চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

চাটগাঁইয়া গানে নবযুগের ¯্রষ্টা আবদুল গফুর হালী

নাসির উদ্দিন হায়দার

৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:১০ পূর্বাহ্ণ

আজ তিনি নেই মাইজভা-ারের গানের জলসায়, নেই বেতার-বহিরাঙ্গনে। শিশির ভেজা সকালে বাড়ির দাওয়ায় শোনা যায় না তার দরাজ কণ্ঠ। কিন্তু তিনি আছেন এই চট্টগ্রামের মাটি-জল-হাওয়ায়, আছেন মাঝির সাম্পান বাওয়ায়, কর্ণফুলী-শঙ্খের ¯্রােতধারায়। অঘ্রাণের ভরা ক্ষেতে চাষির কণ্ঠে, শঙ্খের বাঁকা জলে মাঝির কণ্ঠে শোনা যায় তার গান-
‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবল্লাই
তোঁয়ারে ছাড়া হাইল্যা ঘরত কেনে থাইক্কম আঁই।’
এখনো নিশিতে বিরহী নারীর বিলাপ হয়ে বাজে-‘ও শ্যাম রেঙ্গুম নঅ যাইওরে/হনে হাইব রেঙ্গুমর কামাই রে।’
কথা আর সুরের এই জাদুকরের নাম আবদুল গফুর হালী-তিনি চাটগাঁইয়া গানের অন্যতম প্রধান রূপকার। বস্তুত, গফুর হালী হলেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক, মাইজভা-ারী গানে নবযুগের ¯্রষ্টা। তিনি ‘চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র সংগীতধারা ‘মোহছেন আউলিয়ার গানের’ জনক এবং চট্টগ্রামের ভাষায় লেখা আঞ্চলিক নাটকের পথিকৃৎ রচয়িতা।
এখনো নাগরিক মনকে উদাস করে গফুর হালীর সেই গান,
‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে
রসিক ভ্রমর আইল না
ফুলের মধু খাইল না।’
এখনো সব মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায় শেফালী গোষের গাওয়া গফুর হালী রচিত সেই চিরসবুজ গান :
‘রিকশা চালাও রসিক বন্ধুরে
সামনর রাস্তা দিয়া
মুই অভাগী চাইয়া থাকি
জানালা মেলিয়া রে…।’
২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর চাটগাঁইয়া সংগীতের বরপুত্র আবদুল গফুর হালী চিরবিদায় নিয়েছেন। আবদুল গফুর হালী বলতেন, তিনি গাইতে গাইতে গায়েন, তার যা কিছু সৃষ্টি-গান, তা সবই মাইজভা-ারের দান। সেই মাইজভা-ারী ও মরমী গানে আবদুল গফুর হালী গড়েছেন ‘অলৌকিক ভালোবাসার এক অপরূপ শিল্প’। কল্যাণী ঘোষের গাওয়া গফুর হালীর সেই মাইজভা-ারী গান ‘দেখে যারে মাইজভা-ারে হইতেছে নুরের খেলা’ কিংবা চাটগাঁইয়া সংগীতের নবতর ধারা যা একান্তই আবদুল গফুর হালীরই সৃষ্টি সেই মোহছেন আউলিয়ার গান ‘চলরে জিয়ারতে আউলিয়া দরবার/মোহছেন আউলিয়া বাবার বটতলী মাজার’-শিমুল শীলের কণ্ঠে আলোড়ন তুলে সারা বাংলা, সারাবিশ্বে। ১৯৫৫/৫৬ সাল থেকে ২০১৬, দীর্ঘ ৬০ বছরের সাধনায় আবদুল গফুর হালী প্রায় আড়াই হাজার গান লিখেছেন, এর মধ্যে মাইজভা-ারী, মরমী ও পীর আউলিয়ার গানের সংখ্যা প্রায় দেড় সহ¯্রাধিক। আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সংখ্যা সহ¯্রাধিক।
আবদুল গফুর হালীর সংগীত-জীবনের বড় কীর্তি হলো আস্কর আলী প-িত, কবিয়াল রমেশ শীল, খায়েরজ্জামা প-িতসহ চাটগাঁইয়া গানের মহত্তম রূপকারদের কাব্য ও গান প্রচার। এতে করে সুধী সমাজের কাছে এসব শিল্পীর সংগীত-প্রতিভা উন্মোচিত হয়, বিশেষ করে আস্কর আলীর গান ও কাব্য প্রচারে গফুর হালীর অবদান তার উত্তরসূরীদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
আবদুল গফুর হালীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫টি। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গীতিকাব্য ‘তত্ত্ববিধি’। ’৮৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘জ্ঞানজ্যোতি’। এরপর পিএইচপি ফ্যামিলির পৃষ্ঠপোষকতা ও সুফী মিজান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১২ সালে মাইজভা-ারী গান নিয়ে নাসির উদ্দিন হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় গীতিকাব্য ‘সুরের বন্ধন’। ২০১৪ সালে আঞ্চলিক গান নিয়ে মোহাম্মদ আলী হোসেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘শিকড়’। দুটি বইয়ে স্বরলিপিসহ ২০০ গান স্থান পেয়েছে।’ এরপর ২০১৫ সালে নাসির উদ্দিন হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আবদুল গফুর হালীর চাটগাঁইয়া নাটকসমগ্র’। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে মোহাম্মদ মহসিন সম্পাদিত ‘দিওয়ানে মাইজভা-ারী’ বইটি।
আবদুল গফুর হালীর গান দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের সাহিত্যিক ও গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ২০০৪ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হান্স হার্দার আবদুল গফুর হালীর জীবন ও কর্ম নিয়ে ‘ডার ফেরুখটে স্প্রিখট’ (পাগলা গফুর বলে) নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। সেই গ্রন্থে গফুর হালীর ৭৬টি মাইজভা-ারী ও মরমী গান জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ড. হান্স হার্দার আবুল গফুর হালীর এসব গানকে ‘পূর্ব বাংলার মরমী গান’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে ড. হান্স লেখেন, ‘আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজেকে শুধু বাংলা সাহিত্যের দিকে সরাসরি ধাবিত করেননি। তাঁর সাহিত্য ও দর্শন সাধনাকে চট্টগ্রামের একটি ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন আর তা সেই উৎসবে ক্রমাগত যাতায়াতের মাধ্যমে। প্রায় প্রতিদিনই তিনি মাইজভা-ারী গান রচনা করেন। ভালোবাসার এক অলৌকিক শিল্প তাঁকে টালমাটাল করে তোলে। ঐশ্বরিক এক শক্তি তাঁর নিজস্ব দর্শনকে পরিচালিত করে থাকে।’
বিশ্বখ্যাত সামাজিক নৃ-বিজ্ঞানী পিটার বার্টুসি আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে বলেছেন “ইবংঃ শহড়হি সধরলনযধহফধৎু পড়সঢ়ড়ংবৎ।’ (সূত্র-চবঃবৎ ঔ. ইবৎঃড়পপর, “ঝঁভর গড়াবসবহঃ রহ ইধহমষধফবংয: ঞযব গধরলনযধহফধৎু ঞধৎরয়ধ ধহফ রঃং ঋড়ষষড়বিৎং”, ঈড়হঃৎরনঁঃরড়হ ঃড় ওহফরধহ ঝড়পরড়ষড়মু, ঠড়ষ. ৪০, ঘড়. ১, ২০০৬, ঢ়ধমব: ১৬.)
প্রসঙ্গত, আমেরিকার আটলান্টা এমোরি ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর অবদুল গফুর হালীর গান নিয়ে গবেষণা করেছেন।
১৯৩২ সালে কলকতার এইচএমভি থেকে জগন্ময় মিত্রের তত্ত্বাবধানে শিল্পী মোহাম্মদ নাসিরের কণ্ঠে প্রথম মাইজভা-ারী গানের রেকর্ড বের হয়। এই রেকর্ডের মাধ্যমে মাইজভা-ারী গান প্রথম বাণিজ্যিক পরিম-লে প্রবেশ করে। রমেশ শীল ও মোহাম্মদ নাসিরের পর আবদুল গফুর হালী হলেন মাইজভা-ারী গানে নবযুগের ¯্রষ্টা।
আবদুল গফুর হালী গত ছয় দশকে বিভিন্ন ধারার প্রায় দুই হাজার গান লিখেছেন। গফুর হালী রচিত চিরসবুজ আঞ্চলিক গান হলো ‘ও শাম রেঙ্গুম নঅ যাইওরে’, ‘দিল বড় জ্বালারে পাঞ্জাবিওয়ালা’, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে’, ‘ঢোল বাজের আর মাইক বাজের’, ‘সোনাবন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা’, ‘বাইন দুয়ার দি ন আইস্য তুই নিশির কালে’, ‘রিকশা চালাও রসিক বন্ধুরে’, ‘ন মাতাই ন বুলাই গেলিরে বন্ধুয়া’, ‘তিন কুইন্যা পানর কিলি’, ‘হারলাই পরান কাঁদে’, ‘তুঁই মুখ কেয়া কইয্য কালা’সহ অসংখ্য গান।
আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তী জুটি শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের অনেক কালজয়ী গানের ¯্রষ্টা আবদুল গফুর হালী। শ্যাম-শেফালীর কণ্ঠে গফুর হালী রচিত দ্বৈত গান ‘নঅ যাইও নঅ যাইও/ আঁরে ফেলাই বাপর বাড়িত নঅ যাইও’, ‘বন্ধু আঁর দুয়ারদি যঅ আঁর লয় কথা কেয়া ন হঅ’, ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবল্লাই’, ‘কালিয়া বলে হরতাল গাড়ি ঘোড়া বন’, ‘লাক্কা ওঁনির তরকারি বেশি অইয়ে ঝাল’সহ অনেক গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
অন্যদিকে, গফুর হালী রচিত মাইজভা-ারী গান ‘দেখে যারে মাইজভা-ারে হইতেছে নুরের খেলা’, ‘দুই কূলের সোলতান’, ‘আর কতকাল খেলবি খেলা’, ‘নতুন ঘরে যাব আমার/এই ঘরে আর মন বসে না’, ‘নাচ মন তালে তালে মাওলার জিকিরে’, ‘তোরা ভালমন্দ যা খুশি কর’, ‘কোন সাধনে তারে পাওয়া যায়’, ‘আমি আমারে বেইচা দিছি মাইজভা-ারে যাই রে/আমার কিছু নাই’সহ অসংখ্য গান মাইজভা-ারী র্দশন ও আধ্যাত্ম সাধনার অনুপম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি এসব গান বাংলার আপামর জনসাধারণের সাংস্কৃতিক ক্ষুধা নিবারণ করছে।
এছাড়াও ‘জিলা চট্টগ্রামরে বার আউলিয়ার স্থান’, ‘শহীদের মা কাঁদেল্যে বটগাছ তলে বই/বেয়াগ্গুনর পোয়া ফিরি আইলো/আঁর পোয়া কই’সহ অনেক দেশাত্মবোধক গানের ¯্রষ্টা আবদুল গফুর হালী।
মাইজভা-ারী গান দিয়ে গফুর হালীর সংগীতজীবন শুরু হলেও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সাথে বন্ধুত্ব তার সংগীত-জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, তিনি আঞ্চলিক গান লেখা শুরু করেন। পাশাপাশি বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও শিল্পী হিসাবে আবির্ভূত হন। ৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেতরের আরডি আশরাফুজ্জামানের তাগাদায় গফুর হালী শ্যাম-শেফালীর জন্য প্রথম দ্বৈত আঞ্চলিক গান লিখেন। সেটি ছিল:
‘ন যাইও ন যাইও
আঁরে ফেলাই বাপের বাড়িত ন যাইও (ছেলে),
ন গইজ্য ন গইজ্য
বাপর বাড়িত যাইতাম মানা ন গইজ্য (মেয়ে)।’
বেতারে প্রচারের পর আলোড়ন তুলল এই গানটি। শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষের নাম ছড়িয়ে পড়ল হাটে-মাঠে। এর আগে মলয় ঘোষ দস্তিদারের ‘নাইয়র গেলে বাবোর বাড়ি আইস্য তারাতারি’সহ দুই-একটা দ্বৈত আঞ্চলিক গান গেয়েছিলেন শ্যাম-শেফালী। কিন্তু ‘নাইয়র’ গানটির দারুণ জনপ্রিয়তা আঞ্চলিক গানে নতুন ধারা সৃষ্টি করল। প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন জুটি-শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষ। এই একটি গান গফুরের জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে দেয়। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি।
আবদুল গফুরের জš§ ১৯২৯ সালে পটিয়ার রশিদাবাদে। বাবা, আব্দুস সোবহান, মা গুলতাজ খাতুন। লেখাপড়া করেছেন রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ে। গফুর হালীর ভাষায় তিনি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুব ভালো ফল করলেও উচ্চবিদ্যালয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারেননি, কেবল স্কুলে যাওয়া-আসা করেছেন।
রশিদাবাদের পাশেই সাধক-শিল্পী আস্কর আলী প-িতের গ্রাম, নাম হলো শোভনদ-ী। আস্কর আলীর গান শুনে বড় হয়েছেন গফুর। ছোটবেলায় তাঁর আধ্যাত্মিক ও মরমী গান গফুরের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তরুণ বয়সে প্রতিবেশীর পাল্লায় পড়ে একদিন আচমকা হাজির হলেন ফটিকছড়ির মাইজভা-ার দরবারে, গানের টানে। সেখানে রমেশ শীল, বজলুল করিম মন্দকীনি, মৌলানা হাদীর মাইজভা-ারীর গান তাঁর মনোজগত বদলে দেয়। লাল পোশাক পরা লোকজন যখন মাইজভা-ারে ঢোল বাজিয়ে নেচে নেচে গাইতেন তখন গফুর আর স্থির থাকতে পারতেন না। তাঁদের সঙ্গে নাচতেন, গলা মেলাতেন। একদিন মাইজভা-ারের ভক্তদের অনুরোধে গাইতে হলো আবদুল গফুরকে।
সেটা ১৯৫৫-৫৬ সালের কথা।
গফুর হালী বলেছিলেনÑ‘মনে হলো আমি যেন আমাকে হারিয়ে ফেললাম মাইজভা-ারের প্রেমবাজারে। অনেকটা পাগলের বেশে গ্রামে ফিরলাম। একটা শব্দই শুধু শুনি আকাশে-বাতাসে, কে যেন আমায় বলছে, ‘লেখ লেখ।’ অবশেষে লিখতে বসলাম, গান বাঁধলামÑ
‘আর কত কাল খেলবি খেলা
মরণ কি তোর হবে না
আইল কত গেল কত
কোথায় তাঁদের ঠিকানা।’
শুরু হলো আবদুল গফুরের গান লেখা ও সুর করা।
আবদুল গফুর হালী একজন মহান মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিকও। ’৭০ এর নির্বাচনের সময় চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠ ও পটিয়ার রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় গান গেয়ে বঙ্গবন্ধুর ¯েœহাশীষ পেয়েছেন গফুর হালী। সেদিন তিনি গেয়েছিলেন, ‘নৌকা চলে নৌকা চলে/ নৌকা চলে হেলেদুলে/এই নৌকা চালায় মুজিবর।’ আবদুল গফুর হালী সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি। তবে ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধারা হালীর একটি গান খুব পছন্দ করতেন, সেটি হলো-
‘তোর লয় আঁর লয় ন অইব অভাই
আঁই বাঙালী তুই পাঠান
তোর দেশে আর আঁর দেশে
দুই হাজার মাইল ব্যবধান।’
গফুর হালীর ‘মনের মানুষ’ : পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও তার পরিবারের বিরল ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন আবদুল গফুর হালী। বলা যায়, গত দুই দশক ধরে শিল্পী আবদুল গফুর হালীকে লালনপালন এবং তার সৃষ্টির পরিচর্যা করেছেন সুফী মিজান ও তার সন্তানরা। মৃত্যুশয্যায় বসে সেই কথাই বলে গিয়েছেন গফুর হালীÑ‘সুফী মিজান না থাকলে আবদুল গফুর হালীর অস্তিত্বও থাকত না। পিএইচপি আমার জন্য আল্লাহর রহমতস্বরূপ।‘
প্রসঙ্গত, সুফী মিজান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও আনোয়ারুল হক চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় আবদুল গফুর হালীর তিনটি গ্রন্থ (চাটগাঁইয়া নাটকসমগ্র, সুরের বন্ধন ও শিকড়) প্রকাশিত হয়েছে। ‘দিওয়ানে মাইজভা-ারী’ নামে আরেকটি গীতিকাব্য প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। এটি চাটগাঁইয়া গানের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। কারণ হাজার বছরের চাটগাঁইয়া গানের ইতিহাসে গফুর হালী ছাড়া আর কোন শিল্পীর গানের স্বরলিপি হয়নি, এটা একমাত্র পিএইচপি ফ্যামিলি এবং সুফী মিজান ও আনোয়ারুল হক চৌধুরীর অবদান।
অন্তিম মুহূর্তে একজন ব্যক্তিকেই কেবল দেখতে চেয়েছিলেন আবদুল গফুর হালী-আর সেই জন হলেন তার ‘ভাবজগতের ভাই’ সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। জীবনের শেষ কথাটিও সুফী মিজানকেই বলে গেছেন গফুর হালী-সেটা তাসওয়াফ জগতের কথা, তাই এখানে উল্লেখের বিষয় নয়।
গফুর হালী ছিলেন দিব্যজ্ঞানী। সংগীত-জীবনের শুরু থেকেই তিনি মৃত্যুর আরাধনা করেছেন। তার প্রথম গানটিই ছিল ‘আর কতকাল খেলবি খেলা/মরণ কি তোর হবে না’। পরিণত বয়সেও ¯্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করেছেন গানে গানে-‘নতুন ঘরে যাব আমার/এই ঘরে আর মন বসে না/ঘরখানা অতি পুরানা।’ শেষবেলায় হৃদয়ের গভীরতম সত্যকে উপলব্ধি করেছেন, মরার আগে মরতে চেয়েছেন, লিখেছেন-‘নাইয়রী নাইয়র হলো শেষ, এইবার চল আপন দেশ।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট