চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মৃতিসত্তায় সদ্যপ্রয়াত রিজিয়া রহমান

রনি আহম্মেদ

৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৫৭ পূর্বাহ্ণ

লেখিকা রিজিয়া রহমান ছিলেন নির্জনবাসী, রিজিয়া রহমানের লেখার রং ছিল গাঢ় সবুজ। আমরা পেয়েছিলাম এমন এক শৈশব, যেন ফেলে আশা এক শ্যামল দ্বীপখ-। অনন্ত ছিল বয়স হবার আগের সময়গুলো আর আমরা যে পাড়ায় থাকতাম তা ছিল এক বিশাল মহল, এক রাজপ্রাসাদ। নানা পরিবার ছোট ছোট গলিতে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতো সেই জাদুকরী প্রাসাদে, মেঘের নীল আর তারই নিচে আমরা! মনে পড়ে ইয়ামিনের কথা, বাবু ভাই, সেলিম ভাই, মঙ্গোল দা, কল্লোল ভাই আরও কিছু হৃয়দের নাম। আর তপু ভাই যার মা ছিলেন রিজিয়া আন্টি, যিনি বাংলাদেশের এক সাধক লেখিকা, সময় আর মানুষের গভীরে গিয়ে বাঙালির পরিচয়, যন্ত্রণা, রাজনীতি, সুখ-দুঃখ তুলে ধরেছিলেন তার লেখায়। রিজিয়া রহমানের স্বামী ছিলেন অত্যন্ত মিতবাক, মোটা ফ্রেমের চশমা পরতেন, গভীর কণ্ঠের অধিকারী, নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন। তার উপস্থিতি এতো মৃদু ছিল যে, গভীর বনে অদেখা কোনো বটবৃক্ষের মতো।

প্রায় প্রতিদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি রিজিয়া আন্টির ড্রয়িং রুমে চলে যেতাম। সেই সময়টাতে সকলের দরজা অন্যের জন্য খোলা থাকতো। এখন আমাদের বাস্তবতা অন্য।

আমি প্রতিদিন খুলে রাখা দরজার আমন্ত্রণে নিজেকে খুঁজে পেতাম রিজিয়া আন্টির আলো-ছায়াময় ড্রইংরুমে, সেখানে ছিল নিঃশব্দ জাপানি পুতুল আর সম্ভবত কনফুসিয়াসের অদ্ভুত মূর্তি এবং কিছু ডেকোরেশন পিসের ব্যক্তিগত জীবন। এর বহুকাল পর জাপানের ফুকোওকার একটা পাহাড়ের উপর অনেকটা গোপনে থাকা ঝোপ-ঝাড় দিয়ে ঢাকা এন্টিকস্ দোকান থেকে সে রকমই পুতুল কিনি, সেটা ছিল একটি অরিগামি পুতুল যা এখনো আমাকে আন্টির কথা মনে করিয়ে দেয়।
আর তপু ভাই (উনার একমাত্র সন্তান) তার ঘরে ছিল ব্রুসলির বিখ্যাত ও জনপ্রিয় বড় একটা পোস্টার, হাতে নানচাক্কু ধরা। তখন এটা ঢাকায় অনেকের বাসায় থাকতো। এন্টার দি ড্রাগন এক্সিট দি টাইগার ছবির একটি দৃশ্য। আরো ছিল কিছু রেসিং কার, এক জোড়া বক্সিং গ্লাভস। তপু ভাই ছিলেন পাড়ার ফ্যাশন আইকন। কিছু বছর পর উনি আমেরিকা যান এবং এম. বি. এ করে দেশে ফেরেন।

আমেরিকা থেকে আসার পর দেখা গেলো তার মুখ ভরা বিশাল দাড়ি আর চোখে রে’ব্যান গ্লাস,যা ছিল আমাদের সকলের কাছে ভীষণ অকর্ষণীয়! তপু ভাই অল্প সময়েই ঢাকার কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের আলোচিত অন্যতম চরিত্র হয়ে ওঠেন। আবার হঠাৎ করেই সব ফেলে নিজের বিসনেস শুরু করেন, সে এক আত্মবিশ্বাসী সময়ের কথা।
আমাদের পাড়া ছিল শিল্প-সাহিত্য ও পলিটিক্সের তীর্থস্থান। তৎকালীন আলোচিত মন্ত্রী মশিউর রহমান, ডা. বি চৌধুরী আর সেক্রেটারি, কোম্পানি ডিরেক্টরদের জন্য আমাদের পাড়া ছিল রসদশালা,তার মাঝে আমাদের বাসা ছিল; রক মিউজিক আর ইন্ডিয়ান মিউজিকের সহাবস্থান ছিল আমাদের বাসায়। উপর তলায় বাবু ভাইয়ের (ফুয়াদ নাসের বাবু, ফিড ব্যাক ) প্রাকটিস প্যাড। আর ছোট্ট একটা রুম ড্রাইভার থাকার জন্য, সেখানে সেলিম ভাই ক্ল্যাসিকাল ভঙ্গীর বাঙালি মারমেইড আঁকলেন দেয়াল জুড়ে। ভেসপা নিয়ে আসতো অতি লম্বা এক আগাখানি। সন্ধ্যার পর শুরু হতো ঢাকার বিখ্যাত রক স্টারদের আনাগোনা আর ধুন্ধুমার, ড্রামিং, জ্যামিং আর আমাদের বাসায় চলছে লাইভ ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল অথবা গজল অথবা রাতভর ঠুমরি। কখনও রাত বারোটাই ভুটানের বাবার আগমন। দুইটা পর্যন্ত দাবা খেলা চলছে উনার সঙ্গে আব্বার ! কখনও আবার ঢাকা ক্লাবের ফ্যাশন ক্রাউডের হৈ-হুল্লোড় এসে পড়তো এখানে।
এর মাঝে রিজিয়া আন্টি নিভৃতে লেখে চলেন ‘বং থেকে বাংলা’ অথবা কোনো অনবদ্য ছোট গল্প। রিজিয়া আন্টির একটা গল্প এখনও মাথায় ঘুরে, প্যারিসবাসি এক বাঙালির অদ্ভুত মন, যিনি বিভিন্ন শব্দ দিয়ে মিউজিক বানাতেন, যেমন, লিফ্ট ওঠা-নামা, গাড়ি চলাচল, ফোটা ফোটা পানির শব্দ অথবা মানুষের পায়ের শব্দ–সবই তার কাছে মিউজিক ! বহুকাল পর সে সব শব্দমালা আমি প্যারিসের রাস্তায় শুনতে পেয়েছিলাম।
প্যারিসের আন্ডারগ্রউন্ড মেট্রোর প্লাটফর্মে খোলাচুলে দূর থেকে হেটে আসা ডেনিমের বেলবটম আর কালো শার্ট পরা এক হারানো চেহারার অনিন্দ সুন্দর তরুণী মেয়ে, হাতে আপেল! হাই হিল জুতা, চুল দুই দিকে ভাসছে বাতাসে, অদৃশ্য কোনো সংকেতে, হাতে টকটকে লাল আপেল, যেন জীবিত হয়ে ওঠা একটি পেইন্টিং। হাতের আপেলে কামড় বসানোর খচ-খচ শব্দ মনে করিয়ে দিলো রিজিয়া আন্টির গল্পের কথা। যেন আমার’ই দেখা দৃশ্যগুলো আর অবজারভেশন রূপায়ণ করেছিলেন তিনি!
রিজিয়া রহমানের লেখা অনুসন্ধানী,গভীর কোনো বনভূমিতে হাঁটার মতো এক বিশেষ পথচলা, যেখানে সৌন্দর্য, মৃত্যু, বিপদ, আনন্দ সব একসঙ্গে। যেন কাগজের একটি পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া যাবতীয় সব একত্রে ! আমি প্রতিটি লেখকের ক্ষেত্রে নিদৃষ্ট একটি রঙের সন্ধান পাই, রিজিয়া রহমানের লেখার রং ছিল গাঢ় সবুজ, যেমন রুমির লেখায় আমি তীব্র সাদার সন্ধান পাই। ফরিদউদ্দিন আত্তরের লেখনীর রং জ্বলজ্বলে হলুদ, ইবনে আরাবী (রা.) ছড়িয়েছেন স্বচ্ছ সাদা, মার্কেসের লেখা গাঢ় কমলা, কাফকার লেখা আমার কাছে কালচে নীলের এক রূপধারণ, যাতে সবুজ মেশানো আছে! উম্বের্তো একোর লেখার রং ধূসর হয়ে ধরা দেয়। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা হলুদ আর সবুজ, হুমায়ূন আহমেদের লেখা ইলেকট্রনিক ব্লু এসব আমার শিল্পসত্তার একটি দৃষ্টিভঙ্গি ।

এভাবে সাউন্ড ও মিউজিক এর অবগাহনে সাহিত্যকে দেখার দৃষ্টি তৈরি করা যায় ; এবং এভাবে রিজিয়া রহমানের লেখনীর মূল্যায়ন ও অবলোকন প্রয়োজন রয়েছে কারণ তিনি

একজন সাধক লেখিকা, সাধনার লেখা বুঝতে হলে অনেক স্তরে সুরের মিলন ঘটাতে হয়।
তিনি ফরাসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন , বহু বছর পর আমাদের উত্তরার বাসায় এসে বললেন ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাস তিনি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং সেটা ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হবে। জানি না পরে কি হলো। খোঁজ নেওয়া আমার আয়ত্বে ছিল না। বইটা যখন তিনি লিখছিলেন, তখন সেটা নিয়ে আমার বাবার সঙ্গে আলোচনা করতেন, দ্রাবিড়, আর্য, অতীতের রাষ্ট্রনীতি, এন্ট্রপোলজিক্যাল আসপেক্ট অ্যান্ড ইমপ্যাক্ট এ সব নিয়ে আব্বার সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। আর আম্মা ছিল তার নীরব আত্মার বন্ধু! অনেক সময় বই বের হবার আগে পা-ুলিপি পড়তে দিয়েছেন! মা ছিলেন ভালো পাঠক। তবে শেষ জীবনে মা বেশি আল্লাহর সাধনায় থাকায় তার জ্ঞান অর্জনে বইয়ের প্রয়োজন কমে যায়।
মা ও আন্টির ব্যক্তিত্বে মিল ছিল, দুজনেই ছিলেন দুনিয়ার সম্পদ ও চাকচিক্য বিষয়ে ছিলেন নির্লিপ্ত। রিজিয়া আন্টি গাঢ় নীল শাড়ি পড়তে পছন্দ করতেন, পান খেতেও পছন্দ করতেন। এ সব বলার কারণ হলো তার পছন্দ সম্পর্কে জানবেন তার ভক্তরা এই লেখনীর মাধ্যমে।
আমরা ১৯৮৩ সালে উত্তরা চলে আসলাম, একদিন তপু ভাই আসলেন, পেইন্টিং দেখে মুগ্ধ বললেন একটা পেইন্টিং নেবেন। আর ফ্রি দিতে মানা করলেন কাউকেই, বললেন ১০ টাকা হলেও নিতে হবে। তিনি তার মায়ের মতো লেখালেখির দিকে যাননি কিন্তু, মায়ের সন্তানতো বটেই! তার চরিত্রে স্মার্টনেস, বুদ্ধিদীপ্ততা আর আত্মসম্মানবোধের এক যোগাত্মক মিলন সহজেই চোখে পড়তো। তার মতো ট্রেন্ডি ছেলে সচারচর চোখে পড়েনা। তার সন্তান ও রেগুলার পাঠকরা যেমন অনুপ্রাণিত, তার অনুপ্রেরণা সমস্ত জীবন আমার ভাবনার আকাশেও একটি তারার আলো হয়ে জ্বলবে জীবনের প্রতি ! আমার মনে পড়ে, কালী ও কলম পত্রিকায় আমার ইলাস্ট্রেশন আর শিল্পসমালোচনা রিজিয়া আন্টি খুব পছন্দ করতেন!

একদিন আন্টি উত্তরা আমাদের বাসায় আসলেন তার ছোট্ট লাল গাড়ি সম্ভবত স্টারলেট! আমি তখন নানা বিষয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছি আর্ট, মিউজিক, রাইটিং এসব এক্টিভিটিজ, অধ্যাত্মিকতা নানান দরজা খুলতে শুরু করেছে আমার সামনে! হঠাৎ একটা কবিতা লিখলাম, দুইটা কলাম পাশাপাশি। এর বিশেষত্ব হলো, কবিতাটা পাশাপাশি কলাম ধরে পড়া যায়, আবার স্বাভাবিক পড়ার আচরণে উপর থেকে নিচ ক্রমানুসারে পড়া যায়। বেশ জটিল ব্যাপার ! তিনি দেখে হাসলেন, বেশ মজা পেলেন। লেখালেখির বাইরেও রান্না, কাজের লোক এ সব ঘরোয়া বিষয় নিয়েও আম্মার সাথে উনার কথা হতো, তিনি ছিলেন অভিজাত, শান্ত স্বভাবের মানুষ। লেখালেখির জগৎ আর বাস্তব জগৎ দুটোই শক্ত হাতে সামলেছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তার নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। রক্তের অক্ষর বইটা লেখার জন্য তাকে ইংলিশ রোডে পতিতাদের সাক্ষাৎকার নিতে হতো, তিনি নিরাপত্তার জন্য পুলিশ নিয়ে যেতেন, অনেক গবেষণা করেছেন, পতিতাদের তীব্র আত্মচিৎকার অন্য কোনো বাংলা উপন্যাসে এভাবে উঠে আসেনি, যেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন পশুসুলভ শয়তানের সমাজ নামক শরীরে এক তীব্র আঁচড়!

আমরা এমন এক সময়ে আছি যখন পৃথিবী ধ্বংসের মুখে। এ যাত্রায় যারা আলো দেখাবেন তারা চলে যাচ্ছেন। এই লেখাটি লেখার সময় তার আত্মার উপস্থিতি আমি টের পেলাম, যেন তিনি বললেন- “সুন্দর থাকো, সুন্দরের মধ্যে শান্তি, অপার সমুদ্র।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট