চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

প্রফেসর পারভেজ-এর সুষম সমাজ বিনির্মাণ নীতি নির্ধারকদের পথ দেখাবে

মুহাম্মদ মুসা খান

২৭ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:১৮ পূর্বাহ্ণ

প্রফেসর আহসানুল আলম পারভেজ সৃজনশীল একজন শিক্ষাবিদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে পাঠদানের পাশাপাশি দেশ ও সমাজের সব সেক্টরের অনিয়মগুলো নিয়ে তিনি ভাবেনÑকথা বলেন, লিখেন, প্রতিবাদ করেন, সমাধানের সুপারিশ করেন। তাঁর চিন্তাশীল লেখা ও প্রকাশনা এবং গবেষণা পত্র দেশি-বিদেশী জার্নাল ও পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখায়-কথায় মাটি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়। দেশে অর্থনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন “ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (এনবিইআর)”। প্রতিষ্ঠা করেছেন “বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র”।

গত নভেম্বর’১৯ মাসে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কিত তাঁর সৃজনশীল চিন্তার বই “সুষম সমাজ বিনির্মাণ” প্রকাশিত হয়েছে। সুষম সমাজ বলতে তিনি এমন এক সমাজের কথা কল্পনা করেছেন, যেখানে হানাহানি, গুম, খুন, ধর্ষণ, রক্তের হোলিখেলা থাকবে না। যেখানে নতুন প্রজন্ম আদরে বড় হবে, বৃদ্ধরা থাকবে সমাদরে, যুবক-যুবতীদেরকে শিক্ষা জীবন শেষে চাকুরির জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না। একটি সুশৃংখল ও সুন্দর জীবন-যাপনের গ্যারান্টি থাকবে এখানে। তিনি বইটির উপলব্ধি অনুচ্ছেদে উপলব্ধিতে লিখেছেন, একদিকে কেউ কেউ ক্যাসিনোতে কয়েক ঘণ্টায় উড়ায় ২০-৫০ লক্ষ টাকা। অন্যদিকে গার্মেন্টস্সহ কল-কারখানায় মাসিক ৬০০০-৮০০০ টাকা বেতনের চাকুরিরতরা একই সমাজে বাস করে। এখানে একশ্রেণীর মানুষ ১০০/২০০ টাকার একবেলা খাবার যোগাড় করতে হিমশিম খায়, আর অন্যদিকে বিএমডাব্লিউ, মার্সিডিস, লেক্সাসের মালিকরা ৫৫০০-৮৫০০ টাকা দামের বাফেট লাঞ্চ/ডিনার খায়। দেশে ২৭-২৮ লক্ষ শিক্ষিত বেকারসহ অশিক্ষিত-অদক্ষ বেকার বাড়ছে। সামাজিক অস্থিরতা তলে তলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মানুষের এই বিভাজন বৈষম্য তাঁকে ব্যথিত করে। তিনি চান-এই বৈষম্য দূর হোক। বইয়ের “অবাক পৃথিবী-৮৬ ট্রিনিয়ন ডলারের অর্থনীতি” অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, বিশ্ব অর্থনীতি ১৫ দেশের দখলে চলে যাচ্ছে। দেশগুলো হলোÑ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, জার্মানী, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারত, ইতালী, ব্রাজিল, কানাডা, রাশিয়া, দঃ কোরিয়া, মেক্সিকো। তিনি লিখেছেন, সম্পদ ও আয় বৈষম্য বিশ্বজুড়েই প্রকট। মানবজাতির দুর্দশার জন্য সম্পদে অসম পরিস্থিতিকে তিনি দায়ী করেছেন।
“স্ফুলিঙ্গের উন্নয়ন বনাম টেকসই উন্নয়ন”, অনুচ্ছেদে তিনি অন্যতম তেল জ্বলানী রফতানিকারক দেশ ভেনিজুয়েলার ধসে পড়া অর্থনীতি সম্পর্কে অলোকপাত করেছেন। যা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। “সুষম সমাজের ধারণা ও উপক্রমানিকায়” তিনি একটি সুন্দর দেশের কল্পনা করেছেন, যেখানে ধনী-গরীবের বৈষম্য কমে যাবে। এখানে তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা সংযুক্ত করেছেন যার কয়েকটি লাইন হলোÑ “লড়াইটা জাতি নিয়ে নয়, ভাত নিয়ে হোক। লড়াইটা বাবরি নিয়ে নয়, চাকরি নিয়ে হোক। লড়াইটা দীক্ষা নিয়ে নয়, শিক্ষা নিয়ে হোক”Ñএতেই তাঁর মানবতাবাদি মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

বইটিতে “প্রস্তাবনায়” তিনি অনেকগুলো প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রস্তাবনাগুলো হলোÑবেকারত্ব দূরীকরণে প্রত্যক্ষ বরাদ্ধ বৃদ্ধি, প্রান্তিক মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ১৯০৯ ডলারের কাছে পৌঁছানো। মানসম্মত চিকিৎসার জন্য আলাদা মান নিয়ন্ত্রন দপ্তর প্রতিষ্ঠা, নার্সিং ইনস্টিটিউট খোলা, মোবাইল কোর্টের পাশাপাশি খাদ্য অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিচার ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ ও আদালত সংখ্যা বৃদ্ধি, ধর্ষণ-নারী নির্যাতনের অপরাধিদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দ্রুত কঠোর বিচার নিশ্চিত করা। সুষম বাজেট ভাবনা, বাজেট ও ব্যাংকিং খাতকে গরীব বান্ধব করা, ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজানো, রংবেরং তথা সাদা-কালো টাকা প্রসংগে, ব্যাংক ঋণের সুষম বণ্টন, নারীদের ও নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, মাদকবিরোধী টেকসই অভিযান, সকল নিয়োগ পরীক্ষায় ডোপ টেস্ট চালু, ঘুষ ছাড়া ব্যাংক লোন নিশ্চিত করা, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য উন্নত জীবন ও আবাসনের ব্যবস্থা করা, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী ১০,০০০/- টাকা নির্ধারণ, প্রত্যেক পলিটেকনিক-এ-ড্রাইভিং ডিপার্টমেন্ট খোলা, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ভোকেশনাল শিক্ষার জন্য পৃথক বিভাগ খোলা, চাকুরি ক্ষেত্রে বয়সের বাধা তুলে দেয়া, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফি নির্ধারণ, শিক্ষা ঋণ চালু, বিমান বন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া-ইত্যাদি। তাঁর এসব প্রস্তাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকগণ এই বই-এর পরামর্শ সমূহ গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নিলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবেÑবলে আমাদের মনে হয়েছে। তাঁর এ সব প্রস্তাবনা দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতিতে অবদান রাখবে বলেও আমাদের মনে হয়েছে।
বইয়ের ১২৩ হতে ১৩৬ পৃষ্ঠায় তিনি “নেতা, নেতৃত্ব ও সমাজ” শিরোনামে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন এবং ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সনে দেয়া দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ সংযোজন করেন। যা অনেকের অজানা ছিল।

প্রফেসর আহসানুল আলম পারভেজ-এর লেখা ১৫২ পৃষ্ঠার “সুষম সমাজ বিনির্মাণ” বইটি একটি বিশ্লেষণধর্মী বই হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। যা পড়ে পাঠক সমাজ অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন। বইটি প্রকাশ করেছেন, বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র ও ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ। চমৎকার প্রচ্ছদ ও সুন্দর ছাপার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৪০০/- টাকা। আমি বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

শেয়ার করুন