।”
ঠিকই কাক ডাকা ভোরে তাদের ঘুম ভাঙে, তাও দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। দরজা খুলে অবশ্য আকিবের বাবাকে নয়, ওরা দেখতে পেল কাজের বুয়া রহিমা খালাকে। সায়ন দরজা খুলে দিতে দিতে মামুন দৌড়ে ওর রুমে চলে যায়। আকিব তখনও মোষের মতো অঘোর ঘুমে অচেতন। রোমেল চোখ মুছতে মুছতে বাথরুমে ঢুকে। ঢুকেই গাইতে থাকে সিরাজ মাস্টারের গানÑ ‘পুরুষ নির্যাতনর আইন সরকারত্তুন চাই, আঁরা পুরুষ নির্যাতনর আইন সরকারত্তুন চাই।’ সাতসকালেই যে তাকে গানে পেয়ে বসেছে তা অবশ্য নয়, বাথরুমের ছিটকিনি নেই বলেই এই ব্যবস্থা।

মামুন গত রাতে মারাত্মক ভয় পেয়েছিলো। অবশ্য আকিবকে গভীর ঘুমে কঁ-করত কঁ-করত শব্দে নাক ডাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। আহা! প্রাণে বাঁচা গেল। শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে দু’হাতে মুখ মুছে পুনরায় শুয়ে পড়ে সে। সায়ন দরজাটা খুলে দিয়েই শুয়ে পড়েছিলো। রোমেল বাথরুম থেকে বেরিয়ে খালাকে চা বানাতে বলে পরটা আনতে বের হয়ে গেলো। রহিমা খালা চা রেডি করে অন্য কাজে মন দেয়। রোমেল ফিরে এসে সবাইকে ডেকে তুলে। সবাই একসাথে জেগে গেলে শোরগোল শুরু হয়। বাথরুমে কার আগে কে ঢুকবে এই নিয়ে গন্ডগোল। রোমেল চিৎকার করে দু’জনকেই গালি দেয়। “তোরা কি বাচ্চা পোলাপান না কিরে শালা, একজন একজন করে গেলেই তো হয়। এর জন্য গ-গোল করা লাগে?” বুয়া রান্নাঘরে মুচকি হাসে। “তুই শালা একদম চুপ, আগে সেরে নিয়ে এখন বাহাদুর। দু’জনকে একসাথে ডাকলি কেন হারামজাদা?” গালি দেয় সায়ন। ততক্ষণে মামুন ছোটঘরে ঢুকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে আরম্ভ করে- “আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে…”
এদের হল্লায় আকিবের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে ইতিউতি তাকায়। মামুনের চোখ বরাবরই আকিবের দিকে নিবদ্ধ ছিলো। তাকে জাগতে দেখে তাই সে ডাক দেয়, আরে আকিব সাহেব আসেন আসেন, এদিকে আসেন। হাত মুখ ধুয়ে নেন, একসাথে নাস্তা খাবো বলে আমরা অপেক্ষা করছি। চা-পরটা সাজিয়ে তিনজনই গোল করে ফ্লোরে পেপারের উপর বসে। ততক্ষণে আকিব প্রাতকার্য সেরে ওদের সাথে যোগ দেয়। “শ্রাবন্তীর ছবি দেখান ভাই এবার।” চায়ের কাপে পরটা ভিজিয়ে মুখে দিতে দিতে বলে সায়ন। পকেট থেকে মোবাইল বের করে গেল বসন্তে ডিসি পার্কে তোলা শ্রাবন্তীর হাসি মুখের ছবিটা ওদের দিকে তুলে ধরে আকিব। ছবি দেখে তিনজোড়া চোখ মুহূর্তেই স্থির। সবার চক্ষুচড়কগাছ। তড়ক করে আকিবের হাত থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নিয়ে এর পর্দায় গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সায়ন। মুখটা চেনাচেনা। ভালো করে পরখ করতেই সে এমনটা করল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না ওর। বাকি দু’জনও খাওয়া রেখে দিয়ে মোবাইল নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। “ভালো করে তাকিয়ে দেখ্ তো, ওই মেয়েটিই না, রাকিবের সাথে ডেট করতে আমাদের বাসায় এসেছিলো গতমাসে?” রোমেল আর মামুনকে প্রশ্ন করে সায়ন। রোমেল আর মামুন চকিতেই সম্ববিৎ ফিরে পায় আর মুহূর্তেই সায় দিয়ে একযোগে বলেÑ “তাই তো দেখছিরে।” আকিবের মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সায়নের দিকে। সায়ন বলেÑ “রাকিব আমাদের বন্ধু। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিবিএ, এমবিএ শেষে এখন প্যাসিফিক জিন্সে চাকরি করে। এই মেয়েটির সাথে তার চার বছরের প্রেম। বিয়ে করবে বলেছিলো, গত মাসে এই বাসায় ডেট করেছিলো দু’জনে। ওর আবদার রাখতে গিয়ে ওরা দু’জনকে বাসাটা ছেড়ে দিয়ে রাতটা আমাদেরকে হোটেলেই কাটাতে হয়েছিলো।”

“রাকিব তো সেদিন মেয়েটির নাম শ্রাবন্তী বলেনি। অন্য কি একটা নাম…, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, বন্যা, বন্যা বলেছিলো।” উচ্ছ্বাসের সাথে বলে ওঠে রোমেল। এক্সাক্টলি, “বন্যাই বলেছিলো।” সায়ন বলে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলে আলোচনা থেমে যায়। দরজা খুলতেই মামুনের চোখে-মুখে দারুণ উচ্ছ্বাস। মামুন বলেÑ “আরে রাকিব তুই? এতক্ষণ তোর কথাই তো আমরা বলছিলাম। আয় আয় ভিতরে আয়।” আকিব রাকিবের দিকে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে রাকিব ভাই কেমন আছেন?” রাকিবের চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন, তাকিয়ে আছে সায়নের দিকে। সায়ন বুঝতে পেরে সাথে সাথেই কথা বলেÑ “আগে তুই এখানটায় বোস, তারপর বলছি সব। আকিবের দিকে ইঙ্গিত করে সে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘উনি আকিব। বন্যা উনার সাথেও ফ্লার্ট করেছে।” রাকিব বলেÑ “ও মাই গড, কি বলিস!”
“হ্যাঁ, তুই নিশ্চয় কাল রাতের ঘটনাটা শুনেছিস। আকিব সাহেবই ঘটিয়েছেন সমস্ত। উনি অবশ্য বন্যাকে শ্রাবন্তী নামেই জানেন।” বিলম্ব না করেই রাকিব সায়নের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেÑ “ওহ্! তাই নাকি? আর একটা খবর তোরা শুনিসনি বোধ হয়। বন্যা গত রাতেই ঝুলে গেছে।”

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট