চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সমর সেনের কবিতায় তিরিশের নেতিবাচক নগর

শাহিদ হাসান

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

১৯৩৭ সালে সমর সেনের ‘কয়েকটি কবিতা’ নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তাঁর কবিতা রচনার উত্থান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালে তিরিশের দশকে। উক্ত দশকে প্রকৃত অর্থে নগরকেন্দ্রিক নেতিবাচক ভাব ধারার মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার শোভা যাত্রা। এ ধারার সারথিরা হলেন- জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও অমিয় চক্রবর্তী। এঁদেরকে আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্যে পঞ্চ-পা-ব বলা হয়। তাঁরা বাংলা কবিতায় নেতিবাচকতাকে প্রধান উপজীব্য করে অন্যান্য বিষয় ও অনুষঙ্গ যুক্ত করেছেন।

ব্রিটিশবাহিত ইউরোপীয় নেতিবাচক আধুনিকতা সমর সেনসহ তিরিশের কবিতার পরতে পরতে অখ- গৌরবে চিত্রিত। টি.এস. এলিয়ট এবং এজরা পাউন্ডের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, বিষয়বস্তু ও করণকৌশল বাংলা ভাষায় তিরিশের আধুনিক কবিদের কাব্যে ব্যাপকভাবে প্রভার বিস্তার করেছে। নেতিবাচকতা মূলত তাঁদের আরাধ্য বিষয়।
প্রথম বিশ^যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের শোক, দুঃখ, বেদনা, কষ্ট, হতাশা, বিষণœতা এবং সর্বোপরি অনিশ্চিত জীবনযাত্রা এলিয়ট ও পাউন্ডের কবিতার বিষয়গত দিক থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য। উল্লেখিত বিষয়গুলো তাঁদের পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান এবং সংগত কারণে তাঁদের কবিতায় বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক।
প্রথম বিশ^যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে ইউরোপকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। ইউরোপের মারাত্মক সংকটের জোয়ার নয়, তার স্রােতের ক্ষীণ ধারা এ উপমহাদেশের দিকেও আসে। তিরিশের কবিরা তাঁদের কবিতায় এলিয়ট ও পাউন্ডের মাধ্যমে ইউরোপের ‘বন্ধ্যাচিত্র’ সরাসরি গ্রহণ করেন। বিশেষ করে এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ নামে দীর্ঘ কবিতাটির নেতিবাচক বিষয়বস্তু এবং কবিতা রচনার প্রকৌশল তিরিশের উল্লেখিত কবিদের মেধা ও মননে রূপকথার দৈত্যের মতো আমৃত্যু ভর করেছিল। এ নেতিবাচক দৈত্যকে তাঁদের চিন্তন প্রক্রিয়া থেকে কখনো সরাতে পারেনি। সমগ্র ইউরোপের প্রথম বিশ^যুদ্ধ এবং আসন্ন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী নেতিবাচকতা কলকাতা নগরকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ চিত্র বাংলা কবিতায় অংকন করেন তিরিশের কবিরা। সমর সেন এ-ধারার একজন অন্ধ অনুসারী এবং বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য গদ্যছন্দের কবি। এবার দেখা যাক ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ বাহিত ‘বন্ধ্যাচিত্র’ সমর সেনের কবিতায় কীভাবে প্রভাব ফেলেছে-
ক. হলুদ রঙের চাঁদ রক্তে ম্লান হল,/তাই আজ পৃথিবীতে স্তব্ধতা এল,/ বৃষ্টির আগে শব্দহীন গাছে যে কোমল, সবুজ স্তব্ধতা আসে।
‘হলুদ রঙের চাঁদ’ -এর মাধ্যম কবি সমাজে অসুস্থ পরিবেশের ইংগিত দিয়েছেন। এখানে হলুদ মানে পা-ুর রোগ বা জন্ডিস যা রোগাক্রান্ত মানুষকে অনেক সময় মৃত্যু দিকে ঠেলে দেয়। কবি সমর সেন তাঁর মানস জগতে কলকাতা নগরকে পা-ুর রোগীর মতো কল্পনা করে তার চিত্র অংকন করেছেন, যা টি. এস. এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ডের প্রতিচ্ছবি। সমর সেনের কবিতা এবং টি. এস. এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ড পাশাপাশি রেখে পড়লে সচেতন কাব্যপাঠক তা সহজে ধরতে পারবে। সমর সেন কলকাতার পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটে অবস্থান করে টি.এস. এলিয়টের চোখ দিয়ে ধূসর স্তব্ধতার বর্ণনা করেছেন। তাঁর সময়ে প্রকৃত অর্থে কলকাতা নগর প্রথম বিশ^যুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত ইউরোপীয় নগরে রূপান্তর ঘটেনি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতার আরো কটি পঙ্ক্তি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যাক-
খ. দূরে পশ্চিমে/বিপুল আসন্ন মেঘে অন্ধকার স্তব্ধ নদী।
গ. নিঃসঙ্গ বট/ যেন পূর্বপুরুষের স্তব্ধ প্রেত
ঘ. বর্ষার সিক্ত পশুর মতো স্তব্ধ বসে/বক্রদেহ নায়কের দল
চ. দুনিয়াদারীর দুর্দিন, বাজার অন্ধকার/পথে জমকালো স্তব্ধতা।
ছ. ধূসর সন্ধ্যায় বাইরে আসি/বাতাসে ফুলের গন্ধ
জ. অন্ধকার ধূসর, সাপের মতো মসৃণ
ঝ. রাত্রে ধূসর সমুদ্র থেকে হাহাকার আসে
ঞ. তোমার ধূসর জীবন হতে এস
সমর সেনের রচিত এসব পঙ্ক্তিমালা পাঠ শেষে ইতিহাস সচেতন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিককালে তিরিশের দশকে এ উপমহাদেশের পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট কী ইউরোপের মতো ধূসর ও স্থবির হয়ে পড়েছিলো? ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, উক্ত সময়ে উপনিবেশ মুক্ত দেশ গড়া লক্ষ্যে এ উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছিলো।
উপনিবেশ কালের তিরিশের দশকে এ উপমহাদেশের মানুষের মন-মননে কবি সমর সেনের কবিতার মতো স্থবিরতা আসেনি। জনসাধারণের মনে সমর সেনের কবিতার মতো স্থবিরতা আসলে এ উপমহাদেশ উপনিবেশ মুক্তির সংগ্রামে কখনো লিপ্ত হতো না।
ঔপনিবেশিক কালখ-ে সমর সেনসহ তিরিশের নেতিবাচক নগরকেন্দ্রিক আধুনিক কবিরা কখনো ভাবতে পারেনি দেশ উপনিবেশ মুক্ত হবে। তার অন্যতম প্রধান কারণ তাঁদের রুটি-রুজি। তাঁরা সকলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তাঁদের পক্ষে মুক্তির আলো দেখা সম্ভব নয়। সাধারণের মতো মুক্তির আলো দেখলে তাঁদের রুজি-রুটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সচেতন পাঠক অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন সমর সেনের কবিতায় মুক্তির আলোর বদলে অন্ধকারের ব্যাপকতা বিদ্যমান। ‘স্তব্ধতা’, ‘ধূসরতা’, ‘অন্ধকার’, ‘ক্লান্তি’ সব কটি শব্দ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর কবিতার শরীরে পুনঃপুন ব্যবহৃত হয়েছে। এর কারণগুলো হচ্ছে-

১. সমর সেনসহ তিরিশের কবিরা জন্মান্ধের মতো টি.এস. এলিয়টকে অনুকরণ করেছেন। তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান ইউরোপবাহিত নেতিবাচক আধুনিকতা।
২. সমর সেন স্থান-কাল-পরিবেশ-প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অন্তত কবিতা রচনার ক্ষেত্রে সচেতন ছিলেন না। তিনি কলকাতায় অবস্থান করে প্রথম বিশ^যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ইউরোপের দৃশ্যপটের আঁধারে নিমজ্জিত ছিলেন।
৩. সমর সেনের জন্ম, শিক্ষা ও কবিজীবন শুরু হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালে। তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন। যেখানে সবকিছুকে সামগ্রিকভাবে না দেখে খ-িতভাবে দেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। খ-িত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সমর সেন তাঁর কবিতা বারবার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বয়ান করেছেন। তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে সুর, দৃষ্টিভঙ্গি, বয়ান এবং শব্দের একই অর্থে পুনঃপুন ব্যবহারে সচেতন পাঠক সমাজকে ভীষণভাবে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত করে। তাঁর কবিতা পাঠ শেষে পাঠক হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং চিন্তার নীলিমায় জমে প্রগাঢ় আঁধার। কবি সমর সেনের নজরে ইতিবাচকতা কখনো আসেনি। অথচ কাজী নজরুল ইসলাম, চল্লিশের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ অনেকে ঔপনিবেশিক পরিবেশে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিতা রচনা করে এ উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষীর মন ও মননকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার ইংগিত দিয়েছেন। তাঁরা অন্তত দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক থেকে কবিতায় বদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্ত পরিবেশের রূপকল্পটি চালু করেছেন। এদিক থেকে তাঁরা সমর সেন ও তিরিশের কবিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
৪. সমর সেনের নেতিবাচক নগরকেন্দ্রিক কবি। তাঁর মননে সর্বদা বিদ্যমান নগর মানে নেতি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচকতার কোন পথ খোলা নেই। এটি তিরিশের কবিদের বেলায়ও প্রযোজ্য। টি. এস. এলিয়টবাহিত এ ব্যাধি থেকে সমর সেন ও তিরিশের কবিরা শেষ পর্যন্ত মুক্ত হতে পারেননি। সমর সেন নিজে বলছেন একই বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কবিতা লেখার আর প্রয়োজন নেই। পরবর্তীতে তিনি আর কবিতা লেখেননি। এ সিদ্ধান্ত তাঁর জন্যে মঙ্গল হলেও পুনরাবৃত্তি থেকে কবি সমর সেন বাঁচতে পারেননি। তাঁর প্রকাশিত চারটি কাব্যগ্রন্থে পুনরাবৃত্তির চিত্র সুস্পষ্ট। তাঁর সমকালে তিরিশের কবিরাও পুনরাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।

৫. উপনিবেশ কালের নগরকেন্দ্রিক আধুনিকতাকে কবি সমর সেন মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হতে পারে তাঁর শিক্ষাগ্রহণ ও মানস গঠন কালের পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট ছিল আধো গ্রাম এবং আধো শহর। কলকাতা যখন ঔপনিবেশিক মহানগরে পরিণত হয় তখন তার চরিত্রের সঙ্গে কবি সমর সেন মানিয়ে চলতে পারেননি। কলকাতা মহানগরে বসবাস করে সমর সেন এলিয়টের ভাবনায় জারিত হয়ে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করেছেন। কলকাতাকে বারবার মনে করেছেন প্রথম বিশ^যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী ইউরোপের বিধ্বস্ত নগরের মতো। এ কারণে কবি সমর সেন মনে করেছেন নগর মানে শুধুমাত্র অন্ধকারে ঘেরা ক্লান্তিকর ও ক্লেদাক্ত এক পরিবেশ। নগরের উন্নয়ন এবং উন্নত জীবনযাত্রার পরিবেশ কবি সমর সেনের চোখে পড়েনি। তার কারণ তিনি টি.এস. এলিয়টের কবিতা ও ভাবনার অন্ধভক্ত ছিলেন। কিন্তু এলিয়ট সমগ্র ইউরোপকে দেখেছেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে নেতিবাচক অর্থে, যা তাঁর জন্য প্রাসঙ্গিক। এ প্রেক্ষিত কলকাতার কবি সমর সেনের জন্য নয়। দুটির পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। এ বিষয়টি সমর সেন ও তিরিশের কবিদের মধ্যে ছিল না। এতে সময়ের চরিত্র ও স্থানের পরিবেশ সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
৬. সমর সেন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের কবি ছিলেন না। ঔপনিবেশিক কালে সমর সেনের কবিজীবনের উত্থানের কারণে নেতিবাচক প্রভাব তাঁর কবিতায় ভয়ংকরভাবে এসেছে। এক্ষেত্রে টি.এস. এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। সমর সেনরা কখনো ভাবতে পারেননি এ উপমহাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হবে। অথচ তাঁদের চিন্তা ভুল প্রমাণিত করে ১৯৪৭ সালে ভাগের মাধ্যমে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পরবর্তী পর্যায়ে সমর সেন কবিতা লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন আর তিরিশের কবিরা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে বসবাস করে নেতিবাচক অর্থে কবিতা রচনা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁদের অর্জিত মুদ্রা দোষের কারণে নতুন ভাবনায় কবিতা লিখতে পারেননি। এখানে প্রসঙ্গ ক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, কবি জীবনানন্দ দাশ গ্রামীণ পটভূমির উপাদান ও উপকরণে রচিত কবিতায় নগরকেন্দ্রিক নেতিবাচকতাকে অবলীলায় প্রবেশ করেছে। যেমন-
১. পা-ুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি/ নিস্তব্ধ ছিলাম বসে;/শিশির পড়িতেছিলো ধীরে-ধীরে খসে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়, কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো।/তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?/অন্ধকার হাৎড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;/যখন জ্বালিব আলো কার মুখ দেখা যাবে বলিতে কি পারো?/কার মুখ? আমলকী শাখার পিছনে/শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো তাহা;/এ-ধূসর পা-ুলিপি একদিন দেখেছিলো, আহা,/সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।/তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,/পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,/মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন:/সেই মুখ আর আমি রবো সেই স্বপ্নের ভিতরে।
(স্বপ্ন)
২. এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,/কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।/শহর ও গ্রমের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে-/সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।/এদিকে কোকিল ডাকছে- পউষের মধ্য রাতে;/কোনো-একদিন বসন্ত আসবে বলে?/কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?/তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হয়ে যেতে দেখেছি,/তারা কিশোর নয়,/কিশোরী নয় আর;/কোকিলের গান ব্যবহৃত হয়ে গেছে।/সিংহ হুঙ্কার করে উঠছে:/সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,/স্থবির সিংহ এক-আফিমের সিংহ-অন্ধ-অন্ধকার।/চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে/মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।/সিংহ অরণ্যকে পাবে না আর/পাবে না আর/পাবে না আর/কোকিলের গান/
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খশে খশে/চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।/হে পৃথিবী,/হে বিপাশামদির নাগপাশ, -তুমি/পাশ ফিরে শোও,/কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।
(শীতরাত)
৩. হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!/তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!/পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;/আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে/বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!/হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে!
(হায় চিল)
চিন্তাগত দিক থেকে কবি সমর সেন তিরিশের পঞ্চ-পা-বদের সম-মনস্ক। ১৯৩৭ সালে সমর সেনের ‘কয়েকটি কবিতা’ নামে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর ১৯৪২ সালে ‘নানাকথা’, ১৯৪৩ সালে ‘খোলা চিঠি’ এবং ১৯৪৪ সালে ‘তিনপুরুষ’ প্রকাশিত হয়। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ একই সুর ও চিন্তন প্রক্রিয়ায় বাঁধা, যা সচেতন পাঠকের মন ও মননের আকাশে ক্লান্তির মেঘ জমায় এবং দ্বিতীয়বার পাঠের আর আগ্রহ জন্মায় না। চিন্তা ও বিষয়ের পুনরাবৃত্তি তাঁর কবিতায় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমর সেন ও তিরিশের কবিদের নগরকেন্দ্রিক নেতিবাচক ভয়ংকর চেতনা এদেশের অনেক কবির কবিতায় সংক্রমিত হয়েছে। শত চেষ্টা করেও তারা এ আবহ থেকে বের হতে পারছে না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের যুগে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীর জনবিরোধী অনৈতিক কর্মকা- নেতিবাচকভাবে কবিতায় অবশ্যই আসতে পারে, তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালের মতো ইউরোপবাহিত টি.এস. এলিয়ট প্রভাবিত নেতিবাচক নগরকেন্দ্রিক আধুনিকতা কবিতায় আর আসা উচিত নয় এবং প্রয়োজন নেই। কবিতায় যদি নেতিবাচকতা আনতে হয় তা অবশ্যই আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিবেশ-প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে হতে হবে। ঔপনিবেশিক কালের নেতিবাচক নগরকেন্দ্রিক আধুনিকতা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমকালীন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মনস্ক বিষয়-আশয় আত্মস্থ করে কবিতা রচনা সময়ের দাবি। এতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে কবিতায় নতুন প্রাণের সঞ্চার এবং সচেতন কাব্যপাঠকের চিন্তার সূচিতে নতুন ভাবনা জাগ্রত হবে। আর যদি তা না হয়, কবিতা প্রথাগত ধারণায় রচিত হবে, যা সমর সেনের কবিতার মতো বোধের স্তরে ক্লান্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করবে এবং সচেতন পাঠক কবিতাপাঠ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাবে। এটা কবিতাকর্মীদের অবশ্যই কাম্য নয়। অতএব, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের যুগে প্রয়োজন নতুন চিন্তার কবিতা। এ প্রেক্ষিতে নতুন বিষয়ের সঙ্গে চিরায়ত বিষয়ের সমন্বিত পাঠের কোন বিকল্প নেই। এ-পাঠ থেকে অন্যরকম কবিতার জন্ম হবে, যা প্রথাগত চিন্তার সম্পূর্ণ বিপরীত এবং আলাদা।

শেয়ার করুন