চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মানুষ ও মুখোশ

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

১৯৯৬ সালের ২৫ শে এপ্রিল। কুমিল্লা জেলায় জন্ম সাদিয়ার। তার দু’দিন পর নাদিয়ার জন্ম। পাশাপাশি বাড়ি দু’জনের। এ বাড়িতে কী রান্না হলো অন্য বাড়িতে তার ঘ্রাণ পৌঁছে যায় নির্বিঘেœ। কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই। দু’জন ভালো বান্ধবী ছোটকাল থেকে। সাদিয়ার বাবা কালাচান। একজন বর্গাচাষী। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন। সহায় সম্পত্তি বলতে তাঁর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ভিটে-মাটি ছাড়া। একটি পুত্র সন্তানের বড় আশা ছিল তার। কিন্তু বিধাতা মুখ ফিরিয়ে থাকায়নি। তাই চার চারটা কন্যা সন্তান জন্ম নিলেও, কাক্সিক্ষত স্বর্ণখচিত ছেলে সন্তানের দেখা মেলেনি। তা বলে তাঁর কোন দুঃখ নেই। আর দশটা জাহেল বাবার মতো মেয়ের মায়ের উপর নির্যাতনের রোলারও সে চালায় না।
তাঁর মা কুলছুমা বেগম। অনেকবার ছেলের কানে মন্ত্রণা ফুঁকেছেন। কাজে আসেনি।

-বাবা সারাজীবন দুঃখ করলি, তোর জীবনখানত কী সুখ নাই! আল্লায় একখান পোলাও দিলো না অন্তত বৃদ্ধ বয়সে কবরত মাটি দিব।
কালাচান আশাবাদি লোক। সে এসবে চিন্তিত নয়।
-পোলা মাইয়্যে এগিন আল্লায় যা দিছে, ভালো দিছে। যাগোরে দেনো হেতারা কী আরতুন কম দুঃখি নি। আর মেয়েরাই আর পোলা।
২০১৬ সাল। জীবনটা পে-ুলামের মতন দুলছে। সাদিয়ার বয়স এখন একুশ ছুঁই ছুঁই। কালাচানও অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছে। আগের মতো কাজকামও করতে পারে না। শরীরটা ভেঙে পড়েছে। সাদিয়ার আফসোস হয়, ইশ! আজ যদি সে ছেলে হতো? কত ভালো হত। বাবাকে অন্তত কিছুটা সাহায্য করতে পারতো। বাবাকে অনেকবার বলেছিল নাদিয়ার সাথে চট্টগ্রাম যাবে। গার্মেন্টসে কাজ করবে। বাবা কিছুতেই রাজি হয় না। সে চায়না তার মেয়ে কামাই করে তাকে খাওয়াক। আর চিলান নাম কুড়াক। লোকজন পেছনে লেগে আছে কেবল দোষ খুঁজতে।

এদিকে মেয়েটার বয়স তো আর দাঁড়িয়ে নেই। টপটপ করে বেড়েই চলছে। কিন্তু বিয়ে-শাদী দেওয়ার নাম বালাই নাই। ছেলের বাজার ভীষণ চড়া। এত টাকা পাবে কয়! একটা ভালো ঘর যাও আসছিল। ছেলে প্রবাসী। নগদ একলাখ টাকা চায়। অনেকের কাছে হাত পেতেও শেষমেষ টাকা জোগাড় না হওয়ায় বিয়েটা সেই যাত্রায় ভেস্তে যায়। সেদিন দুঃখে তাঁর হৃদয়টা ভারি হয়ে যায়। সাদিয়া বুঝতে পারে বাবার দুঃখ। সে সংসারে সবার বড় মেয়ে বলে কথা! অনেক চেষ্টা করে সে একটা চাকুরি যদি পাওয়া যায়। না কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অনেক খুঁজে শেষমেষে সিদ্ধান্ত নিল, নাদিয়া এবার ঈদে বাড়ি এলে তার সাথে সে চট্টগ্রাম চলে যাবে। সেখানে গার্মেন্টসে কাজ করবে। এবার আর কারো বাঁধা মানবে না সে। হলোও তা। দেখতে দেখতে কিছুদিন পর রোজার ঈদ এসে হাজির। এ ঈদে পরিবারের কারো জন্য একটা জামাও কেনা হয়নি। ছোট বোনগুলোর কাতর চেহারা তাকে মর্মাহত করলো ভীষণ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল চাকুরি করে প্রথম মাসের বেতন দিয়ে ওদের জন্য জামা-কাপড় নেবে। ঈদের দিন দরজা বন্ধ করে এক বোনকে জড়িয়ে ধরে আরেক বোন ঘুমিয়ে আছে। সবার হৃদয়ে দুঃখ নামের পিয়ানোর মন ভোলানো সুর বাজছিল নিরন্তর। কালাচান কেবল ছোট বালকের মতো কাঁদছিল। এ কান্নার জলরাশিগুলো নির্মল। বান্ধবীরা কেউ খোঁজ নিলো না সাদিয়ারা কোথায়। পরদিন সেমাই রান্ন্া করে নাদিয়া এলো। সাদিয়া মনের দুঃখ আড়াল করতে। তবে আজ কেন যেন তার চোখ দুটো ফুটো করে শ্রাবণের বড় বড় ফোটার নির্গমন হলো। নাদিয়া বুঝতে পারে বান্ধবীর দুর্দশা। সে বলে,
-এবার যাওয়ার সময় সাদিয়াকে আমার লগে নিয়া যাইমু চাচা। আপনি আর বারণ করলেও আমি শুনমু না।
কালাচান কাঁদে, কথা বলে না।

ঈদের পঞ্চম দিন। নাদিয়ার সাথে ভাগ্য ফিরাতে চট্টগ্রামের পথে যাত্রা করে সাদিয়া।
সাদিয়া চট্টগ্রাম যখন পৌঁছালো রাত তখন ১১টা। ঈদের ছুটি কাটিয়ে সবাই এখনো ফিরেনি বলে নগরী এখনো নিস্তেজ। সাদিয়ার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো এত বড় শহর !!
আগে কখনো দেখেনি সে। এ প্রথম বাড়ি থেকে বের হলো সে। আর কখনো তার সেভাবে যাওয়া হয়নি কোথাও। তবে বাবা-মা আর ছোট বোনগুলোর কথা মনে আসতেই সব আনন্দে জল নেমে এলো। বাসায় ফিরে মাকে ফোন করে। রিসিভ হয়নি। রাত অনেক মা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আর ডিস্টার্ব না করে সেও ঘুমিয়ে পড়ে । সে রাতেই কালাচান না ফেরার দেশে চলে যায়। মরা বাড়িতে লাশ দেখতে এসে এক অসাধু চোরের হাতে মোবাইলটি খোয়া যায়। সাদিয়া এর কিছুই জানে না। পরদিন নাদিয়ার সাথে কাজে যায়। কাগজপত্র সব ঠিকটাক করতে ১২ঃ৪৭ মতো হয়ে গেলো। নাদিয়া ওকে বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিতে বলে। কাল থেকে কাজে জয়েন্ট করবে সে।
কিন্তু এখন বাসায় কার সাথে যাবে। পরিচিত এক বড় বোনের সাথে নাদিয়া তাকে পাঠিয়ে দেয় ঘরে। ওর ফিরতে সন্ধ্যা হবে।
বড় বোনটি অনেক হান্ডসাম। দেখে বড় ঘরের মেয়ে বলে মনে হয়। ভাগ্যের রোষানলে গার্মেন্টসে এসেছে। সাদিয়ার সাথে খুব সহজেই মিশে গেল। ওর পরিবারের সব খোঁজখবর জেনে ওকে বলে আমিও তোমার মতো কষ্টে ছিলাম। কষ্টের পরই সুখ আসে জীবনে। চিন্তা করো না। তুমি গার্মেন্টসে আর কতই বা বেতন পাবে মাসে পাঁচ-ছয় হাজার ! এ দিয়ে জীবন আর কীবা বদলাবে। আমি তোমাকে দিনে পাঁচ-ছয় হাজার কামানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারি যদি তুমি চাও। সাদিয়া তার হাত ধরে পেলে। কৃতজ্ঞতায় নুয়ে যায়। বললো কী করতে হবে বলেন আপা আমি সব করতে রাজি।
-না তেমন কিছু করা লাগবে না। শুধু আমার সাথে থাকলেই চলবে। তবে এ কথা নাদিয়ারে বলা যাবে না। কারণ এ যুগে কারো ভাল কেউ চায় না। সাদিয়া বুঝল কথাটা সত্যি। সে নাদিয়াকে কিছু না বলে বাসা ছেড়ে চলে যায়। এদিকে নাদিয়ার কাছে ফোন আসে কালাচানের মৃত্যুর। সে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে। কিন্তু সাদিয়ার কোন খোঁজ না পেয়ে শংকিত হয়ে পরে। আপুটাকে ফোন করে। তিনি সাদিয়াকে বাসায় নামিয়ে দেওয়ার কথা বলে। তবে কি বাবা মারা যাওয়ার খবর কারো কাছে পেয়ে সাদিয়া বাড়ি চলে গেল!

সাদিয়াকে অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি। কিছুদিন পর নাদিয়ার ফোনে খবর এলো,
-আপনি সাদিয়ার কে হোন? কোতোয়ালি থানায় এসে যোগাযোগ করুন।
গত রাতে কক্সবাজার থেকে বাসে করে ফেরার পথে ১৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ ধরা পড়ে সাদিয়া। তার মুখ থেকে একের পর এক লোমহর্ষক কাহিনী বেরিয়ে আসে।

শেয়ার করুন