চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে নারী

ড. সুদীপ্ত হাননান

২৭ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:১৮ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি জাতির সব অর্জনেই নারী নিজের কাজের মাধ্যমেই প্রোজ্জ্বল হয়ে আছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে গর্বের এবং ত্যাগের ইতিহাস। এই যুদ্ধ বাঙালি নারীর জীবনকে যেমন মহিমাময় করেছে, তেমনি নারীকে ভোগ করতে হয়েছে সীমাহীন মানসিক-কষ্ট। সাহিত্যের অপরাপর শাখার মতো বাঙালি নারীর কথা অনেক বেশি যৌক্তিকভাবে উঠে এসেছে স্বাধীনতা পরবর্তী অসংখ্য উপন্যাসে। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘একজনা’, ‘অয়নাংশ’, ‘ফেরারী সূর্য’, ‘কেউ জানে না’, ‘যাত্রা’, ‘রক্তের অক্ষর’, ‘দুই সৈনিক’, ‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘নীল দংশন’, ‘ওঙ্কার’, ‘অলাতচক্র’সহ নানা উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে নারীর নানামুখি ভূমিকার কথা।

কোনো উপন্যাসে উঠে এসেছে আবহমান বাঙালি নারীর মাতৃত্ব উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর তাগিদ, কোনো উপন্যাসে আমরা পাই স্ত্রী হয়েও রাজাকার স্বামীর অগোচরে মুক্তিযোদ্ধাকে সহায়তা করার চিত্র, কোথাও দেখি নারী নিজের গলার হারটি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার হাতে তুলে দিচ্ছে, কোনো উপন্যাসে দেখি নারী নিজের ভালোবাসা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে যুদ্ধের চেতনায় স্থিত থাকতে প্রেরণা দিচ্ছে, কোনো উপন্যাসে দেখি নারী নিজের সম্ভ্রম হারিয়েও মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করে গেছে, কোনো উপন্যাসে নারী সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কখনো সেবার ব্রত নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে সুস্থ করার পথে নারী নিজেকে যুক্ত করেছে, কখনো প্রতিশোধ স্পৃহায় কৌশলে কোনো পাক-সেনাকে হত্যা করেছে। কখনো দেশমাতৃকার বৃহত্তর স্বার্থে নিজের মাতৃহৃদয়ের বাৎসল্যকে বিলিয়ে দিয়েছে। দেশের মুক্তির জন্য নিজের সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার হতে পাঠিয়েছে; কখনোবা কোনো মুক্তিযোদ্ধার প্রেরণার উৎস হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, সেবা দিয়ে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছে নারী; বুকে গ্রেনেড বেঁধে শত্রুসেনার গাড়িবহরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবনের বিনিময়ে দেশের শত্রু খতম করেছে নারী; অথবা অন্তত শত্রু সেনার ও দালাল রাজাকারদের ধ্বংস কামনা করেছে এদেশের অগণিত মা-বোন। নিজের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ নাড়িছেঁড়া ধনকে দেশমাতৃকার জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষার জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য পাকসেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসের ‘বুড়ি’। গ্রামের এক অতি সাধারণ মেয়ে বুড়ি। দুই সৎ ছেলের স্বাভাবিক জীবনে, মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোতে যে অস্বাভাবিকতা নেমে আসে তা দেখে দেখে বুড়ি নিজে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার মা হয়ে ওঠেন। মুক্তিযোদ্ধা দুই সৎ পুত্রকে বাঁচানোর জন্য বুড়ি নিজের নাড়িছেড়া পুত্রকে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে।

‘রাইফেল রুটি আওরাত’ উপন্যাসে শিক্ষিত এবং রাজনীতি সচেতন ‘এলা’ চরিত্রে আমরা দেখি এক ভিন্ন দিক। ‘এলা’ গোপন পার্টির সঙ্গে যুক্ত। সে সরকারি কাজের ভেতর থেকেও গোপন পার্টির কাজ এবং স্বাধীনতার জন্য অনেক কিছু করে যায়। এলার ওখানে সুদীপ্ত শাহীন ও তার স্ত্রী-সন্তানের আশ্রয় জোটে। এলা পরম আপন লোকের মতো মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল সময়ে নিজের বাসায় তাদের আশ্রয় দেয়।

‘যাত্রা’ উপন্যাসে ‘নীলা’ তৎকালীন শিক্ষিত নারী চরিত্রের প্রতিনিধি। পঁচিশে মার্চের পর ঢাকা শহর থেকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য অসংখ্য শরণার্থীর সঙ্গে সেও রওনা হয়েছে। এক আশ্রয় স্থলে দেখা হয় আহত মুক্তিযোদ্ধা হাসানের সঙ্গে। আহত হাসানকে উপন্যাসের আর এক মাতৃতুল্য চরিত্র ‘বিনু’র সঙ্গে মিশে সুস্থ করার পদক্ষেপ নেয় নীলা। একপর্যায়ে নীলা হাসানকে ভালোবেসে তার হৃদয়ে দেশপ্রেমকে বেশি করে জাগিয়ে তোলে। এই নীলারা সীমান্ত পার হয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছে, নতুবা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাযতœ ও চিকিৎসা দিয়েছে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য বাঙালি নারী বিধবা হয়েছিলো। কারো স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হওয়ায় নিজে বিধবা হয়েছে, মেনে নিয়েছে বৈধব্যকে, দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য। বাংলায় তখন এমন অনেক নারী ছিলো যাদের স্বামী দেশের সঙ্গে শত্রুতা করেছিলো। রাজাকার দালাল হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেছিলো। এমন স্বামীদের অনেক স্ত্রী-ই মনে মনে বৈধব্য চেয়েছে, এটিও আমরা দেখি বেগম জাহান আরার ‘অয়নাংশ’ উপন্যাসে। এ উপন্যাসে জমিলা এক কৌশলি মুক্তিযোদ্ধা। জমিলার দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তার স্বামী করম আলী পাকিস্তানিদের দালাল। জমিলা দালাল স্বামী করম আলীকে কঠোরভাবে উপহাস করে। পদ্মা পার হয়ে যারা অপারেশনে আসে তাদেরকে সে খাওয়ায়, লুকিয়ে রাখে ধানের গোলায় কিংবা টিনের ছাদের নিচের চোরা কুঠরিতে। এছাড়াও কিছু নারী চরিত্র রয়েছে যাদের চরিত্রগত বিকাশ তেমন নেই উপন্যাসসমূহে। কিন্তু যেটুকুর উপস্থিতি আমরা পাই সেটুকুতেই তারা নিজেদের উপস্থিতিকে উজ্জ্বলতর করেছে।

রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসে এমন এক নারীর উপস্থিতি পাওয়া যায়, যার মুক্তিযোদ্ধাদের দেখার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করতে পারার খুব ইচ্ছে ছিলো। ‘ফেরারী সূর্যের’ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আশেকরা যুদ্ধের টাকা সংগ্রহের জন্য ব্যাংক লুট করতে গেলে কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে মহিলাটি তা দেখে এবং এক পর্যায়ে নিজে আশেকদের ব্যাগে টাকাগুলো তুলে দিতে সাহায্য করে এবং শেষে নিজের হাতের বালা দু’টো আশেকদের হাতে তুলে দেয়। নিজের ছেলেকেও অনেক মা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যুদ্ধে পাঠিয়েছে। প্রেমিকা তার প্রেমিককে জীবন বাঁচিয়ে তার নিকট ফিরে আসতে বলেনি, যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেনি। বরং শওকত ওসমানের ‘নেকড়ে অরণ্য’ উপন্যাসের প্রেমিকা সখিনা ভেবেছে যদি সে জানতে পারে যে প্রেমিক যুদ্ধে যায়নি, রাইফেল হাতে নেয়নি, মর্টার ছোঁড়েনি তাহলে সে তাকে আর ভালোবাসবে না। আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ এবং ‘অলাতচক্র’ উপন্যাসে নারী হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। বাঙালি তথা সমগ্র বাংলা কীভাবে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শ্লোগানে স্বাধিকার চেতনায় জেগে উঠলো তা-ই আহমদ ছফা দেখিয়েছেন ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসে বোবা মেয়ের ‘বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণের মাধ্যমে। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপে কীভাবে বেহাত হলো, কীভাবে মৃত্যুবরণ করলো তারই এক প্রতীকী বিশ্লেষণ করেছেন আহমদ ছফা তাঁর ‘অলাতচক্র’ উপন্যাসে। যেদিন ভারত সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এই উপন্যাসে ‘তায়েবা’ সেদিনই মৃত্যুবরণ করে। বাঙালি নারী নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রেখেছে। স্বামীহারা, সন্তানহারা, পিতাহারা, প্রেমিকহারা নারী নানা প্রচেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের অবদান রেখেছে। তাই দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য বাঙালি নারীদের অংশগ্রহণ এবং ত্যাগ অবশ্যই স্বতন্ত্র মর্যাদার দাবি রাখে।

শেয়ার করুন