চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিঃসঙ্গতার উদ্ভাসন সেলিনা শেলীর কবিতা

শোয়েব নাঈম

১৭ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:০০ পূর্বাহ্ণ

মানুষ নিঃসঙ্গতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে শূন্য হয়ে যায়, আর সচেতন বোধের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশকারীরা শূন্যতা আর একাকীত্ব থেকেই উদ্ভাসিত করেন কাব্যময়তা। কবি সেলিনা শেলী লিবিডোকে আড়ালে রেখে ‘সঙ্গীহীন’, ভালোবাসাহীন’, ‘সহানুভূতিহীন’, ‘নির্ভরতাহীন’ শব্দের ট্রান্সফরমেশনে মাল্টিডাইম্যানশনাল পাজেল তৈরি করেছেন নিঃসঙ্গতার প্ল্যাটফর্ম ‘তাচ্ছিল্যকুসুম’ কাব্যগ্রন্থে। চিনির মতো সুমিষ্ট না, কিন্তু গ্রন্থটিতে আছে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া নোনাজলের প্রবহমানতাÑ অনেকটা নারীর নিজস্ব অস্তিত্ব বিষয়ক যাবতীয় স্বপ্ন-কল্পনা-যন্ত্রণা-গ্লানিধর্মী পাজেল। স্তবকের ধাঁধাগুলিকে উম্মুক্ত করলে বিপরীতে আছে নিষ্পাপ ভালোবাসার প্রতি আত্মসমর্পণ। তাঁর কবিতার বুকে কান পাতলে শোনা যায় চাপা দীর্ঘশ্বাস, গভীর ক্ষোভের শোভনীয় গর্জন :
“[…]তুমি তো মানুষ নও!
Ñমানুষের মতো।
তোমার জটিলজালে,
বিভ্রান্তচিন্তনে,
নিষ্ঠুরতায়,
তোমার সন্দেহ আর ঘুমহীন একটানা অস্থির অন্ধকারেÑ
তুমি একা ! আমিও।
একা-সঙ্গীহীন
একা-ভালোবাসাহীন
একা-সহানুভূতিহীন
নির্ভরতাহীন- অসহায়…”
(গোপন গল্পগুলো / পৃষ্ঠা ১৩)।
যতœ ও হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে আর মুখে সদাহাস্য ভঙ্গিটা ধরে রেখে নির্মাণ করেছেন তাঁর যাপিত-জীবনের ‘তাচ্ছিল্যকুসুম’। যেখানে তিনি গ্রন্থিত করেছেন খুব সহজভাবে খুব গভীর কথাবলার শক্তি। এর শব্দগুলিকে আভিধানিক অর্থের বাহিরে গিয়ে অনুভূতিপ্রবণে তর্জমা করলে নিজস্ব স্বর-বৈচিত্র্যের অনুরণনে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেন জীবনের একাকীত্বের পরিধি এবং প্রখরতা। “একদিন একাকীত্বগুলো জড়ো করে দেখি তার ভেতর একটি নিউরনের মতোন ঘুমিয়ে পড়েছি আমি….” – এমন আত্মকথাধর্মী প্রকোপে জ্যোতির মতো বয়ানও আছে বইয়ের উৎসর্গপত্রে।
কত সহজ সংকেতময় উচ্চারণে কবি বেদনার ভারাক্রান্তে অন্যএক উজ্জ্বল স্মৃতিতে ধ্যানস্থ হয়ে, উদ্দীপ্ত স্মৃতিবাহিত জীবনের বিপরীতার্থক শব্দে ‘দুটি নুয়ে পড়া ক্লান্ত পায়ে’ একাকীত্বে দাঁড়িয়ে, বন্ধুত্বের অভিজ্ঞানে নিরপেক্ষ বইয়ের শাদা পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন ‘তাচ্ছিল্যকুসুম’ বর্ণমালা:
“ব্রিজঘাটার জলের দিকে তাকিয়ে তুমি বলেছিলে
মৃত্যু এক অনন্ত নদীর নাম….”
( ব্রিজঘাটা/ পৃষ্ঠা: ০৯ ) ।
সময়ের বারকোডে এই যে ‘এক’ না থাকা, ‘অদ্বিতীয়’ খুঁজে না পাওয়া, সময়ের শিরা ও ধমনিতেই যে সৃষ্টিশীলতা, এ-ই তাঁর সময়ের সদবিম্বে বলেছেন:
“[…] নিঃসঙ্গ বলি কেন
তুমি চললেইতো আমার গতি….
আদিগন্ত ব্যাপে তোমাকেই কেন্দ্র করে
ডানে বাঁয়ে ডানে বাঁয়ে…”
( পে-ুলাম/পৃষ্ঠা:১১)।
কথাগুলি সময়ের ভিতর দিয়ে ঘন শব্দবাহী একটা তীর ছুঁড়ে দিয়েছেন বহুদূরের অজ্ঞাত জনের দিকে। সময়ের এই হাঁক যেতে যেতে কবিতার অনুভবচিত্রের বয়ানে পাঠকেও গভীরভাবে স্পর্শ করান কবি :
“ অনিঃশেষ প্রত্যাখান তোমার
তাচ্ছিল্যকুসুমে ফোটাও আমাকে
কলিজা চিবিয়ে খাও, বিভ্রমে খুলে দাও
আত্মার সুরভি…”
(তাচ্ছিল্যকুসুম/ পৃষ্ঠা: ১২)
কবিতার শিল্পকলায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ৩৯টি কবিতার কন্টেন্ট শিরোনামে নেটওয়ার্কহীন নিঃসঙ্গ বেদনাধর্মী ক্ষতচিহ্নের ফোবিয়া থাকলেও নামকরণের মূলসুরে আছে বিরহের ইশারায় স্মৃতিময় প্রেম। তাচ্ছিল্য ও কুসুম যৌথ সন্ধিতে ‘তাচ্ছিল্যকুসুম’ অভিধেয় হলেও দুটি সত্তা আলাদা আলাদা ভিন্ন অবয়বে শব্দ দিয়ে আঁকা অনিঃশেষ ছবি। তাচ্ছিল্য উপেক্ষাপূর্ণ মানবিকবোধের একটি চরিত্র হয়ে, ভাষালঙ্কারে কুসুম (ফুল) দিয়ে সাজানো কালো অক্ষরের চিত্ররূপময় শব্দবন্ধটি ‘ফুলের মতো আলো হয়ে’ নামকরণটি অভিধানের সমমর্যাদায় গভীর অর্থবহ সৃষ্টি করেছে এই কাব্যগ্রন্থে। কব্যগ্রন্থের এমন নামকরণ কবির মনস্তত্ত্বঘটিত।
কাব্যস্তবকগুলিতে কমা ও ড্যাশের বেঁধে দেওয়া গতিতে আছে কবির অবসাদের ক্লান্তি। সমগ্রগ্রন্থে দুইটি মৌলিক বিষয় কবিতার টেক্সটে উম্মোচিত করছেন কবি সেলিনা শেলী। একÑ অতীতকে ভুলে না গিয়ে স্মরণযোগ্য রাখার প্রচেষ্টা; দুইÑ প্রবাহিত জীবনকে অবসাদ থেকে মুক্তি দেওয়ার উদ্যমতা।
অতীতকে পুনরাবৃত্ত করা কবিতাগুলি:
ব্রিজঘাটা/পৃষ্ঠা: ৯ ; কৃষ্ঞপক্ষ/পৃষ্ঠা: ১০; ভিড় থেকে একা /পৃষ্ঠা:১৫ ; সমূহ সত্য নয় / পৃষ্ঠা:১৬; স্মৃতি/পৃষ্ঠা:১৯…. ইত্যাদি স্মৃতিভারাতুর কবিতায় আছে নস্টালজিয়ার পরাক্রান্ত।
অবসাদগ্রস্ত কবিতাগুলি: পে-ুলাম/পৃষ্ঠা:১১; তাচ্ছিল্যকুসুম/পৃষ্ঠা:১২; গোপন গল্পগুলো/পৃষ্ঠা ১৩; ধুলোঝাড়া সকালগুলো/পৃষ্টা:১৪ ; ক্ষয়া আলোয়/ পৃষ্ঠা:১৭; চশমা/পৃষ্ঠা: ১৮… ইত্যাদি কবিতায় আছে জীবনের সঙ্গে অবসাদের দ্বন্দ্ব।
অন্তর্নিহিত মহত্ত্ব দিয়ে এমন বিভাজনগুলি কাব্যস্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এই দুই বিভাজনের কবিতাগুলি সমসাময়িককালের উপকরণে সৃষ্টি করেছেন।
কোনো কল্পনাআশ্রিত উপকরণে উদ্ভাবন না করে জীবনঘনিষ্ঠ প্রকরণে মেধায় ও মননে সমগ্র কবিতাগুলিকে বিস্তৃত করেছেন।
“তোমাকে দেখে আজ ফণিমনসার কথা মনে পড়ে গেলো
আলপিন ঠাঁসা কা-ে ও পাতায়
অবশ্য আলপিন কেবল খোঁচা দেয়, রক্ত ঝরায়Ñ
কথাটা ঠিক নয়Ñ
বিযুক্তকে যুক্ত করাও তার কাজ।
তবে যুক্তকরণে ছিদ্র প্রক্রিয়ায় বেদনা আলপিন বোঝে না !…”
(বধোকা- / পৃষ্ঠা: ৪৬) ।
এই বর্ণনাভঙ্গিতে সম্পূর্ণভাবে একাত্ম হয়ে আছে জীবনঘনিষ্ঠ সব প্রকরণ, এসব শব্দের অর্থ অভিধানের সীমানাকে ছাড়িয়ে গেছে। কবিতার কাঠামোকে যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত না করে চিত্রকল্পের ওপর নির্ভার করে সমস্ত চিত্রকল্প দিয়ে কবির মেট্রোনাগরিক যাপিত-অভিজ্ঞতাকে কাব্যে আলোকপাত করেছেন। বাহিরে যাহা কিছু ঘটেছে তাকে ধারণ না করে কবির অন্তর্জগতে যে রূপান্তর ঘটিয়েছে, সেই বর্ধনশক্তিকেই কবি সৃজিত লব্ধ-অভিজ্ঞতা বলেছেন এবং এসব ব্যুৎপত্তিগুলি ‘তাচ্ছিল্যকুসুম’-এ নতুনত্বের সৌকর্য বৃদ্ধি করেছে এই গ্রন্থে।

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট