চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

অভিমত এজাজ ইউসুফীর কবিতায় বহু রৈখিকতার অর্থ-দ্যোতানা

শোয়েব নাঈম

২৯ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

এজাজ ইউসুফী’র কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নাদ্য মাদুলি’ গ্রন্থ থেকে স্তবকের পর স্তবক উদাহরণ সাজিয়ে এই কবির কাব্য-মনস্কতা আবিষ্কার করা বেশ দুরূহ, তৎসত্ত্বেত্ত বইটি সম্পূর্ণ গভীর নিবিড়তায় পাঠ করলে কবিকে খুঁজে পাওয়া অধিকতর অকঠোর মাধ্যম মনে হয়। এজাজ ইউসুফী’র কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো কবিতাকে কেন্দ্রমুখী যুক্তি থেকে ভাবনাকে মুক্তি দেওয়া, কাব্যিক যুক্তির সংযোগ এড়িয়ে পরামর্শকে সংগত ভেবে বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা, আবেগের উত্তাপ কমিয়ে কবিতার আরম্ভ ও সমাপ্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে স্তবকের মাঝখানকে প্রেরণা দেওয়া, আগের লাইন থেকে পরের লাইনের ধারাবাহিকহীনতার সংকট তৈরি করে দুই লাইনের মধ্যবর্তিতে তৃতীয় ধারার বহুরৈখিকতার অর্থ সৃষ্টি করা ।

তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের কবিতা পাঠ করলে যেখানে উপলব্ধি করা যায় তাঁদের পঙ্ক্তিগুলি আচ্ছন্ন থাকে যুক্তির প্রাধান্য, অঙ্কের মতন যুক্তির ধাপে-ধাপে এগোতে এগোতে কবিতার নির্গমন পথ তৈরি করার স্বয়ংসম্পূর্ণতার কৌশল, সেখানে ‘স্বপ্নাদ্য মাদুলি’-এর কবি এজাজ ইউসুফী এক দর্শনের প্রভাব বিস্তার করে তার অন্তর্দ্বন্দ্বের ‘চিতা কাঠে’ বিনির্মাণ করেন কাব্যসাহিত্যে ‘জগৎ নিরঞ্জন’ এর ‘যৌগপদ্য’। প্রচলিত কবিতায় বেশকিছু উপকরণকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার জন্যই তিনি এই কাব্যগ্রন্থটিকে সেসব পঙ্ক্তির অবতারণা করেছেন।
তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য কবিরা তাঁদের কবিতার শিরোনাম দিয়ে কাব্যের বিষয়কেন্দ্র চিহ্নিত করেন, কবিতার বিষয়ই হচ্ছে তাঁদের রচনার কেন্দ্র, একক মালিকানায় এসব কবিরাই হয়েছেন তাঁদের কবিতার টাইটেল হোল্ডার। ‘স্বপ্নাদ্য মাদুলি’-এর কবি এজাজ ইউসুফী তার কবিতার শিরোনামকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন, কবিতাগুলি পাঠকালে এই ধারণায় প্রকোপ হয় কবিতায় শিরোনামটি জরুরি নয়, তিনি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন যে পাঠকই হবে তাঁর কবিতার টাইটেল হোল্ডার।

তিনি প্রতিটি কবিতাকে দীর্ঘকারে বিস্তৃত করে অর্থের গভীরতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কাব্য-মানের ধারণাকে মিথ চরিত্রের মিশ্রণে, মরমিবাদের দার্শনিক ইঙ্গিতে প্রতিটি স্তবকের অর্থকে প্রসারিত করেছেন, প্রচলিত ধারণাকে অস্বীকার করে ভবিষ্যৎ পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার।

তিনি তাঁর সময়কেই প্রগতি হিসেবে গণ্য করেছেন, একরৈখিকতাকে বর্জন করে এর বিপরীতে বহুরৈখিকতার সূত্রপাত করে প্লুরালিজম বা বহুত্ববাদের ধারণা দিয়ে (মিথ, লৌকিকতা, মাজার-চর্চা, অতীন্দ্রিয়তা, প্রণয়ঘটিত ব্যাপার) তাঁর কবিতায় বিনির্মাণের গতিময়তা দিয়েছেন। একরৈখিক ধারণায় মনে করা হতো কবিরা এক একজন বিশেষজ্ঞ, বহুরৈখিকতার কবি এজাজ ইউসুফী এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বলেছেন কবিত্ব হচ্ছে হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য ।
সমগ্র গ্রন্থটি পাঠ-উত্তর অনুধাবন করলে একটি অর্থপূর্ণতাই অনুরণন হয় পাঠকের কাছে, তাহা হচ্ছে পাঠককে আরও চিন্তা চালিয়ে যাবার প্রেরণা দেওয়া। কবি বলেছেন যে,
“রৌদ্রাহত, লোকায়ত, শব্দকায়া নিয়ে
নীল আসমান জপে আল্লা’র কোমল সুর।
মনোহর অঙ্গ জ্বলে, পুড়ে হিয়া, নাদান বান্দার
জন্মমৃত্যু কীর্তনীয়া সুরের বিন্যাস ।
বাসি ফুলে মধু খুঁজে ফিরে রাজ্যেশ্বর
ভুল ধরি নাই অঙ্গ তোমার,
আমিও কি হেরি নাই নাগরিক ব্যথা?
তবে, কে অবিরাম ঘরেতে ঠুকছো জীবনমৃদঙ্গের তাল ?”-
(জীবনমৃদঙ্গের তাল)।

এই মর্মার্থ চিন্তাকে সমাজিক স্তরে ছড়িয়ে দিতে কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নাদ্য মাদুলি’ নামকরণে কবি নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকিও, তাঁর রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে, তাঁর প্রজন্মের এই কৌম-মূল্যবোধকে গ্রন্থাবদ্ধ করে প্রকাশ করেছেন সকল কবি-পাঠকদের জন্য ‘উত্তর-আধুনিকতা’ আধুনিক উপযোগিতার সাথে সাবেকী চিন্তার এক কোলাজ চিন্তার পদ্ধতিগত মতবাদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট