চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

মুক্তিযোদ্ধা মজিদ কাকা

শফিক নহোর

৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:১০ পূর্বাহ্ণ

নগরবাড়ি ঘাট পার হয়ে সখিপুর চর, প্রায় চল্লিশ মাইল এলাকাজুড়ে নতুন চর পরেছে, বেশ কয়েক বছর হলো। আমরা আগে ভাইয়ের চরে থাকলেও এখানে নতুন চরপড়ার কারণে ঘরবাড়ি এখানেই করেছি ক’বছর হল । নতুন জমিতে ফসল ভাল হচ্ছে, বেশি চাষআবাদ হচ্ছে। বাদাম, শীতকালীন সবজি, সরিষা, গম হচ্ছে খুবই কম। গঞ্জে গেলে মনে হয় আমারা সব চেয়ে গরিব মানুষ। আমাদের হাতে মোবাইল ফোন নেই, একজন ভ্যান চালক কাথিনাথপুর বাজারে দেখলাম। মোবাইল ফোনে কথা বলছে, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-ভাই মোবাইল কত টাহা দিয়ে কিনছেন ?
-ভাই আমি কিনি নিই, আমার কুটিভাই বিদ্যাশ থাহে , সে পাঠাইছে। বাড়িতে ফোন করে আমার সাথে কথা কবির চায়। আমি তো রিকশা চালাই সারাদিন, রাস্তায় থাহি। কথা কওয়া হয় না। তাই কুটিভাই ফোনডা পাঠাইছে দু’মাস হয়। মোবাইল দিয়ে ফটো তোলা যায়না। আমার খুব আউস করে মোবাইল দিয়ে ফটো তুলবো, এ মোবাইল দিয়ে খালি কথা কওয়া যায়। ধ্যাত ফালতু একটা মোবাইল দিছে আমারে।
-আপনি কি ঘাটে যাবেন ভাই।
-হ যাবো ।
-ভাড়া কিন্তু ভাই, পাঁচটে-হা। কম দিলি নিবো না।
– আরে ভাই, তোমার তো কলাম দিবোনে। বেলা চলি যাচ্ছে। জোরে চালাও। নৌকা আবার পাবোন না মনে হচ্ছে ; শালার লোকজন দিনদিন দালাল হয়ে যাচ্ছে। চরে বাস করেও শান্তি নাইরে ভাই ।
-আমার মিভাই, মোবাইল কিনি পাঠাইছে কয়দিন হল। একজন বলে দ্যাশে আসবি, তার কাছে পাঠাবি, কারেন্ট নাই আমাগোরে বাড়ি, মোবাইল ফোনডা দিলিও তো ভ্যাজাল আছে। নদী পার হয়ে গঞ্জে আসতে হবে চার্জ দিতে। চরের উপর কি আর কারেন্ট দিবি বেটারা, খেয়া পাড় হওয়াÑ তো ঝামেলা। সন্ধ্যার পরে আর কোন নৌকা থাকে না ঘাটে, তখন পরতে হয় মহা-ঝামেলায়।
ঘাটে এসে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। কত করে কচ্ছিলাম রে ভাই নৌকা ছাড়, ঘাড়ত্যারা বেটা কি কথা শুনে। শালা একটা ফালতু মার্কা-লোক। চাঁড়ালদের মত মোস বড় করে রাখছে। তার মুচের স্টাইল দেখলে আমার বিরক্ত লাগে। এত বড় মোস। পানি খায় কেবা করি । ভাত খেতে গেলি তো একহাত দিয়ে মোস ধরে তারপর মুখের ভিতর ভাত দোওয়া লাগবে নে। নৌকার মাঝি শীতের ভেতর একটা সাদা হাফ গেঞ্জি পরে আছে। ঠা-া লাগছে, আমি দেখে বুঝতে পারছি ; একবার জিগ্যেস করবির চালাম। এই চাঁড়াল লোকডার সাথে কতা কবির মন চাচ্ছে না। তবুও বড্ড মায়া হচ্ছিল তাঁর জন্ন্যি। কেমন একটা সৎ ও দেশপ্রেমিক ভাব চেহারার ভেতর ছাপ পড়ে আছে। গুণগুন করে দেশাত্মবোধক গান গাইছে, চারিদিকে হালকা কুয়াশা পড়ছে, দু’চোখ বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না। মাঝির বাড়ি ঠিক নগরবাড়ি না কালিয়া,নওয়াগ্রাম তার জন্ম স্থান। আগের বউ বাচ্চাকাচ্চাকে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মেরে ফেলছে। তারপর এখানে চলে এসেও যুদ্ধ করেছে। লেখাপড়া জানে না। মুক্তিযুদ্ধের ভাতা পাবে কী করে, মুক্তি বার্তা থেকে শুরু করে কোথাও কোন তালিকায় তার নাম ওঠে নাই। তবে সুজানগরের মুক্তিযোদ্ধা কুবাদ খাঁ, তাকে চিনত সে তখন সুজানগর, সমাজ সেবা অফিসের কর্মকর্তা ছিল, মানুষটা কালা হলেও অন্তরটা ছিল সাদা, মুখের কিনারে সব সময় হাসি লেগে থাকত।
সে বলেছিল,
– ভাই তোমার নামডা কি তুলে দিবো হাল নাগাদ তালিকা হচ্ছে।
– নাম টাম দি, কি হবি। ও সব ঝামেলার ভিতর আল্লাহর দোহাই লাগে ভাই আমারে দিও না। দেশের জন্নি যুদ্ধ করছি, খাতায় নাম রেখে কী হবি হে ভাই । যাদের জন্নি মায়া হত তারাই তো মায়া ত্যাগ করে আমার জীবনে থেকে বিদায় নেছে সেই কবে।
এসব গল্প শুনেছিলাম, সেদিন হাকেম কাকার কাছ থেকে। বেচারা কত কিছু করলো তবুও ভাইদের কাছে দোষী । নিজে সারাজীবন মাঠে নাঙল দিয়ে হালচাষ করে, ভাইদের লেখাপড়া শিখাইছে। ভাইয়েরা আজ ঢাকা শহরে গাড়ি-বাড়ি সব করছে, বড় ভাইটার কোন খবর রাখে না। সব নিমক-হারামের দল। মাটির নিচে গেলে তার পায়-পায় করে হিসাবে দিতে হবে। হক বলে একটা কথা আছে। হাকেম কাকা, বেশ কিছুদিন হল খুব-অসুস্থ । আমি সময় সুযোগ পেলে এক নজর দেখে যাই । কাকা তো এক বিঘা জমি দিয়ে এক মেয়েকে বিয়ে করছিল। কাকার শারীরিক দুর্বলতার কারণে কাকাকে ফেলে চলে গেছে। কাকার বয়স তো আর কম হল না। এক পা কবরে চলে গেছে । বিয়ের সময় অনেক-ই বলেছিল জমি দিয়ে বিয়ে করছে । অল্পবয়সী মেয়ে বিধবা হলেও । তার বিয়ে করা ঠিক হয়নি । অবশেষে মানুষের ধারণা ঠিক হয়েছে ।
আজ মাঝির গল্প শোনার পর আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এতো ভাল মানুষ তাঁর সঙ্গে আমি কত খারাপ ব্যবহার করেছি, মনে-মনে বকা দিয়েছি নিজেকে। দেখা হলে মাঝির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো । এ ভাবতে ভাবেতেই, হাকেম কাকার কাছ থেকে বিদায় নিলাম । টাকার কথা শুনে কাঠের পুতুলের মত হা করে আছে, তথাকথিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা । আর নগরবাড়ি ঘাটের মাঝি কোন কিছু পাবে বলে আল্লাহ্ খোদার দোহায় দিয়েছিল, সে সময় বে-নামে কত মুক্তিযোদ্ধা ছিলো, তারা কখনো নাম লেখাতে আসেনি । আজ যদি ধান্ধা-বাজ মানুষের সুযোগ দেওয়া যেত তাহলে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বেশি মানুষ আজ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যেত । প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে আড়াল করে ।
চরে রাতের বেলায় মাঝে-মধ্যে ডাকাতদল পড়ত, সুন্দরী মেয়েদেরকে লুকিয়ে রাখতে হত মা, শেফালিকে সন্ধ্যা হলে রান্নাঘরের মাচায় মাঝে-মধ্যে লুকিয়ে রাখত। অথবা যে বাড়িতে মেয়ে নেই, সে বাড়িতে রেখে আসতে হত। ডাকাত দল আগে থেকেই জেনে আসত কোন বাড়িতে মেয়ে আছে । বিশেষ করে সেই বাড়িতে রাতে ডাকত পড়ত, তখন তো তেমন কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। থানা পুলিশ সে দূরের কথা পুলিশ আসত না ভয়ে রাতের বেলায়, তার বিশেষ কারণও ছিল। নদী পার হওয়া। চারিদিকে অন্ধকার, ডাকাত দলের ভয় অনেক সময় শুনেছি পুলিশের কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে গেছে। ঘাটের মাঝির নামও আমি জানতাম না, সেদিন শেফালিকে ডাকাত দল জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো মজিদ কাকা উদ্ধার করেছিল।
আমার বুকের ভিতর তার জন্য দরদ হতে লাগল। আমি দ্রুত বাড়ি চলে আসলাম। নৌকার মাঝিকে নতুন দেখে আমার সন্দেহ হতে লাগল, তবুও কিছুই জিজ্ঞাসা করিনি। ঘাট থেকে পায়ে হেঁটে বাড়িতে আসতেও একঘণ্টা সময় লেগে যায়। শীতের সকাল তবুও আমি ঘামছি জামা ভিজে শরীরের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে ।বাড়িরে পালানে মায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা, মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগল। আমি মৃদুকণ্ঠে জানলে চাইলামথথ, কি হয়েছে মা ?
-তোর মজিদ কাকা না থাকলে শেফালি আজ মরে যেত ।
-কি হয়েছে বলো আমাকে ।
– কালরাতে বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল !
– শেফালি কোথায় ?
– তোর মজিদ কাকা শেফালিকে বাঁচাতে গিয়ে ডাকাতদের হাতে খুন হয়েছে ।
শেফালিকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে অন্যবাড়িতে ডাকাতরা ঢুকে ছিল । তোর মজিদ কাকা শেফালিকে উদ্ধার করে অন্য রাস্তা দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কি? মা তোর মজিদ কাকাকে ডাকাতরা খুন করে পালিয়ে গেছে। থানা থেকে পুলিশ এসেছিল। লাশ নিয়ে গেছে। এখনো ফিরে আসেনি। মজিদ কাকার মত মুক্তিযোদ্ধারা আছে বলেই, শেফালি আজ বেঁচে আছে । মজিদ কাকা যে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা আজ আমি তা বুঝতে পারলাম। মা মুক্তিযোদ্ধারা কখনো মরে না কালে কালে এভাবেই মজিদ কাকার মত মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকে। আমাদের হৃদয়ে,। লাল সবুজ পতাকায় বাংলার অহংকার হয়ে।

শেয়ার করুন