চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রক্তের নদী পেরিয়ে

মীর নাজমিন

২২ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৩৭ পূর্বাহ্ণ

সময়টা ১৯৭১ সালের জুনের মাঝামাঝি। অঝোরে শ্রাবণ ঝরছে বাইরে। পাকিস্তানি মিলিটারিদের বাংলোয় বসে আছে ফাহিম। তার ঠিক সামনেই একটা টেবিলের উপর গ্লাস ভর্তি গরুর দুধ, আর কয়েকটা কোয়ার্টার প্লেটে পাউরুটি, কলা, আপেলসহ আরো অনেক মজাদার খাবার থরে থরে সাজানো।

চোখের সামনে এত্তোসব মজাদার খাবার দেখে নয় বছরের ছোট্ট ফাহিমের জিবে পানি আসার মতো অবস্থা। আসবে নাই বা কেনো? এত্তোগুলো মজাদার খাবার একসাথে চোখে দেখা তো দূরের কথা, আজ প্রায় তিন মাস হতে চললো ঠিকমতো পেট পুরে ভাতটা পর্যন্ত খেতে পারছে না ফাহিম। ফাহিমের বাবা ফারুক মিয়া সামান্য একজন ফেরিওয়ালা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের কাছে লেইচ ফিতা ফেরি করে বেড়ায়। তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকমে ফাহিমসহ তাদের তিনজনের সংসারের নুনভাতটুকু জুটে যায় ঠিক। মাঝে মধ্যে একমাত্র সন্তান ফাহিমকে ভালোমন্দও কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করে ফাহিমের বাবা। আয় যতোই কম হোক, বাবাই তো। টাকা না থাকলেও তাই ছেলের প্রতি বুকে ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না তার। তাইতো তার নিজের আর্থিক অনটন আর একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একের অধিক সন্তান পর্যন্ত নেয়নি ফাহিমের বাবা-মা। মোটামুটি এক প্রকার ভালোই চলছিলো তাদের সংসারটা। কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে যায় তারা। ২৬ মার্চ সকালে ঘুম থেকে উঠে ফাহিমের বাবা ফাহিমের মাকে বলে, দেশে যুদ্ধ লাগছে ফাহিমের মা। কিছু খেতে দাও তাড়াতাড়ি। মিটিং আছে ঐ পাড়ায়। নাস্তা খেয়ে, আসি বলে সেই যে বের হয়েছিলো ফাহিমের বাবা, আজ অবধি ফিরে আসেনি আর। কারো কাছে কোন খোঁজ পর্যন্ত মিলছে না তার। এদিকে ছোট্ট ফাহিমকে নিয়ে দুর্দশার শেষ নেই তার মায়ের। ঘরে চাল ডাল যা ছিলো তা দিয়ে কোনমতে দিন কয়েক গেলেও তারপর থেকেই চুলায় আগুন জ্বালানো দায় হয়ে পড়েছে। ফাহিমের মা না হয় পেটে পাথর বেঁধে হলেও ক্ষিধের জ্বালা সহ্য করবে। কিন্তু ছোট্ট ফাহিম! সে তো আর বুঝতে পারছে না তাদের ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়ে এখনো ফিরে আসেনি। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে এঘর ওঘর থেকে ধার দেনা করে আরো ক’দিন চালালেও এভাবে আর কতো পারা যায়? যুদ্ধের কারণে দেশে যে আকাল শুরু হয়েছে ভিক্ষা পর্যন্ত মিলছে না অবস্থা। ফাহিমের মা বেচারিও নিরুপায় হয়ে হাত-পা ছেড়ে সকাল থেকেই বসে আছে। কি করবে? কোত্থেকে একটু খাবার তুলে দেবে কলিজার টুকরা ছেলের মুখে?

এদিকে আজকেও সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলেই ফাহিম তার মাকে ডাকছিলো। ও মা, খুব ক্ষিধে পেয়েছে তো। কিছু খেতে দাওনা মা। রাতেও তো কিছুই খাইনি। মায়ের কোন সাড়াই পাচ্ছে না ফাহিম। বিছানা ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ঘরের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বসে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে তার মা। তাতেই ফাহিম বুঝে গেছে, এ বেলায়ও কিছু জুটবে না তার পেটে।

তাই মাকে আর বিরক্ত না করে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ফাহিম। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে একটা খালে নেমে হাত মুখ ধুয়ে দুহাতে আজলা ভরে জল পান করছিলো সে। খালের পাড় দিয়ে হেটে যেতেই কাদের চাচা ফাহিমকে দেখে বলে, ফাহিম ব্যাটা, আজকেও কিছু খাসনি বুঝি? ইশ্ রে! মুখখানা কেমন শুকিয়ে আছে তোর। আর কতোদিন এভাবে না খেয়ে থাকবি রে? চল্ ব্যাটা, আমার সাথেই চল্। আজকে তোকে আমি অনেক মজার মজার খাবার খাওয়াবো। অনেকদিন মনে থাকবে তোর। চল্ যাই। খাবারের কথা শুনে আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই কাদের চাচার পিছু নেয় সে। এই কাদের চাচার সাথেই ফাহিম মিলিটারিদের বাংলোয় এসেছে আজকে। হাত বাড়িয়ে যেই দুধের গ্লাসটা নিতে যাচ্ছিলো, অমনি একজন খপ্ করে ধরে ফেলে ফাহিমের হাত। শোন্, এই সবগুলো খাবারই তোর জন্য। সবটাই খাবি তুই। কিন্তু তোকে একটা কাজ করতে হবে। যদি করিস তাহলে প্রতিদিন তুই এমন মজার মজার খাবার খেতে পারবি। কি কাজ বলুন? আমার খুবই ক্ষিধে পেয়েছে। কাল রাত থেকে পেটে দানাপানি কিছুই পড়েনি। আচ্ছা, এই গ্রামের সবগুলো বাড়ি তুই চিনিস? ও মা, চিনবো না কেন? আমি তো বাবার সাথে প্রতিদিনই বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম। বাহ বেশ! তাহলে গ্রামের সবকটা বাড়ি ঘুরে ঘুরে কোন ঘরে সুন্দরী যুবতী আছে তা জানাতে পারবি আমাদের? পারবো তো। কিন্তু যুবতী মানে কী? আমি তো সেটা বুঝি না। যুবতী মানে হলো সুন্দরী, লম্বা, ফর্সা, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়ে মানুষ যাদের এখনো বিয়ে হয়নি। এবার বুঝলি তো? জ্বী, বুঝেছি। এখন বল্, পারবি তো খবর দিতে? অবশ্যই পারবো। এটা তো খুবই সোজা কাজ। পারবো না কেন? এসব খেয়ে এবার তাহলে কাজে নেমে পড়। যতোবার এই খবর নিয়ে আসবি, ততোবারই এমন মজাদার খাবার খেতে পারবি তুই। টেবিলের উপর রাখা সবগুলো খাবার একনাগাড়ে সাবাড় করে আপন মনে গুনগুন করতে করতে বাংলো থেকে বের হয়ে যায় ফাহিম। তার ছোট্ট মাথায় একবারও প্রশ্ন জাগেনি, কেন মিলিটারিদের এই খবর দরকার? যুবতী মেয়ে দিয়ে তারা কিই বা করবে? সে কি কোন অপরাধ করছে? এতোটুকুন ছেলের কোন কিছু বুঝে উঠাটাও সম্ভব নয়। শুধু খাবার পেয়েই সে খুশি। তারপর থেকে সে সারাদিন গ্রামে ঘুরে ঘুরে কোন ঘরে যুবতী আছে তার খবর নিয়ে আসে বাংলোয়। আর পেট পুরে খেয়ে মনের সুখে হেলেদুলে বাড়ির দিকে চলে যায়। যুবতীদের ধরে এনে বাংলোয় যে কি নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠে মানুষরূপী এই জানোয়ারগুলো, তার ছিটেফোঁটা খবরও জানে না ছোট্ট ফাহিম। তার শুধু উদর জ্বালা মেটাতে পারলেই চলে।

প্রতিদিনের মতো আজকেও মিলিটারির বাংলোয় এসেছে ফাহিম। চারপাশটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে আজ। আশেপাশে কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না সে। প্রতিদিন অনেক মিলিটারিকেই চোখে পড়ে আশেপাশে। আজকে কাউকেই না। তবুও ভেতরে ঢুকলো ফাহিম। শুধুমাত্র বড় স্যার ছাড়া বাকীরা সবাই অপারেশনে বের হয়ে গেছে। বড় স্যারের শরীর খারাপ তাই তিনি যেতে পারেননি। বাংলোয় সবচেয়ে বড় অফিসারকে ফাহিম বড় স্যার বলেই ডাকে। ফাহিম দেখলো বড় স্যারের রুমের এককোণায় ডাবের কিছু খোল আর ধারালো একটা দা পড়ে আছে। নিশ্চয় বড় স্যারের অসুখ করেছে। ফাহিমকে দেখেই অফিসার শোয়া থেকে উঠে বসে। আসছিস তুই? জ্বী স্যার। কিন্তু গ্রামে আর কোন মেয়েই বাকী নেই। তাই নতুন কোন মেয়ের খোঁজ আনতে পারিনি আজকে। চোখ বন্ধ করে দু’এক মিনিট ভেবেই বড় স্যার বলে, ফাহিম এদিকে এসে আমার পাশে বস্। আচ্ছা ফাহিম, তোর মা আছে? মায়ের কথা তো কোনদিন জিজ্ঞেসও করিনি তোকে। জ্বী স্যার, আছে। তোর বাবা কোথায় রে? বাবা? সবাই বলে বাবা নাকি দেশের জন্য যুদ্ধে গেছে। আচ্ছা, তোর মা দেখতে কেমন রে ফাহিম? ছোট্ট ফাহিম তখনো জানে না, কেন তার মায়ের কথা জানতে চায় তার বড় স্যার। অনেকটা গর্ব করেই তাই ফাহিম বলে, সারা গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী মহিলাটাই আমার মা। জানেন স্যার, আমার মা যখন হাসে, ডান গালে খুব সুন্দর একটা টোল পড়ে।

তখন দেখে মনে হয়, অন্ধকারে ঝলঝল করে যেনো পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলছে! এতোটাই সুন্দর আমার মা। মাকে আমি অনেক ভালোবাসি, স্যার। ফাহিম, তোর মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে। কত্তো মিষ্টি একটা ছেলে তুই, কত্তো ভালো! না জানি কত্তো ভালো তোর মা। মাকে একবার নিয়ে আসতে পারবি এখানে? আমি জানি না স্যার, মা আসবে কিনা। কিন্তু খুব ক্ষিধে পেয়েছে আমার। আজকে কি কিছু খেতে দেবেন না আমায়? নিশ্চয় দেব? কেনো নয়? তবে তার আগে তোর মাকে একবার নিয়ে আয় এখানে। আর শোন্, আমার কথা বলিস না যেনো। অন্যকিছু বলে নিয়ে আসবি। ঠিক আছে, স্যার।
ঘণ্টাখানেক পরেই মাকে নিয়ে বাংলোয় ঢুকে ফাহিম। একি খোকা, এ কোথায় নিয়ে এলি তুই আমাকে? তুই না বলেছিলি, কার সাথে দেখা করাবি? ততোক্ষণে বড় স্যার খপ করে ফাহিমের মায়ের হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ফাহিম, টেবিলে নাস্তা রাখা আছে। খেয়ে নিস। নাস্তা খেয়ে পেটটা শান্তি করে বের হয়ে যাচ্ছিলো ফাহিম। কিন্তু কি মনে করে আবার হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সে। ভেতরের দিকে পা দিতেই মায়ের গলায় তীব্র আর্তনাদ শুনতে পায় ফাহিম, “কে আছো বাঁচাও, কে আছো বাঁচাও, এ তুই কি করলি খোকা। শয়তানদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে না বুঝে এতো সর্বনাশ করে ফেল্লি?” মায়ের এই কথাগুলো শুনেই সাত পাঁচ না ভেবে এক দৌড়ে বড় স্যারের রূমে ঢুকে পড়ে সে। দেখে তার মা বিছানায় গড়াগড়ি করে হাত দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। আর তার উপরে বড় স্যার তার মায়ের আঁচল ধরে টেনে মাকে বিবস্ত্র করার চেষ্টায় রত। মাকে এ অবস্থায় দেখে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে কিশোর ফাহিমের বুকের ভেতর। রাগে তার চোখ দুটো রক্তজবার মতো লাল হয়ে যায়। কি করবে সে বুঝতে না পেরে ডানে বামে তাকাতেই ডাব কাটার ধারালো দা টা চোখে পড়ে তার। দা’টা হাতে নিয়ে এক সেকেন্ডও দেরি না করে সেই ধারালো দা দিয়ে খপ করে এক কোপ বসিয়ে দেয় অফিসারের ঘাড়ে। অফিসার উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো কয়েক কোপ বসিয়ে দেয় তার ঘাড়ে। গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে বিছানার একপাশে লুটিয়ে পড়ে বড় স্যার। ততোক্ষণে মা উঠে কাপড়চোপড় ঠিক করে নেয়। চোখের সামনে ফাহিম দেখতে পায়, জবেহ করা গরুর মতো গরগর শব্দ করে করে ছটফট করছে অফিসার। আর তার শরীর থেকে স্রোতের মতো রক্ত ঝরছে। অবিরল রক্তের লালচে ধারায় ভেসে যাচ্ছে পুরো বাংলো। মায়ের হাত ধরে সেই রক্তের নদী পার হয়েই ফাহিম চলছে তার আপন আলয়ে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট