চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

মোর মনরে আমার

শেফায়েত কামাল

১৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

যে মেয়েটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার বয়স মাত্র পনের, লাউ গাছের লতার মতো তার শরীরের তরতর করে বেড়ে ওঠা। দু’হাতের মুঠোয় ঘন চুলের গোছাটি নিয়ে বিনুনি পাকাচ্ছিলো। মেয়েটির নাম ‘তিতলি’। তিতলি নামটা তার মায়েরই দেওয়া। এ মুহূর্তে তার মেজাজটা ভালো নয়। তার মেজাজটা যে খারাপ মা তার পেছনে দাঁড়িয়ে কোমরে শাড়ির কুঁচিটা গুঁজতে গুঁজতে আয়নায় মেয়ের মুখটা দেখে আঁচ করতে পারলো।
‘কিরে! মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব মেজাজ করে আছিস?’

‘ঠিক ধরেছো মা, খুব মেজাজ হচ্ছে।’
‘কেন, কোচিং-এ যেতে ইচ্ছে না হলে যাবিনে!’
তিতলি ঘুরে দাঁড়ালো ‘মা, মেজাজ করেছি তোমার ঐ ড্রেসিং টেবিলটার উপর। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। জানো মা টুশিদের আয়নাটা কেমন ঝক্ঝকে, বাপীকে বলো এবার যেন ঠিক ঠিক একটা ড্রেসিং টেবিল কিনে আনে।’
ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা পাউডারের কৌটা থেকে খানিকটা পাউডার ঘাড়ে, গলায় বুলোতে বুলোতে তরুর কণ্ঠে উষ্মা ঝরে পড়ে। ‘তাইতো মা, সেই কত পুরনো দিনের ড্রেসিং টেবিল, এগুলো কি আজকাল চলে!’

তরুর চোখে হাল ফ্যাশনের ব্যয়বহুল সেগুন কাঠের তৈরি চক্চকে ড্রেসিং টেবিলটা ভেসে উঠলো। কী ঝক্ঝকে আয়না। তার বড্ড পছন্দের ড্রেসিং টেবিল ছিল। ড্রয়ারের হেন্ডেলগুলো ছিল চমৎকার। পুরো ড্রেসিং টেবিল জুড়ে বিরাট আয়না। তাও আবার বেলজিয়ামের, স্ফোটিকের মতো স্বচ্ছ। শিহাবের দীর্ঘায়তন শরীরটা অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারতো। ঐ ড্রেসিং টেবিল নিয়ে বাসর রাতের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ঠিক জায়গায় বসানো হয়নি বলে তরু হাসতে হাসতে বাসর রাতেই শিহাবের গালে বিরাট একটা চিমটি কেটে বলেছিলো-‘একেবারে হানড্রেট পার্সেন্ট বুদ্ধু। আরে বুদ্ধু, এইভাবে কি কেউ ড্রেসিং টেবিল বসায়!’ শিহাবের ঠোঁটে মুচকি হাসি, চোখে চমক লাগানো দৃষ্টি। তরুর মুখটা তুলে ধরে বল্লে-‘প্রথম রাতেই এমন একটা বিশেষণে ভূষিত করে ফেল্লে!’ পরের দিন তরু নিজেই সরিয়ে নিয়ে তার পছন্দ মতো-জায়গায় বসিয়েছিলো। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কত হাসাহাসি।
স্মৃতির ভেতর থেকে ফিরে এলো তরু। মেয়ের চুলবাঁধা শেষ বইখাতা ব্যাগে ভরতে ভরতে তিতলি আবারও প্রসঙ্গটা তুললে ‘আয়নাটা এতই ঝাপসা হয়ে গেছে মা কিছুই দেখা যায় না।’

‘ঠিক আছে, আজই তোর বাপীকে রাজী করাতে পারি কিনা দেখি।’
তরু জানে এ মানুষটাকে রাজি করানো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। নিজের মর্জি মতো চলে। দু’জনে কোনও একটা সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বয়সটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তরুর চাইতে জোনায়েদ চৌধুরীর বয়সটা যেমন অনেক দূরে এগিয়ে আছে, বুদ্ধি বিবেচনাটাও সমতালে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে আছে। তবে তরুর সখ মেটাতে কোনও দিন কার্পণ্য করেনি। তিতলির শোবার ঘর থেকে বেরোতেই তরু চৌকাঠে হোঁচট খেলো। মনে মনে রাগ ধরে গেলো নিজের উপর। দীর্ঘ ষোল বছরে এখনও এ বাড়ির ইট-পাথরের সাথে সে খাপ-খাইয়ে নিতে পারেনি। কেমন অচেনাই রয়ে গেছে।
নিজের শোবার ঘরে ঢুকেই আড়চোখে জোনায়েদ চৌধুরীকে দেখে নিলো। চুমকির সাথে কথা বলছেন। এটা বাবা মেয়ের একটা আলাদা জগৎ। কথা বলতে বলতে জোনায়েদ চৌধুরী এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাঁকে দেখলে মনেই হবে এই মুহূর্তে মোবাইলে তিনি মেয়ের মুখটা দেখতে পাচ্ছেন। জোনায়েদ চৌধুরী মাঝে মাঝে হো হো করে হেসে উঠছেন। নিশ্চয়ই চুমকি তার এক বছর বয়সী মেয়ের কা-কারখানা তার বাবার কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করছে। মা মেয়ের পদচারণায় তিনি ঘাড় ফেরালেন। কথা শেষ করে তিনি ফোনটা রেখে টেবিলের উপর রাখা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে স্বগোতক্তি করে উঠলেন-‘এ্যাই যাঃ ‘চা’ টা একেবারে ঠা-া হয়ে গেলো।’ ‘বুয়াকে বলি আর এক কাপ চা না হয় বানিয়ে দিক।’ তরু যেতে উদ্যত হতেই জোনায়েদ চৌধুরী বাধা দিলেন-‘দরকার নেই, তিতলির কোচিং এর দেরি হয়ে যাবে, ঠিক বলেছি না মা?’ তিনি তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ‘একেবারে ঠিক বলেছো বাপী’। তিতলির মুখে দুষ্টু হাসি। ‘চল্ চল্’ বলে তিনি মেয়ের হাতটা ধরে বিরাট লোহার গেটটা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলেন। তরুর দিকে তাকিয়ে বল্লেন, ‘তুমি যাচ্ছ যখন একেবারে তিতলিকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসো।’ তরু অবাক করা একটা হাসি ছুঁড়ে দিলো-‘আরে আমিতো তাই ভাবছিলাম।’
রিকশা পেতে একটু বেগ পেতে হলো। রিকশা পাওয়া গেলেও প্রতিটা রিকশার অবস্থা জোনায়েদ চৌধুরী এক নজরে দেখে নেন। শুধু রিকশা নয় রিকশাওয়ালাটাকেও তার পছন্দের মধ্যে রাখেন। অবশেষে পাওয়া গেল। রিকশা ছেড়ে দিতেই তিনি সাবধান করে দিলেন, ‘এ্যাই দেখে শুনে চালাবি।’ হাতের মোবাইল ফোনে তিনি রিকশার নাম্বারটা তুলে রাখলেন। মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে তরু এই সময়টুকু কোথায় কাটাবে ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো তার কিছু কেনাকাটার দরকার ছিল। তিতলির জন্য মিমি সুপার মার্কেট থেকে খানকয়েক সালোয়ার কামিজের কাপড় কিনলে মন্দ হতো না। বেশ আপন মনে কাপড় দেখছিলো। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তার দুটো চোখ চেপে ধরলো-‘এ্যাই বলতো আমি কে?’ হাতটা ছেড়ে দিতেই তরু ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ‘মুনা তুই? কোথা থেকে, তুইতো ঠিক আগের মতই আছিস। একটুও বদলাসনি’! ‘আর তুই? তোর খবর কী’?
‘কেন? শুনিসনাই বুঝি, আমার আর শিহাবের মধ্যে যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে!’
‘শুনেছি তবে’-

মুনা শিহাবের ফুফাতো বোন। শ^শুরবাড়িতে কেউ যদি অতি আপনজন ছিল সে এক ননদিনি মুনা। শিহাবের সাথে তরুর পালিয়ে আসা থেকে শুরু করে শ^শুরবাড়িতে উঠিয়ে নেওয়া সবকিছুতে ছিল মুনার বিরাট এক ভূমিকা। কথা বলতে বলতে সেই পুরনো স্মৃতিতে ফিরে গেলো দু’জনে। কত সুখস্মৃতি, কত আনন্দের মুহূর্ত। ভালোবাসার ছোঁয়ায় শিহাব ও তরুর দাম্পত্য জীবন মুনার খুব কাছে থেকে দেখা।
‘আচ্ছা তুই নাকি হঠাৎ করে চলে এসেছিস!’
তরুর মুখটা বিষণœতায় ভরা-‘সন্দেহ, বুঝেছিস, সন্দেহ আমাদের দাম্পত্য জীবনে ঢুকে পড়েছিলো। বিশ^াসের বড়ই অভাব ছিল।’
তরু, ‘তোর সন্দেহটা ছিল ভুল। শুনেছি, কেনা কে কি বলেছে অমনি তুই তার উপর ভিত্তি করে এমন একটা বাজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিস?’
‘শোন যার উপর বর্তে সেই বোঝে, যখন ওকে ছেড়ে আসছিলাম মনে হয়েছিলো ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘ও কি তোকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলো?’
‘ধুর, ও ডিভোর্স লেটারটা পাঠিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলো।’ বলেছিলো ‘তোমাকে আমি এখনও ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই তোমাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি। মাতৃত্বের স্বাদ থেকে তুমি বঞ্চিত ছিলে বলে ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে আমি আটকাতে চাইনি। তুমি আর কাউকে বিয়ে করে মাতৃত্বের স্বাদ পেলে আমি সুখী হবো।’

মুনার কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো- ‘শিহাব সত্যিই মহৎ।’
‘মহৎ না ছাই।’ আমিতো ভেবেছিলাম সাধ্যসাধনা করে আমাকে নিয়ে যাবে, ‘উল্টো ডিভোর্স লেটার’।
‘যাক এখন, শিহাবের কথা মনে পড়ে?’
‘নাহ্, একদম মনে পড়ে না।’ বলেই তরু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। এই ছোট্ট শহরে পথেঘাটে কত মানুষের দেখা মেলে কিন্তু একবারও সে শিহাবের দেখা পাইনি। মানুষটা কি রাস্তাঘাটে বের হয় না। ঘবি গধৎশবঃ-এ একবার এমন একজন মানুষের দেখা মিলেছিলো যে কিনা দেখতে একেবারে শিহাবের মতো। কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই দেখে ও শিহাব না।
‘এ্যাই তরু, কিরে মুখ ওদিকে ফিরিয়ে নিয়েছিস কেন, নে আরও একটা সমুছা নে’ বলে তরুর দিকে তাকাতেই দেখলো তরুর চোখ দিয়ে দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

‘আরে বোকা মেয়ে কাঁদছিস্ কেন? ও তোর জন্য কাঁদে? নে চোখ মোছ, কাঁদিসনে’ বলে মুনা একটা টিস্যু পেপার এগিয়ে দিল। তরু এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো-‘আমি যে ওকে এখনও ভালোবাসি। আমার অবুঝ মনের ভালোবাসা, পাগলের মতো ওকে ভালোবেসেছিলাম ও এতটুকু পরিমাণ কার্পণ্য করেনি আমাকে ভালোবাসা দিতে। এখনও ভাবি কোথা থেকে কী হয়ে গেলো!’
‘বাদ্ দে, তুই এখন সুখে আছিসতো?’
‘বুঝেছিস মুনা, সুখের অনেক রকম প্রকারভেদ আছে। পুরোপুরি সুখী যেমন মানুষ হতে পারে না, তেমনি পুরোপুরি অসুখীও মানুষ হতে পারে না। সুখ নানাভাবে মানুষের কাছে আসে, যে যেভাবে নিজেকে সুখী মনে করতে পারে সেটাইতো সুখ।’
‘মানছি, তোর কথা।’
‘তোর কথার উত্তর দেবো না! একজন আমাকে বুকভরা ভালোবাসা দিয়েছিলো। আর একজন দিয়েছে আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ। সেখানেই আমার সুখটা নিহিত ছিল। সে একজন ভালো মানুষ, নিঃসন্তান একজন নারীর বুভুক্ষু মনের হাহাকার তাকে সচেতন তুলেছিলো।’
‘চল্ চল্ উঠি এবার, তোর মেয়েকে তুলতে হবে না!’
‘হ্যাঁ, যোগাযোগ রাখিস’ বলে উঠে দাঁড়ালো তরু।

তিতলিকে নিয়ে রিকশায় উঠে বসতেই পুরনো স্মৃতিগুলো এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মনে মনে ভাবলো মুনার সাথে দেখা না হলেই ভালো ছিল। এখন যে অতীতের দিকে মনটা ধাবিত হচ্ছে।
জোনায়েদ চৌধুরী পত্রিকা পড়ছিলেন। তিতলিকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই তিনি মজার একটা সংবাদ দিলেন। ‘তরু জানো একটু আগে কে টেলিফোন করেছিলো?’
‘কেন, কে?’

যে মানুষটি খুব কম হাসেন, সে মানুষটি যদি হঠাৎই দন্ত-বিকশিত করে হো হো করে হেসে ওঠেন তখন তাঁর মুখম-লটা চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। এই মুহূর্তে তরুর কাছে জোনায়েদ চৌধুরীকে অসম্ভব ভালো লাগার একজন মানুষ বলে মনে হলো। জোনায়েদ চৌধুরী ঠোঁটজোড়ায় মিষ্টি হাসিটা ধরা বল্লেন-‘মনে আছে আমাদের বিয়ের পর পর আমার এক বন্ধু এসেছিলো জার্মানী থেকে। সে আবার সস্ত্রীক আসছে জার্মানী থেকে, থাকবে আমাদের এখানে।’
‘ওমা তাই নাকি ভালোই হবে। উনি খুব আলাপী।’
‘শুধু তাই নয় ওরা একটা প্রোগ্রামও দাঁড় করিয়েছে। দুইটা দিন কোথাও কাটিয়ে আসবে।’
‘কোথায়?’
‘সেন্টমার্টিন।’
তরুর চোখ ছল্ছল্ করে উঠলো। মানুষটা খুব ভালো মনের মানুষ। শুধু আনন্দ দিতে জানে। এমন মানুষকে কী কেউ ছেড়ে যায়। সবই আল্লাহর ইচ্ছে। তা না হলে চল্লিশ বছর উত্তীর্ণ হতেই সংসারের মায়াজাল ছিহ্ন করে কেন বা রুহী পরপারে চলে গেলো। বিপত্মীক জেনায়েদ চৌধুরীর সংসারের হাল তাকেই বা ধরতে হলো কেন? কোথা থেকে কী হয়ে গেলো!
সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে সূর্য ডোবা দেখছিলো তরু। অস্তগামী সূর্যের শেষ রাগটুকু দেখা সে কখনও মিস্ করতে চায় না।
‘ভাবী বাদাম খান।’ খোসা থেকে বাদাম ছাড়িয়ে তরুর হাতে দিতে দিতে রিনি আফসোসের সুরে বল্লে-‘জানো ভাবী বিদেশে এই দৃশ্যটা খুব মিস্ করি।’
‘ভাই কই? দু’জনকেতো দেখছি না। তিতলিটাও গেলো কই!’ তরুর চোখে মুখে চিন্তার আভাস।
‘কই থাকবে, জোনায়েদ ভাইকে নিয়ে ছবি তুলছে, ওর ঐ এক অভ্যাস যেখানে যাবে ক্যামেরাটা সঙ্গে থাকবেই।’
‘ভালোইত।’

‘আরে, আপনি দেখছি একেবারে রুহী ভাবীর মত করে বল্লেন!’
‘তাই নাকি, কেমন ছিলেন ভাবীটা?’
‘খুব মজার মানুষ ছিলেন, গানের গলাটা ছিল চমৎকার।’
তরুর মনে নতুন একটা প্রশ্ন জাগ্রত হলো সে আদৌ কি রুহীর জায়গাটা নিতে পেরেছে। তিতলি ছুটতে ছুটতে এলো-‘আম্মু, বাপী অনেকগুলো কাঁকড়া ধরেছে।’
‘বুঝেছেন ভাবী, আপনার ভাইয়ের এই এক বিচিত্র সখ।’ তরুর ঠোঁটজোড়ায় হাসি ছড়িয়ে পড়লো।
চট্টগ্রামে ফিরে এসে অতিথিরা বিদায় নিলো। খাবারের পাট চুকিয়ে অলস দুপুরে তরু চেয়ার নিয়ে ঝুল-বারান্দায় বসেছিলো। সাথে বিরাট একটা উপন্যাস। উপন্যাসের চরিত্রগুলো ঔপন্যাসিক খুব সুন্দরভাবে সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। তরুর মনে হলো মানুষের চরিত্রের চড়ংংরঃরাব ংরফব-টা বের করে আনা হলো গল্প লেখক বা ঔপন্যাসিকের প্রধান কৃতিত্ব। গাছ-গাছালি থেকে ঠা- ফুরফুরে বাতাস ভেসে আসছে। সেই বাতাসের আমেজে তরুর ঘুম পেয়ে গেলো। পাশেই মোবাইল ফোনটা বেজে চলেছে। মোবাইলের রিংটা কানে বাজতেই তরুর হালকা ঘুমটা ভেঙে গেলো। মোবাইটা হাতে নিয়ে দেখলো মুনার টেলিফোন।
‘কী মুনা কেমন আছিস?’
‘ভালো। তোরা।’

‘আমরা ভালোই আছি। গতকালই সেন্টমার্টিন ঘুরে এলাম।’
মুনা মুহূর্তখানেক অপেক্ষা করলো। সে কি বলবে কি বলবে না খানিকটা ইতস্তত করে বল্ল-‘শোন তোকে একটা জরুরি খবর দিতে টেলিফোন করেছি, জানিনে তুই কী ভাবে নিবি।’
‘আরে ভণিতা রাখ্, কী বলবি চট্পট বল।’ তরুর ভ্রুরুতে ভাঁজ পড়লো।
‘শিহাবের হঠাৎ ইমাজেন্সি হয়েছে, খবর পেয়েছি।’
তরুর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। কান্নাটা দলা পাকিয়ে কণ্ঠানালিটা ছিঁড়ে ফেলছে।
পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বল্ল-‘কী হয়েছিলো ওর?’
‘আরে, কাউকে কিছুই বলেনি, যখন অবস্থা খারাপের দিকে তখনই ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি, এখানকার ডাক্তাররা বলেছে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে।’
‘এতটা খারাপ অবস্থা?’ তরু ডুকরে কেঁদে উঠলো। শিহাব বরাবরই ডাক্তারের কাছে যেতে অনীহা প্রকাশ করতো। তরু জোর করে নিয়ে যেতো।
‘তরু, আমার মনে হয় তুই একবার দেখে গেলে ভালো হতো।’
‘মুনা, তুই আমাকে যেতে বলেছিস্, আমি কি যাবো?’ তরুর চোখে মুখে চিন্তার রেখা।
‘আমি থাকবো, তুই একটিবার দেখে যা। আজকের খধংঃ ঋষরমযঃ-এ ঢাকা ছাড়বে।’
তরুর জন্য এ এক সংকটময় পরিস্থিতি। যাবে কি যাবে না। শিহাবের কাছে ছুটে যাবার তাগিদ অনুভব করছে। এই মানুষটার সাথে তার দীর্ঘদিনের সংসার। এত সহজে তাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। শুধু একটিবার শিহাবকে দেখা চায়। চট্জলদি তরু তৈরি হয়ে নিলো।
‘তরু তুমি কোথায় যাচ্ছ, সাথে তিতলিকে নিয়ে যাও!’ জোনায়েদ চৌধুরীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।
‘চিন্তা করো না, আমি যাবো আর আসবো’। এই প্রথম স্বামীর কাছে সত্য কথাটা আড়াল করলো। জোনায়েদ চৌধুরী কাশতে কাশতে কিছুটা কফ বেরিয়ে এলো। তরুকে তিনি রিকশায় তুলে দিয়ে ফিরে এলেন। কিছুদিন যাবৎ ঠা-ায় তাঁর গলার ব্যথাটা আবার শুরু হয়ে গেছে। হয়তো সমুদ্রের বাতাসে এমনটি হয়েছে বলে মনে হয় তাঁর।
রিকশা চলতে চলতে তরুর পুরনো স্মৃতিগুলি এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এমন কি পরিস্থিতি হয়েছিলো শিহাবকে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিলো। মা বলেছিলেন ধৈর্য্যরে অভাব। আসলে কী তাই। হয়তো মায়ের কথাই ঠিক। আজ এত বছর পর শিহাবকে দেখার জন্য তার মন উতলা হয়ে উঠেছে। এটা কী তার সযতনে জমিয়ে রাখা ভালোবাসার টানে? শিহাবতো এক সময় তার জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলো। ভুলতে চাইলে কী ভোলা যায়। এই যে তার পাগলের মতো ছুটেচলা এটাইতো ভালোবাসা। আবোল-তাবোল অনেক ভাবনা মনের মধ্যে জটপাকিয়ে তুলছে। কাজটি কি তার ভালো হচ্ছে। কোন পরিচয়ে সে শিহাবের সামনে দাঁড়াবে! শিহাবের কাছে তার পরিচয় একেবারে নগণ্য। জেনায়েদ চৌধুরীর কথা মনে পড়লো। তাঁর বউ হয়ে তার এত বেশী স্পর্ধা থাকা উচিত নয়। তাঁকে বল্লে কি রাজী হতো! হয়তো হতো না। আবোল-তাবোল অনেক কিছু তার মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠলো। মনের ভেতর থেকে কে যেন প্রশ্ন করলো-
‘তরু তুমি কোথায় যাচ্ছ, তুমি না জোনায়েদ চৌধুরীর বউ!’ বিবেক বাধা হয়ে দাঁড়ালো। সত্যিতো কাজটা কি ভালো যাচ্ছে। যে তাকে ডিভোর্স দিয়েছে তার কাছে কেন তার ছুঁয়ে যাওয়া। ধর্মের বিধিনিষেধ আছে না! তদুপরী আছে অতি দায়িত্ববান স্বামীর পরম মমত্ববোধ, ভালোবাসা। যে মানুষটি তাকে মাতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে তার সম্মান কেন সে ধুলায় লুণ্ঠিত করবে!
‘এ্যাই রিকশাওয়ালা দাঁড়াও।’ তরুর উচ্চকণ্ঠের চিৎকারে যেন আশপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। রিকশাওয়ালা প্যাডেল থেকে পা তুলে তরুর দিকে ফিরে তাকালো-‘খালাম্মা, এখনও ম্যালা দূর।’
‘রিকশা ঘুরাও।’

‘কেন, যাইবেন না হসপিটালে রোগী দেখতে?’
‘তোকে বলছি রিকশা ঘুরাতে!’ ‘মানুষটার জন্য এতক্ষণ কাঁদলেন, এখন যাইবেন না কেন খালাম্মা?’
রিকশা ফিরতে ফিরতে জনাকীর্ণ রাস্তায় এসে পড়লো। বিরাট জ্যাম। আসার পথেও একই জ্যাম ছিল। দু’পাশে সারি সারি সব ঔষধের দোকান। তরু রিকশা থেকে নেমে তার পরিচিত দোকান থেকে কিছু ঔষধ-পত্তর কিনে নিলো। বেচারার সাংঘাতিক কাশি হয়েছে। বাসায় পৌঁছে ঔষধটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে যেন আর কোনদিন সিগারেট না খায়। জোনায়েদ চৌধুরীর জন্য তার মনটা ভিজে উঠলো। বাসায় ঢুকেই ঔষধটা তার হাতে দিয়ে কড়াভাবে হুকুম করলো ‘আজ থেকে সিগারেট খাওয়া বন্ধ।’ এই প্রথম তরু স্বামীকে কড়া হুকুম দিল।
ফোনটা বেজে উঠলো। মুনার টেলিফোন ‘তুই আসছিস্ না?’ তরু মোবাইল অফ করে দিলো। মনের মধ্যে প্রচ- ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একটাই মন, চতুর্দিকে প্রবাহিত। মন নিয়ে কত খেলা চলছে। তরু ছাদে এসে দাঁড়ালো। আকাশে দু’একটি তারা ফুটে উঠেছে। অসীম আকাশ, সীমাহীন যন্ত্রণা নিয়ে তরু তাকিয়ে আছে সেই আকাশের দিকে। কতগুলো ফ্লাইট উঠছে আর নামছে। তার একটিতে হয়তো শিহাবের যাত্রা। ৭টা বাজতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বুক ভেদ করে গভীর একটা দীর্ঘশ^াস বেড়িয়ে এলো। খোদার কাছে মিনতি জানালো- ‘আল্লাহ্ তুমি শিহাবকে ভালো করে দাও।’
রাত গভীর হতে গভীরতর। জেনায়েদ চৌধুরীর ঘুম গভীর হয়ে আসছে। তরু বিছানা থেকে নেমে পড়লো। পা টিপে টিপে তিতলির ঘরে এলো। তিতলি গভীর ঘুমে। মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্র। বড়ই ঘটনা বহুল। সবকিছু ¯্রষ্টার নিয়ন্ত্রণে।
ঈউ-টা বের করে নিলো। উঠউ প্লেয়ারে গান বেজে উঠলো-
খেলছি এ বিশ^লয়ে বিরাট শিশু আনমনে
প্রলয়দসৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে
খেলিছ

শূন্যে মহা আকাশে
তুমি মগ্ন লীলাবিলাসে
ভাংগিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে
নিরজনে প্রভু নিরজনে’
সুরের মূর্ছনায় তিতলির ঘুম ভেঙে গেলো, দেখে, মা বিছনার উপর উপুড় করে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মা কে-তো এভাবে কোন দিনও কাঁদতে দেখেনি। তার তর সইলো না। জোর করে মায়ের মুখটা তুলে ধরলো। তার চোখে অবাক দৃষ্টি, ‘মা’ তুমি কাঁদছো কেন? কী হয়েছে মা?’ কী উত্তর দেবে তরু! প্রচ- শক্তিতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো- ‘মারে মন কেন কান্দে!’

শেয়ার করুন