চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রমা ও লাবণ্যে অভীক ওসমান সম্মাননাগ্রন্থ

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু

৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:৫৭ পূর্বাহ্ণ

শঙ্খ নদীর পাড়ের এক নবীন কিশোর তার ছোট ভাইকে নিয়ে ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদী তীরে এই চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন। পরিচয় বলতে কেবল, বরমা গ্রামের জনৈক ফোরখ মাস্টারের সন্তান, ওসমান গণি চৌধুরী। নানান চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে এই ওসমান গণি চৌধুরী হয়ে উঠলেন আজকের ‘অভীক ওসমান’। এই অভীক ওসমানকে নিয়ে সম্মাননা স্মারক প্রকাশ প্রকান্তরে তাঁর পিতা বরমা গ্রামের ফোরখ মাস্টার (মরহুম ফোরখ আহমেদ চৌধুরী ) এবং মাতা মরহুমা মনছুরা খাতুনের প্রতি সম্মাননা।
সেই ষাটের দশক থেকে চট্টগ্রামবাসী হয়ে ওসমান গণি চৌধুরী ধীরে ধীরে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত হয়ে নিজেকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। আজ যখন তাঁকে নিয়ে সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তখন নানাজনের বিশ্লেষণ আমাদের পড়ার সুযোগ হয়। উঠে আসে একজন ‘অভীক ওসমান’ নামের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় সমৃদ্ধ মানুষের সমৃদ্ধ কর্মজীবন।

এই গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে পাঁচটি পর্বে। এক. কবিতার অরণ্যে দুই. গদ্যে ও গবেষণায় তিন. নাটকের মঞ্চ চার. শিক্ষা ও সংস্কৃতি-উন্নয়ন সংগঠন ও রাজনীতি পাঁচ. কথাবার্তা। এছাড়াও আছে অভীক ওসমানের জীবনপঞ্জী, প্রকাশিত বইসমূহ, আলোকচিত্রে অভীক ওসমান।
অধ্যাপক মাহফুজ পারভেজ কবি অভীক ওসমানকে দেখেছেন এভাবে, ‘বিষয় ভাবনায় অভীক ওসমানের কবিতা জীবনেরই গল্প তৈরি করেছে। এইসব রাজনীতির, প্রেমের, অতীতের গল্প কতখানি সত্যি আর কতখানি কল্পনা, সেটা প্রশ্ন হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় না এবং মহাসমারোহে আবির্ভূত হয় তাঁর আপাদমস্তক কবি সত্তা।’
“আমি মিথ্যে রাখাল বালক বলবো বাঘ বাঘ। বলবো ভালোবাসা ভালোবাসা।” (ভালোবাসার বিরহকাল) (স্মৃতি পুরাণের কবি অভীক ওসমান, পৃঃ ১৮)
চিন্তক, গবেষক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন, “ অভীক ওসমানের দুই কবিতার বই ‘বিষাদের জার্নাল ও তোমার জন্যে এই অরণ্যে’ তাহারই বঙ্গীয় একবানা। গোবওে না, গদ্যের বরে পদ্যফুল।” (পরিচায়িকা, পৃঃ১৩)
এমনই এক কবি সত্তার মাঝে আরেক কবি হাফিজ রশিদ খান লিখছেন, “ আধুনিক কবিতা আধুনিক মানুষের যে-সব ক্ষয়, বিবময়, নগরযন্ত্রণা ও কার্বন-মনোঅক্সাইডযুক্ত ধারণা ও বাস্তবতাকে ধারণ কওে নীলকণ্ঠ হয়ে কাতরায়, তবু জীবনের সরোবর থেকে তুলে নিতে চায় জীবনরস-অভীক ওসমানের কবিতাসমূহ সে-বারতা বহন করে। গ্রামজীবনে তার শৈশব, বিশেষ করে কৈশোরের অনেক স্মৃতিতাড়িত পর্ব কবিসত্তাকে আচ্ছন্ন করেছে কোনো কোনো কবিতায়। আসলে, প্রকৃতবোধের কাছে তার আচরিত জীবনের কোনো অভিজ্ঞতা, কোনো স্মৃতিই মুছে যাওয়ার নয়।” (বিষাদের জার্নাল, পৃঃ ২০)

একজন আবৃত্তিকার হিসেবেও অভীক ওসমানের সুখ্যাতি রয়েছে। এটা হয়তো অনেকে জানেন। আবার অনেকের কাছে অজানা। এই দিকটিই তুলে ধরেছেন ঝরণা খানম তাঁর ‘ব্যতিক্রমী এক বৈশাখী-সন্ধ্যা এবং কবিতায় অভীক ওসমান’ (পৃঃ ২৪) শীর্ষক প্রবন্ধে। এক কবিতা সন্ধ্যার বর্ণনা করেছেন এভাবে, সন্ধ্যার সেই আলো আঁধারিতে ‘বিষাদের জার্ণাল-২’ থেকে মোহাবিষ্ট কবিকণ্ঠে ঝরে পড়ে- “একটি বালক/দুঃখী বালক/একলা দুপুর/একা থাকা/একলা থাকা’। মুগ্ধ স্রােতারা দেখেন আর দেখতেই থাকেন কবিতায় বিষাদের জল টলমল। ”
এভাবেই মূর্ত হয়ে ওঠেন কবি অভীক ওসমান আমাদের কাছে। আবার অধ্যাপক শেখর দস্তিদারের কাছে কবি অভীক ওসমান এমন, “ গ্রামীণ চেতনাকে বুকের মধ্যে ধারণ করা সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বিভোর বলেও তাঁর যৌবনের সন্ধিক্ষণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় নারীর মায়াবী স্পর্শ: উদ্ভ্রান্ত কবি নারীর লাবণ্য আর মমতায় সমর্পিত।” (বিশদ বাংলায় অভীক ওসমানের কবিতাসন্ধ্যা : প্রাসঙ্গিক ভাবনা, পৃঃ ৩২)
ম.সাইফুল আলম চৌধুরী লিখেছেন, “ গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কবি ও নাট্যকার অভীক ওসমানের এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর তারিখে অভীক ওসমান রচিত ‘রাত ফেরার’ নাটকটি প্রথম মঞ্চয়ান করে। এই নাটকের মূল প্রতিবাদ্য বিয়ষ হচ্ছে- আমাদেও সমাজ থেকে দুঃশাসনের রাত চিরতওে ফেরার হয়ে সুখ সাম্যের সোনালি সকাল আসবেই।” অভীক ওসমান রচিত নাটক ‘অবশেষে জেনারেল’ স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। এই প্রসঙ্গে ম. সাইফুল লিখেছেন, “শহরের প্রতিটি উল্লেখ্য জায়গায়, জনসভায়, শহিদ মিনাওে ‘অবরেশষে জেনালে’ প্রদর্শিত হয়েছে। এই নাটক দেখার পর স্বতঃস্ফূর্ত জনতা সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ” ( অভীক ওসমান কমিটেড নাট্যকার, পৃঃ ১০২) একজন নাট্যকারের স্বীকৃতি যখন মেলে দেশপ্রেমী জনগণের কাছ থেকেই। মূর্ত হয়ে ওঠে নাট্যকার অভীক ওসমানের আরেক ক্যারিশমাটিক রূপ।

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ^াসী অভীক ওসমান সম্পর্কে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা কালাম চৌধুরী লিখেছেন, “সতীর্থ অভীক ওসমান দক্ষি চট্টগ্রাম জনপদের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বরমা বরকলের ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা, মুদিন্নাপুকুর, আবদুল্লাহ মার মসজিদ, চাঁদখালীর বুক-শ্খং পাড়ের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানি মাওলানা ইসলামাবাদী, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র-যাত্রামোহন সেন, ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমকে তার কবিতার ছন্দে এভাবে তুলে এনেছেন। সে চাঁদখালী আর শঙ্খের আঁসুর শোককে শক্তিতে পরিণত করার আহ্বান জানিয়ে একটি গর্বিত জনপদের কথা তুলে এনেছেন।…সতীর্থ অভীক ওসমান সংগ্রামী জনপদের সন্তান হিসেবে সকল গৌরবের অংশীদার হবে।” (একটি সংগ্রামী জনপদের সন্তান অভীক ওসমান, পৃঃ১১২)

পরিশেষে বলতে হয়, বিভিন্ন জনের লেখায় উঠে এসেছে ব্যক্তি অভীক ওসমানের নানামুখী প্রতিভার কথা। সংগ্রামের কথা। যাপিত জীবনের কথা। এই সম্মাননা গ্রন্থ একজন মানুষের কাজের অনন্য স্বীকৃতি। তবুও একজন তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। আজকের এই অবস্থান তো একদিনে হয়নি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় হয়েছে অভীক ওসমান স্বয়ং বলেছেন এক সাক্ষাৎকারে, “নিখিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে আমাকে অনেকে ডিফেইম করতে চেয়েছে। তেমনকোনো সার্পোট, প্রমোশন, প্রটেকশন পাইনি।কখনো কখনো মানুষের বিশ^াসঘাতকতা আমাকে বেদনার্ত করে তুলেছে। ফিনিক্স পাখির মতো বারবার উঠে দাঁড়াতে হয়েছে। বাট আই এম হ্যাপি।”
এমন একটি সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশের জন্য শুভ কামনা জানাই সম্পাদকদ্বয় নাজিমুদ্দীন শ্যামল এবং মনিরুল মনিরকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট