চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সমসাময়িক বিপন্নতার প্রতিফলন জিললুর রহমানের কবিতা

শোয়েব নাঈম

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৪০ পূর্বাহ্ণ

“আজ আমি দিবালোকে হ্যারিকেন জ্বালি”- সমসাময়িকতাকে নির্দ্বিধায় জীবন্ত রাখার জন্যই মস্তিষ্কের স্টিমুলাসের বিভাজিত প্রজ্ঞায় কাব্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা কবি জিললুর রহমানের প্রারম্ভিক কবিতার এই লাইনটি নির্মেদ ‘ডায়োজিনিস হারিকেন’ কাব্যগ্রন্থের মূল ফোকাস পয়েন্টের শুধু অভিব্যক্তিই না, অবক্ষয়ের অন্ধকারে নিমজ্জিত এই দেশকে পুনরুজ্জীবিত করতে এই উদ্ধৃতিটিকে বলা যায় উদ্দীপনার একটি তত্ত্বও।
আর্ত মুহূর্তে বিস্ফারিত আত্মার আভাস- এমন চেতনাকে ধারণ করা এই গ্রন্থের কবিতাগুলি ধারাবাহিকভাবে পাঠ করলে একটা পর্যায়ে অনুভূত হয় কবিতার টেক্সট্ও আর শুধুমাত্র কবিতার নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে থাকে নাই, এখানে প্রবেশ করে আছে দর্শন-সমাজ-পরিবার-বিজ্ঞান-ছোটবেলা-আড্ডা-ভ্রমণ-বিভিন্ন সমসাময়িকতা-অর্থাৎ কবিতাগুলি হয়ে উঠেছে ‘ওপেন এন্ডেড’ বা মুক্তমুখী, সেগুলি মুক্ত-সূচনা ও মুক্ত-সমাপ্তি দ্বারা চিহ্নিত, তার কোনো সীমানা নেই-
“সবার উপরে সত্য- সে মানুষ, না ভুললেই হয়”
(সীমানা/ ডায়োজিনিসের হারিকেন)।
কবিতার বোধ জীবনের একটা সাধনা- এই বোধোদয় ঘাসের মতো বিস্তৃত রাইজোম্যাটিক হয়ে আছে অর্থাৎ তার বহু শিকড় বহু জন্মবিন্দুর মতো কবির ভাবনাগুলি বহু অর্থে চারপাশ ঘিরে থাকে, বৃক্ষের মতন ঊর্ধ্বমুখি বিচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া এককেন্দ্রীক না-
“সময় পেরুলে ফসিল তেল-গ্যাসে মূল্যমান বাড়ে
বেদনা বিলাস কথা সকলে বোঝে না
কেউ কেউ বোঝে”
(ঊর্ধ্বমুখী আপেলের দেশে)।
এসব পঙ্ক্তিগুলি বোধের ভেতর কেবল একক বাচনিক অনুরণন সৃষ্টি করে না, ভিন্ন ভিন্নভাবে এসব লাইনকে দেখা যায়, ভিন্ন ভিন্নভাবে এসব চরণগুলি ইন্টারপ্রেট করা যায়।
জিললুরের কবিতার শব্দগুলি কেন এত সূক্ষ্ম পোয়েটিক এবং এতটা অর্থময়, যেকোনো সপ্রাণ বস্তুর মতই শব্দেরও একটা অখ- অর্থ রয়েছে, আবার একটা না-অর্থও রয়েছে, শব্দের ভেতরই আছে শাব্দিক অ্যালকেমি, তা’ খুঁজে নিতে পাঠককে সাবলিলভাবে তিনি প্রবেশাধিকার দিয়েছেন তাঁর মেধার আশ্রয়ে নির্ণিত এই কাব্যগ্রন্থে, যাহা নিবিড়ভাবে পাঠ করলে পোয়েট্রি ল্যাংগুয়েজ ও স্ট্যান্ডার্ড ল্যাংগুয়েজের ভেতর একটা সূক্ষ্ম পোয়েটিক বিভাজন পাঠক ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে।
“কিছু ঢেঁকি ঘরে থেকে যায়; স্বর্গ দেখে না,
এখনও ভানছে ধান,গাইছে শিবের গীত পার দিয়ে।
গ্রামবধূর হল্লায় শীত নামে
উড়ছে ধানের কুরা,
ভাপের পিঠার সাথে নেমে আসে খেজুরের রস।”
( ঢেঁকি / ডায়োজিনিসের হারিকেন)
অপরূপ থিম্যাটিক বীজক্ষেতের ন্যায় এই গ্রন্থে কাব্যধ্বনির সঙ্গে বোধের দ্যোতনায় ৪১টি বিষয়ের সঙ্গে বহুমুখী ব্যাঞ্জনার অভিঘাত আছে। পচলিত কাব্যভাষাকে কবি এই গ্রন্থের কবিতাগুলির মাধ্যমে কাব্যভাষার রদবদল ঘটিয়েছেন, দর্শনের রদবদল ঘটিয়েছেন, পরিবেশনের রদবদল ঘটিয়েছেন, কিন্তু কোনো দুর্বোধ্যতার রসায়ন তৈরি করেননি। কাব্য প্রকরণে আছে একদিকে পচলিত আধুনিকতার নিম্মসীমা ভেঙে ফেলবার একটা ঝোঁক, অপরদিকে তার ঊর্ধ্বসীমাকে লঙ্ঘন করার পবণতাও আছে-
“বিকেলের ম্লান রোদে হাতের রেখায় যে আঁচড় দিলে,
তারপর থেকে আমার তো আর ভাগ্য নেই”
(বিকেলের ম্লান রোদ/ডায়োজিনিসের হারিকেন)
জিললুর রহমানের কবিতা মানেই সমসাময়িক বিপন্নতার প্রতিফলন, অক্ষরবৃত্তের (অধিকাংশ কবিতা) আরও এক কাব্যিক ডেকোরেশন হচ্ছে ‘ডায়োজিনিসের হারিকেন’ কাব্যগ্রন্থটি, এসব কবিতার সরলার্থও হয় না বক্রার্থও হয়না, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ৪১টি কবিতাই যেন সাজানো বাগানের পরপর কাব্যিক স্টপেজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট