চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আত্ম-উন্মোচনের কাব্য রিজোয়ান মাহমুদের দুপুরলতা

শোয়েব নাঈম

৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:১০ পূর্বাহ্ণ

একটি কাব্যগ্রন্থ শুরু হয় শুধু কবিতা দিয়েই নয়, এর কভারের প্রচ্ছদ থেকেই পাঠ শুরু, নান্দনিক প্রচ্ছদে আর উৎসর্গপত্রের লেখাটি পাঠ করেই কবি রিজোয়ান মাহমুদের প্রতি এবং তাঁর গ্রন্থের ওপর অনেক শ্রদ্ধা বেড়ে ওঠে। কিন্তু একটা খুব মৌলিক ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছেÑ বিশেষ ঘরানার কবি, ইমেজ সত্ত্বার এই কবি একটা হেরে যাওয়ার জায়গা থেকেই বাংলা কাব্যচর্চায় এসেছিলেন। তারপরে ব্যক্তিলগ্নতার, পরিপার্শ্বের এবং প্রতিবেশের অনেক বৈশিষ্ট্য-কল্পনা, ইমেজ, সুর, স্বর ও নৈঃশব্দ্য। স্মৃতিকাতর উপকরণগুলোকে স্বতন্ত্র্যধারার কবিতায় অঙ্কুরিত করে এই কাব্যজগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। এবং সেই সমান মাপের সেই তীব্রতা ধরে রেখেছেন এই ‘দুপুরলতা’ গ্রন্থেও। তাঁর ছোট ছোট শব্দসৃষ্ট অপ্রগলভতার ইমেজভরা ৫৬টি কবিতায় অবিরলভাবে উনি নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলেছেন। কালের গর্ভে অনেক কবি হারিয়ে যান, কিন্তু রিজোয়ান মাহমুদ তাঁর কবিতায় টিকে থাকার ধ্রুপদী কাব্যপ্রকরণের সেইসব উজ্জ্বলতাগুলি যথাযথভাবে ধরে রেখেছেন।

একটি শব্দকে কেটে তার পাশেই অন্য শব্দ বসিয়ে অসাধারণ চিত্রকল্প তৈরি করে কবিতার ক্ষত এবং দ্বিমাত্রিক উপশম দুই-ই সৃষ্টি করতে পেরেছেন মেধার সাথে। বাক্যার্থকে অতিক্রম করে বহুস্তর অর্থে চলে যাওয়ার নিজস্ব একটা সিগন্যাচার আছে কাব্য-নিপুণতায়, যেখানে অনেক অর্থস্তর অনেক সংকেতের সমৃদ্ধিতে খুব সচেতন স্তরের কবিতা সৃষ্টি হয়েছে। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলির ভাষায় আর এক্সপ্রেশনে একটা লুকানো ডিটেলিং রেখে দিয়েছেন যা’ পাঠ করলে পাঠককে সাব্যস্ত করেন নতুন অর্থ খুঁজার।
আধুনিক কবিতায় নামকরণ প্রক্রিয়াটি একটি কবিতাকে নির্দিষ্ট অর্থে আবদ্ধ করে ফেলে, ব্যাপক কমিউনিকেশনের জন্য এই নামকরণ অনেক সময় প্রতিবদ্ধকতা তৈরি করে, কিন্তু ‘দুপুরলতা’ কবিতাগুলির শিরোনাম তাঁর ভাবনার বারান্দাকে আরও বিস্তৃত করেছে। প্রকট ঘটনাবলিকে জড়িয়ে তাৎক্ষণিকতার বশবর্তী হয়ে কোনো দুঃখ-বেদনা হা-হুতাশের কবিতা লিখেননি, তাঁর নিজের ভেতরকার একটা স্টেট অফ মাইন্ড আছে, এর সঙ্গে বাইরের নিরন্তর সাংঘর্ষিক বিজারণ প্রক্রিয়ায় আপনাআপনি একটা রসায়ন তৈরি হয়ে স্নায়ুতে কোনোভাবে মেশে সেই বোধ থেকেই শুরু হয় তাঁর কবিতার জার্নিটা। একটা রেখা টানলে সেটার দৈর্ঘ্য কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা’ না জেনেও যেভাবে একটা চিত্র তৈরি করা যায়, সেই রকমভাবে তাঁর সৃষ্ট শব্দগুলি দিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই এমন তীক্ষè চিত্রকল্প রচিত করে পঙ্ক্তিগুলি দিয়ে সংবেদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছেন।
তাঁর স্মৃতিগুলি বর্তমানকে এবং আগামীকে অন্যভাবে ভয়ঙ্করভাবে প্ররোচিত করে, কবির কাছে স্মৃতি মানে একধরনের দৃষ্টি। যত সময় গড়ায়, যে যে সময়কাল তিনি ছেড়ে এসেছেন এতকাল, ততই সময়ের সঙ্গে তীব্র দূরত্ব অনুভব করেন, একসময় ওই পুরনো ‘আমিটা’ যে স্বয়ং কবি নিজে সেটা যেন নিজেকেও আর বিশ্বাস করাতে পারছেন না, তখন সেই দুই ‘আমি’র ভিতরের দ্বান্দ্বিক বোধে কবিতার উপায়ে নিজের সাথেই কথাবার্তার চেষ্টা করেছেন-
“ঝাউপাতা নয় ঝরাপাতা তুমি বলেছিলেÑসেদিন থেকে আমি ঝরাপাতা/ কুড়োবার সাহস করেছি।/ দাদিমা প্রায়শ বলতেন, পাতা পতনের একটি দর্শন আছে, সব রাতে বৃক্ষগুলো সভা করে, পাতাগুলো কাঁদে” (ঝরাপাতার জন্য ঝরাকাব্য) ।

এভাবে অতীত দেখলে প্রথমে একটা অবিশ্বাস তৈরি হয় কবির মনের মধ্যে, তারপরে সন্দেহ হয়Ñ এই ‘আমি’টা আসলে কে?… কিন্তু মাথার মধ্যে ভিডিও’র মতো স্মৃতিগুলো দিয়ে কাব্যধারায় আত্ম-উম্মোচন করে নিজস্ব একটি নতুন পৃথিবী তৈরি করেন এবং এই আত্ম-উম্মোচন দর্শনের টেক্সট যতবার তিনি সৃষ্টি করেন কবিতায়, ততবার কবির উপলব্ধি হয় তিনি বেঁচে আছেন অতীতে-বর্তমানে-ভবিষ্যতে।
“কোনো এক জ্যোৎস্নাপক্ষ রাতে”…. ‘লামিয়া’ এর জন্য কবি হাহাকার করে উঠেছিলেন, তাঁর নিটোল কবিতা সৃষ্টির আনন্দটাও অনেক যন্ত্রণার মতো, এই আনন্দটা সর্বগ্রাসী যন্ত্রণার উচ্চকিত রাগ হয়ে কাঁপিয়ে স্তবকে স্তবকে বেরিয়ে আসেÑ
“একটি কবিতা লেখা হবে ভেবে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি/ বিজন রাস্তায়। রাস্তাগুলো ফাঁকা রক্ত লেগে আছে.. ” (অসুস্থ ইশতেহার)।
তাঁর এমন বেদনা-আক্রান্ত লেখায় অনেক গভীরতা ও তীব্র ঘনত্ব বেশি হলেও এসব বৈশিষ্ট্যেও তাদের বহিরাঙ্গের অর্থের এমন একটা চলন আছে যা বেশি পরিধির পাঠককে কাছে টানে।

পারফর্মিং আর্টনির্ভর কবিতা তিনি লিখেননি যা মঞ্চে উঠে উচ্চকণ্ঠে পাঠ করতে হবে বরং তাঁর ইমেজ নির্ভরে রচিত কবিতাগুলি শর্টফিল্মের খুব কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যে বেশ সমৃদ্ধ, অন্তর্নিহিত মানস-প্রতিমায় ভিজ্যুয়াল পোয়েট্রি নির্মাণের সহজাত অসাধারণত্ব এই গ্রন্থে যথেষ্ট অনুধাবন করা যায়। যেমন-
‘কিছু নীল কবুতর’ কবিতাটি সিনেম্যাটিক ভিশনে ব্যবচ্ছেদ করলে এভাবে কম্পোজিশন করা যায় …… খুব ভোরে উড়ে এসে উঠোনে বসেছে পালা কবুতর… শীতের ধুয়াশা কুয়াশা ভরা সকালে মা কোরান পড়ছেন… এবার কবুতরগুলি কবির নিদ্রারত রুমে খোলা জানালায় বসে খুঁটখুঁট শব্দে এদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে… এরপরে ক্যামেরাকে ঘরের ভিতরে ফোকাস করলে নামাজের জায়গাটি এখন ধূলিময় শূন্যস্থান কেবল, কোরানশরীফ রেহেলে পড়ে আছে নির্জনে… আশেপাশে কোথাও কবুতরের আওয়াজ নাই… এমন কবিতার ইমেজগুলি মাতৃহীন বিষণœ সকালকে আরও দুঃখ ভারাক্রন্তের পটভূমি তৈরি করেছে…
এভাবেই তাঁর কবিতার ভিতরে সম্পৃক্তভাবে তৈরি হয়েই আছে ফিল্মের ইমেজ।
রিজোয়ান মাহমুদের কিছু কবিতার বয়ানে বয়ানে ‘সাইনেস্থেশিয়া’ এর একটা বেশ প্রভাব আছে, অর্থাৎ এলিমেন্ট বদলে যায় বর্ণিত লেখার সাথে অনুভবের, গন্ধের বয়ান যেখানে আছে সেখানে রঙ পাওয়া যায়, শব্দের থেকে ঘ্রাণ উড়ে আসে।

সেই গন্ধ সেই রঙ সময়ান্তরে পাঠকের মুডকে পালটে দেয়। যেমন এই গ্রন্থের ‘তোমার দেহের ভাষা’ থেকে ‘সাইনেস্থেশিয়া’ এর প্রয়োগ খুঁজে পাওয়া যায়Ñ
“সারারাত ধরে ঘামের নুন থেকে জেগেছে উদলা রোদ / বিত্ত-বৈভব ভুলে আমরা দুজন কোথায় আজ ! / নোঙরের বিশদ কূজন তোমার দেহের ভাষা!”….
অনস্বীকার্য, তাঁর কবিতার এই অস্থিরমতিহীন বিস্ময়চিহ্নগুলিই পাঠকের বোধকে পাল্টে দেয়।
‘দুপুরলতা’ গ্রন্থে সূচিত করা আছে সম্পূর্ণ ন্যারেটিভনেস, সরাসরি বলে ফেলার শৈল্পিক প্রবণতা আছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, কিন্তু কোথাও কোনো বিমূর্ততা নেই, এতে কবিতাগুলি পাঠকের কাছে দুর্গমও না হয়ে অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ হয়ে উঠেছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট