চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সিদ্দিক আহমেদ স্মারক গ্রন্থ

জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু

১৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

“আমি সবাইকে দেখি। চেরাগি পাহাড় দেখি। চেরাগি পাহাড়ে মানুষের ভিড় দেখি। ভিড়ের মধ্যে আমি আমাকে দেখি। আড্ডায় আমাকে দেখি। চায়ের দোকানে আমাকে দেখি। …… দেখো, দেখো, সিদ্দিক আহমেদ মারা গেছে। তাকে তো গতকালও চেরাগি পাহাড়ে তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখেছি। সে মারা গেল কবে?” সম্প্রতি প্রকাশিত ‘সিদ্দিক আহমেদ স্মারকগ্রন্থ’-এ আমরা তাঁর এই অপ্রকাশিত লেখাটিতে নিজেকে নিয়ে এমন দৃশ্য সিদ্দিক আহমেদ এমনভাবেই লিখেছিলেন ‘যাই চলে যাই’ শিরোনামে এক নিবন্ধে। মৃত্যু পরবর্তী এমন দৃশ্য তিনি আগেই লিখে গেছেন।
সিদ্দিক আহমেদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী মুহম্মদ নুরুল আবসার। নিবিড়ভাবে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সঙ্গী ছিলেন। সিদ্দিক আহমেদের জীবিতকালেই নুরুল আবসার প্রকাশ করেছিলেন ‘সিদ্দিক আহমেদ সম্মাননা স্মারক গ্রন্থ’ (২০১৪)। এবার প্রকাশ করেছেন ১২১ জনের লেখায় সমৃদ্ধ ‘সিদ্দিক আহমেদ স্মারক গ্রন্থ’।

‘সিদ্দিক আহমেদ চট্টগ্রামের সকল শ্রেণির কাছে জনপ্রিয়। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তাঁকে ঘিরে রাখতো তরুণেরা। তিনিও বয়সের সীমারেখা ভেঙেচুরে বন্ধুর মতো তাঁদের সাথে মিশে যেতেন অবলীলায়। আমাদের কালে এই শহরে মেরুদ- সোজা রাখা সর্বদা তারুণ্যে ভরপুর যে ক’জন মানুষ ছিলেন বা আছেন সিদ্দিক আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। যারা তাঁর ¯িœগ্ধ সান্নিধ্যে এসেছেন তারা নিবিড়ভাবে অনুভব করেছেন সিদ্দিক আহমেদ-এর মহানুভবতা, উদারতা ও সাবলীলতা। তিনি স্পৃহ এক দ্রষ্টার মতো স্বচ্ছন্দে ঢুকে যেতেন একেক জনের গহীনে।’ এমনভাবেই দেখেছেন তাঁর দীর্ঘদিনের সাথী নুরুল আবসার। তাঁর এই উপলব্ধি মিথ্যে নয়। এই গ্রন্থে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন নবীন-প্রবীণ সকলেই। সুতরাং, একজন মানুষ কতোটা জনপ্রিয় ছিলেন, তা বোঝা যায় সহজেই।
ড. অনুপম সেন লিখেছেন, ‘তিনি কত বিচিত্র বিষয় যে পড়তেন, তা দেখে আমি অবাক হয়েছি। কোনো ভালো লেখা পড়লে তিনি তা অনেককে জানাতে চাইতেন। সেজন্য তাঁর অনেক তরুণ ভক্ত-অনুরাগী ছিল, যারা প্রায়ই তাঁকে ঘিরে রাখত। কবিতার আনন্দ, সাহিত্যের আনন্দ তিনি কেবল নিজে নিজে ভোগ করতেন না, সে আনন্দের ভোগে তিনি অন্যকেও সঙ্গী করতেন।’ এইখানেই তো সিদ্দিক আহমেদের বিশালত্ব। জ্ঞানের রস তিনি নিজের কাছে রাখেননি। সকলের মাঝে দিয়েছেন।

ড. মনিরুজ্জামান লিখেছেন ‘স্থানিকতা, আঞ্চলিকতা ও চট্টগ্রামের একজন সিদ্দিক আহমেদের সিদ্ধি’ নামে এক পর্যবেক্ষণমূলক প্রবন্ধ। একজন মানুষকে নিয়ে এমন গভীর লেখা সাম্প্রতিককালে কেউ লিকেছেন কিনা সন্দেহ। তিনি সিদ্দিক আহমেদের প্রতিটি কর্মকা-কে বিশ্লেষণ করেছেন। এই জ্ঞানগর্ভ রচনা পাঠে নতুন করে সিদ্দিক আহমেদ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে হবে। ড. মনিরুজ্জামান বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন রেখেছেন, “অন্তরাল প্রিয় সিদ্দিক আহমেদ তুমি কে? বাংলা সমালোচনা সাহিত্য তোমার জন্য কি অপেক্ষায় আছে? তুমি কি কেন্দ্র নামক কোনো অদৃশ্য ক্ষেত্রের, নাকি স্থানিক, দূরস্থ, বা আঞ্চলিক? তোমার গ্রহণীয়তা ‘কোন আলোতে’?
কবি ময়ুখ চৌধুরী লিখেছেন, “যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিক্রি হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, সেই সমাজে, নিঃস্বতার গৌরবে উদ্দীপ্ত একজন মানুষকে সম্মান জানানো দরকার। জানি, সম্মাননার সম্মান রক্ষা করার জন্য বেশি লোক পাওয়া যাবে না। তাই বলে একবারে পাওয়া যাবে না, তা তো নয়। ঐ তো লোকটা-পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন বলে বেশি দূর যায়নি- আর দেরি করলে তিনি সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যাবেন”। না, সিদ্দিক আহমেদ ভীড়ে মিশে যাননি।

ড. মহীবুল আজিজের বিশ্লেষণ, “সিদ্দিক আহমেদের গদ্য পড়ে এটা স্পষ্ট বোঝা যাবে যে মূলত তিনি কবিতার পাঠক। কেননা, তাঁর গদ্যে কবিতা-সূত্রই মূলত ব্যবহৃত। কবিতার আশ^াস ও অঙ্গীকারকে তিনি উষরতার অমল আদ্রতারূপেই দেখেন। একথা সত্য, কবিতার উৎসারণ কবির পবিত্র আত্মার গহিন খাঁজ থেকে। সেই পবিত্রতা ও সেই অকৃত্রিমতার পূজারী সিদ্দিক আহমেদ। হয়তো নিজের জীবনকেও তিনি সযতেœ রক্ষা করেছেন একটি মূল্যবান কবিতার মতন।’
ড. মাহবুবুল হক সিদ্দিক আহমেদকে আবিষ্কার করেছেন অন্য একরূপে। তিনি লিখেছেন, “সিদ্দিক আহমেদ মনোজগতে জীবনপিপাসু এক রোমান্টিক মানুষ। জীবনের খোলা জানালায় চোখ রেখে জগতের সুন্দরকে তিনি আকণ্ঠ পান করতে চান। তাঁর মন জুড়ে আছে সর্ববন্ধনমুক্ত লেখক-জীবনের অসামান্য পিপাসা। এমন পিপাসার্ত মানুষ এখন আমরা কই পাবো।”

সাংবাদিকতায় সিদ্দিক আহমেদের কাজ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ড. ওবায়দুল করিম লিখেছেন, “সিদ্দিক ভাই মিডিয়ার অগ্রগমন ও তার সামাজিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি বেশ ভালোই জানতেন। একদিকে সামাজিক স্বার্থে প্যাটেন্ট আইনের সংহতকরণ ও অন্যদিকে মিডিয়া কর্তৃক কপিরাইট ভাঙ্গার এই কাল সিদ্দিক ভাইকে বিচলিত করত।”
কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস তাঁর ‘জলপুত্র’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সংলাপ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, তখন সিদ্দিক আহমেদই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “জলপুত্রে’র চরিত্রগুলোর ডায়ালগ অবশ্যই চাটগাঁইয়া ভাষায় লিখবেন। এই আমার পরামর্শ। উপদেশও বলতে পারেন।” এরপরের কাহিনী এমন, হরিশংকরের ‘জলপুত্র’ অষ্টম মুদ্রণ এখন বাজারে। পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে । সুতরাং, সিদ্দিক আহমেদের সেই মূল্যবান উপদেশ বা পরামর্শ একজন কথাসাহিত্যিককে কতোটা ঋদ্ধ করেছে।

সিদ্দিক আহমেদেও দীর্ঘদিনের সাথী এডভোকেট বিপ্লব বিজয় বিশ^াস। তিনি লিখেছেন, “বিষয় নির্বাচন এবং নির্বাচিত বিষয়কে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর অবয়ব দান করার বুদ্ধিমত্তায় সকলকে বিমোহিত করার কলাবিদ্যায় পারদর্শী এই চঞ্চল সাহিত্যকে খ্যাতির দিকে দ্রুত টেনে নিয়ে গেছে। অথচ তাতেও তাঁর এতটুকু উচ্ছাস ছিল না। নির্মোহ সত্তায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের ঈড়সসরঃসবহঃ রক্ষায় উচ্চকণ্ঠ ছিলেন।”
সিদ্দিক আহমেদের সান্নিধ্যে এসেছেন বিভিন্ন বয়সী পেশার মানুষ। সুতরাং, তাঁকে দেখেছেন সকলে যে যার অবস্থান থেকে। এটাও কিন্তু আজকের সমাজে বিরল। যেখানে আমরা কেবল একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যেই চলতে অভ্যস্ত। ব্যতিক্রম কেবল তিনি। পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও মোহাম্মদ মহসীন, পিপিএম লিখেছেন, “আপনি আমাদের ছাড়লেও আমরা কিন্তু আপনাকে ছাড়িনি স্যার। এখনো চেরাগির মোড়ে তুমুল আড্ডায়, সুকঠিন আলোচনায় উদাহরণ হিসেবে আপনি ধরা দেন।”

চেরাগির আড্ডার আরেকজন শাহরিয়ার পারভেজ। সিদ্দিক আহমেদের বর্তমান শূন্যতাকে অনুভব করে লিখেছেন, “তাঁর শূন্যতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি সিদ্দিক ভাই আজাদী থেকে নেমে আমাদেও সাথে আড্ডায় যোগ দেবেন। জমিয়ে তুলবেন সান্ধ্য অড্ডা। স্মৃতি কাতরতায় কুয়াশা আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারপাশ।”
সিদ্দিক আহমেদ এমন একজন মানুষ, সকলের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয়মুখ। ‘সিদ্দিক আহমেদ স্মারক গ্রন্থ’-এ আমরা তেমন ছোঁয়া পাই। যা আমাদের অন্তরকে আজো একজন সিদ্দিক আহমেদের জন্য পীড়িত করে। আন্দোলিত করে। ব্যথিত করে। যাঁরা সিদ্দিক প্রিয় আছেন, তাঁদের জন্য এই বইটি সংগ্রহে রাখা একান্ত প্রয়োজন, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে একজন সিদ্দিক আহমেদকে উপস্থাপনের জন্য।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট