চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

অভিনব গল্পকার জগদীশ গুপ্ত

তুহিন তালুকদার

৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:১৩ পূর্বাহ্ণ

বিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে যে বিস্ময়কর আধুনিকতার সূচনা, তার বড় কৃতিত্ব কল্লোল পত্রিকার (প্রতিষ্ঠা ১৯২৩, কলকাতা)। পরে উত্তরা, প্রগতি, কালিকলম, পূর্বাশা অনেক পত্রিকাই কল্লোলের অনুসরণে আধুনিক সাহিত্য সৃজনের পৃষ্ঠপোষক হয়। সাহিত্যের এই নবতর উদ্বোধন কল্লোল যুগ নামে পরিচিত। বিশ ও ত্রিশের দশকের প্রতিভাধর কবি ও কথাসাহিত্যিকদের আবির্ভাব এই সাহিত্য আন্দোলনেরই ফসল। এ যুগের সূচনাকালে বাংলা সাহিত্য ছিল রবীন্দ্র প্রভাবে পরিকীর্ণ। একদল সৃষ্টিশীল তরুণ পাশ্চাত্য আধুনিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং রবীন্দ্র-ধারার বাইরে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র ও মৃত্তিকা সংলগ্ন সাহিত্যরূপ দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তাঁরা কেবল উচ্চতর জীবনের গল্পই শোনান নি, শুনিয়েছেন জীবনের ক্লেদ-গ্লানি, লোভ, অসহায়ত্ব, জিঘাংসা এবং রুখে দাঁড়ানোর কথা। ফ্রয়েড এবং মার্কসের দর্শন তাঁদের প্রভাবিত করেছিল দারুণভাবে। চেয়েছিলেন। তাঁরা কেবল উচ্চতর জীবনের গল্পই শোনান নি, শুনিয়েছেন জীবনের ক্লেদ-গ্লানি, লোভ, অসহায়ত্ব, জিঘাংসা এবং রুখে দাঁড়ানোর কথা। ফ্রয়েড এবং মার্কসের দর্শন তাঁদের প্রভাবিত করেছিল দারুণভাবে।

কল্লোল যুগের প্রায় অপরিচিত কিন্তু অনন্য কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭)। তিনি কল্লোল কালের হলেও কখনোই কল্লোলীয় সাহিত্য আন্দোলনের মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত হন নি। এমনকি কখনো কল্লোলের অফিসেও যান নি, কেবল তাঁর লেখা পাঠিয়েছেন। কয়েকজন প্রকাশক ছাড়া অন্যদের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল না। প্রচারের বাইরে থেকে নিভৃতে, নির্জনে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। কিন্তু এমনই অভিনবত্ব তিনি নিয়ে এসেছিলেন যে, সমকাল এবং উত্তরকাল কেউই তাঁকে সাদরে গ্রহণ করতে পারে নি। কেবল বোদ্ধা সাহিত্যিক মহলে তাঁর অটুট গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি আধুনিক কথাসাহিত্যের নির্মাতা বা প্রথম আধুনিক গল্পকার। রবীন্দ্রনাথ-প্রভাতকুমার-শরৎচন্দ্রের সাহিত্য বলয়ের বাইরে গিয়ে তিনি অদৃষ্টপূর্ব এক সাহিত্য জগত নির্মাণ করেছেন। মোটামুটিভাবে ১৯২৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাঁর কথকতার কাল। সাহিত্য সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,

জগদীশ গুপ্ত কল্লোলের কালবর্তী এবং সঙ্গে সঙ্গে একথাও সত্য যে কল্লোলের যা মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত ছিল তা একমাত্র জগদীশ গুপ্তের রচনাতেই অভিব্যক্ত।
জগদীশ গুপ্তের পরিবারের আদিনিবাস বর্তমান বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলায়। পিতা কৈলাশচন্দ্র গুপ্ত, মাতা সৌদামিনী দেবী এবং স্ত্রী চারুবালা গুপ্তা। পিতার কার্যোপলক্ষে তাঁরা কুষ্টিয়ায় বাস করতেন। কৈলাশ গুপ্ত ছিলেন কুষ্টিয়া আদালতের নামকরা আইনজীবী এবং বিখ্যাত ঠাকুর এস্টেটের আইন উপদেষ্টা। তাঁদের আত্মীয়কুলে অনেকেই আইনজীবী ছিলেন। জগদীশ গুপ্তের পরিবারের সাথে কয়েকজন সাহিত্যিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁর মা সৌদামিনী দেবী নিবিষ্ট সাহিত্য পাঠক ছিলেন। বঙ্কিম, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, রমেশচন্দ্রের রচনার সাথে তাঁর পরিচয় ছিল, যা জগদীশ গুপ্তকে সাহিত্যিক হয়ে উঠতে প্রাণিত করেছিল।

জগদীশ গুপ্তের শৈশব অভিজ্ঞতা অনেক বিচিত্র। তাঁদের কুষ্টিয়ার বাড়ির প্রতিবেশে অনেক গণিকার বাড়ি ছিল, যাঁরা বিভিন্ন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, আতুর পাহারার কাজ করতেন এবং ঘর ভাড়া করে থাকতেন। তাঁদের সাথে গুপ্ত পরিবারের সম্পর্ক ছিল আত্মীয় বা প্রতিবেশীর মতই ঘনিষ্ঠ। জগদীশ গুপ্তকে তাঁরা ছেলেবেলায় দেখাশোনাও করতেন। তাঁর মা কখনো এই মহিলাদের ঘৃণার পাত্র হিসেবে দেখেন নি বরং অনেকের সাথেই আন্তরিক সম্পর্ক রেখেছিলেন। জগদীশ গুপ্তের অনেক গল্প উপন্যাসে গণিকা চরিত্র এসেছে। চৌদ্দ-পনের বছর বয়সে তিনি একবার কুষ্টিয়ার গড়াই নদীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছিলেন। তাঁর সতীর্থ সতীনাথ কর্মকার তাঁকে বাঁচিয়ে আনেন। তাঁর স্ত্রী চারুবালা গুপ্তা অনুমান করেন, এ ঘটনা তাঁর দিবসের শেষে গল্পের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারে।

জগদীশ গুপ্ত কুষ্টিয়া হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এখানে তিনি পড়া শেষ করতে পারেন নি। কারণ, তিনি পাঠ্যপুস্তকের আড়ালে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পড়তেন এবং ভাওয়ালের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসের কবিতার অনুকরণে নারীপ্রেমে কাতর কবিতা লিখতেন, যা বড়রা পছন্দ করতে পারেন নি। তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি এন্ট্রান্স পাশ করে রিপন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু এখানেও তিনি লেখাপড়া শেষ করেন নি। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল তিনি আইন বিষয়ে পড়া শেষ করে ওকালতি করবেন। এতবড় পরিবারের সন্তান হয়েও শেষ পর্যন্ত তিনি টাইপিস্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর পেশাকে সামান্য বিবেচনা করে তাঁর পরিবার লোকলজ্জা ও মর্যাদার ভয়ে তাঁকে কুষ্টিয়ায় চাকরি করতে দেন নি। তিনি কিছুকাল ফাউন্টেন পেনের কালি তৈরির ব্যবসা করেছিলেন, নাম ছিল ঔধমড়’ং ওহশ, কিন্তু এক্ষেত্রেও তিনি ব্যর্থ হন। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, সাহিত্যে আত্মনিবেদনের জন্যই তাঁর জীবনের এই উচ্চাভিলাষহীনতা। তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে স্ত্রী চারুবালা গুপ্তা স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন- মানুষ হিসেবে উনি ছিলেন অত্যন্ত চাপা, অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ, আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রচ- তীব্র। অত্যন্ত কম কথা বলতেন। তবে হঠাৎ করে এমন একটা কড়া কথা অথবা এমন একটা রসিকতা করতেন যেটা আমাদের কাছে কিছুটা আশ্চর্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত। ধর্মীয় ব্যাপারে তিনি বেশ উদাসীন ছিলেন। স্ত্রীর বর্ণনায়- কোন রকম সংস্কার ওঁর মধ্যে দেখিনি। এমনকি ঠাকুর দেবতার সম্পর্কেও ওঁর কোন বাড়াবাড়ি দেখি নি।
তাঁর গল্প-উপন্যাসে দেবতাদের কটাক্ষ করা উক্তি এবং ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের অর্থলিপ্সার বর্ণনা থেকে একথার প্রমাণ পাওয়া যায়। খুব সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। বেহালা, বাঁশি নানা বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় দক্ষ ছিলেন।
জগদীশ গুপ্ত তাঁর সাহিত্যে মানব মনের অন্ধকার দিককে বেশি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। আটপৌঢ়ে মানুষের অন্তরও যে কতটা কলুষতায় ভর্তি বাংলা সাহিত্যে প্রথম তিনিই তা উদঘাটন করেছেন। লোভ, হিংসা, হিংগ্রতা, আগ্রাসী যৌনতা, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, নিয়তির করাল গ্রাস, নিষ্ঠুরতা তাঁর গল্পে প্রবল, যদিও অল্পসংখ্যক হাস্য কৌতুকের গল্পও তিনি লিখেছেন। তাঁর সৃষ্ট পুরুষ চরিত্রগুলোতে অপরাধপ্রবণতা বেশি। তাঁর গল্পের চরিত্ররা মানবিক বোধে উজ্জীবিত নয়। তারা একান্তই জৈবিক মানুষ। তাঁর মতে,
মানুষ মাত্রেই মনে মনে স্বভাবতই অধার্মিক এবং মানুষ মাত্রেরই স্নায়ুরোগ ভিতরে থাকেই।

তাঁর গল্পে মানবিক নায়ক নেই, অমানবিক খলনায়কই গল্পের প্রধান চরিত্র। এই খলনায়ক-নায়িকারা কখনো অসাধুতার সুফল ভোগ করেছে, কখনো নিষ্ঠুর নিয়তির শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই তিনি হয়ে ওঠেন দুঃখ ও হতাশার কথক। তবু এসব গল্প আধুনিকতায় অনন্য।
তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ বিনোদিনী (১৯২৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক গল্পগ্রন্থ। বইটির প্রথম গল্প দিবসের শেষে। গল্পটি সম্পর্কে এককথায় বলতে গেলে বলতে হবে ভয়ংকর। বাংলা সাহিত্যে এমন তীব্র নিষ্ঠুর নিয়তিবাদী গল্প আর নেই। রতি নাপিত ও স্ত্রী নারাণীর একমাত্র সন্তান পাঁচু, যার বয়স পাঁচ। নারাণি ইতোপূর্বে তিনটি মৃত পুত্র প্রসব করেছিল। তাই নানারকম তাবিজ কবচ পাঁচুর নিরাপত্তায় নিযুক্ত। এই পাঁচু এক সকালে আকস্মিকভাবে বলে বসে, ‘মা, আজ আমায় কুমিরে নেবে’। পাঁচু নানারকম অদ্ভুত কথা বলে, এই যুক্তিতেও মা স্থির থাকতে পারলেন না। তাদের বাড়ির পাশেই কামদা নদী, কিন্তু তাতে কুমিরের উপস্থিতির কথা কেউ কখনো শোনে নি। রতি নাপিত স্নানের সময় নানাভাবে ছেলেকে আশ্বস্ত করে; কিন্তু নদীর কাছে গিয়ে তার মনে হয়, ‘নিস্তরঙ্গ বিস্তীর্ণ আবিল জলরাশি যেন ভয়ংকর নিঃশব্দে মধ্যাহ্ন রৌদ্রে শাণিত অস্ত্রের মত ঝকঝক করিতেছে’। বিকেলে পাঁচু চুরি করে কাঁঠাল খেলে রতি আবারও তাকে হাত মুখ ধোয়াতে নদীর কাছে নিয়ে যায়। হাতমুখ ধোয়ার পর ফিরে আসার সময় নদীর পাড়ে ভুলে ঘটি ফেলে আসে পাঁচু। ফিরে গিয়ে ঘটি আনতে গেল। ‘এমন সময় তাহারই একান্ত সন্নিকটে দুটি সুবৃহৎ চক্ষু নিঃশব্দে জলের উপর ভাসিয়া উঠিল; পরমুহূর্তেই সে-স্থানের জল আলোড়িত হইয়া উঠিল, লেজটা একবার চমক দিয়া বিদ্যুদ্বেগে ঘুরিয়া গেল’। বারবার কুমিরের ভয় কাটানোর পরও নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় পাঁচুর।

পুরাতন ভৃত্য গল্পটি বিশ্বাসভাজনের বিশ্বাসহন্তার গল্প। রবীন্দ্রনাথের পুরাতন ভৃত্য কবিতায় আমরা দেখি ভৃত্যের বিশ্বাস রক্ষার মানবিক উদাহরণ। জগদীশ গুপ্তের গল্পে ঠিক তার উল্টো। বিশ্বেশ্বর ব্রাহ্মণ একদিন মাঠের ধারে এক অপরিচিত যুবককে জ্বরের ঘোরে পড়ে থাকতে দেখে লোকজনের সাহায্যে বাড়িতে নিয়ে যায়। সে এবং তার স্ত্রী ক্ষেমঙ্করীর সেবাযতেœ সুস্থ হয় যুবক। ক্ষেমঙ্করীকে যুবক মাতৃজ্ঞান করে। বাৎসল্য রসে সিক্ত হয়ে ক্ষেমঙ্করী তাকে নাম দেন নব। পরবর্তী পাঁচ বছর নব নিষ্ঠার সাথে ব্রাহ্মণ পরিবারের সেবা যত্ন করে। ক্ষেমঙ্করীর মৃত্যু হলে ‘গ্রামের লোক বিশ্বেশ্বরকে শান্ত করিল, কিন্তু নবকে শান্ত করাই দুরূহ হইয়া পড়িল’। শ্রাদ্ধের অর্থ যোগাতে বিশ্বেশ্বর তার শিষ্যদের বাড়িতে অর্থ সংগ্রহে যায়। নব অবাক হয়ে লক্ষ্য করে কেবল পদধুলি আর আশীর্বাদ দিয়েই ব্রাহ্মণ সাতশ টাকা সংগ্রহ করে ফেলেছে। ফিরে আসার পথে অন্ধকার মাঠে বিশ্বশ্বরকে ঘায়েল করে টাকা নিয়ে পালায় নব। গল্পটিতে কাহিনীর চমকের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবন, হিন্দু সমাজের জাত-পাতের ভেদ, মানুষের বদলে যাওয়া সবই শিল্পাকারে চিত্রিত।

প্রলয়ঙ্করী ষষ্ঠী গল্পটি অদ্ভুত। গল্পের প্রধান চরিত্র প্রভাবশালী ব্যক্তি সদু খাঁ। তার বিশ কুঠুরির দোতলা দালানে থাকে পাঁচ বিবি, দাসী বাঁদী খানসামা পরিচারকবৃন্দ। ‘দাসী বাঁদী বিবি-সকলের গর্ভেই ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণ করিতেছে’। একবার ব্যবসার জন্য এক গ্রামে গিয়ে সেখানকার জসীমের বৌকে তার পছন্দ হয়। জসীমের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে সদু। নিজের ভাইয়ের বিয়ের কথা বলে জসীমের বৌকে নিজের বাড়িতে এনে রাখে। কিছুদিন পরে জসীম দেখা করতে গেলে তাকে তাড়িয়ে দেয় সদু। অর্জুন নমশূদ্রের সহায়তায় সদু খাঁর লাঠিয়াল বাহিনীকে পরাজিত করলে গ্রামীণ নিয়ম অনুযায়ী নিজের বৌকে ফেরত পাওয়ার কথা জসীমের। কিন্তু শেষ দুটি লাইনে জগদীশ গুপ্ত চমকে দেন আমাদের। ‘জসীম তার বৌকে ফিরিয়া পায় নাই। বৌ নিজেই আসিতে চায় নাই’। নারীর রহস্যময়তার এ কোন নতুন দিকের কথা জানাতে চেয়েছেন গল্পকার?
চন্দ্র-সূর্য যতদিন গল্পে আমরা দেখি সম্পত্তি ভাগ না হওয়ার জন্য দুবোনকে একই স্বামীর কাছে বিয়ে দেওয়া হয়। এতে বড় বউ ক্ষণপ্রভা উনিশ বছরে বয়সেই ভাবতে থাকে সে বুড়ি হয়ে গেছে, তাই তার রূপের আর গ্রহণযোগ্যতা নেই। কিন্তু সে পুত্রসন্তানের মা। এই সম্বলটি দিয়ে সে স্বামীর মন আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু নিজের উপযোগিতা নিঃশেষিত হয়েছে এই বিবেচনায় এবং নারীত্বের অপমানে শেষ পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্য হারায় ক্ষণপ্রভা।

মানুষের শক্তিশালী প্রবণতা হিসেবে যৌনতাকে আমরা আবিষ্কার করি আদি কথার একটি গল্পে। কাঞ্চন যৌবনে বিধবা হয়। তাকে শারীরিকভাবে পেতে চাইত প্রতিবেশী সুবল। অন্য উপায় না পেয়ে কাঞ্চনের কাছে যাওয়ার জন্য তার পাঁচ বছরের মেয়ে খুশিকে বিয়ে করে সে। একসময় প্রকাশ করে তার সুপ্ত বাসনা। শুরুতে প্রবল বাধা দিলেও ধীরে ধীরে যেন কাঞ্চনের বাধা দেওয়ার শক্তি হ্রাস পায়। সুবল প্রবল পাশবিকতার সাথে বিকৃত লোভ চরিতার্থ করে। সমাজের কাঠগড়ায় মূল অপরাধী হয় কাঞ্চন আর সুবলকে লঘুদ- দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা রতিমঞ্জরী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় ‘বিবাহার্থিনী বিধবা’ শিরোনামে। এগারো বছরের দাম্পত্য জীবন যাপনের পর তার ধারণা হয় তার স্বামী তাকে বিয়ে করেছে সুলভে গণিকা পাওয়ার লোভে। বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে এক ব্যক্তি তার সাথে দেখা করতে আসে। লোকটির সাথে কথা বলে রতিমঞ্জরীর স্পষ্ট বিশ্বাস জন্মে, বৈবাহিক সম্পর্কে পুরুষেরা দেহাতীত কোন প্রেম আকাঙ্খা করে না। তাদের চাই নারীর রক্তমাংসের শরীর। জগদীশ গুপ্ত রতিমঞ্জরীর পরিণতি ব্যাখ্যা করেন, ‘তার গণিকাবৃত্তিই পৃথিবী চায় – গণিকাই সে হবে’।
অর্থলোভে মানুষের নৈতিক পতনের অকল্পনীয় চিত্র পাই পয়োমুখম গল্পে। কৃষ্ণকান্ত কবিরাজ বৈবাহিক মহলে নানা কথা প্রচার করে নিজের অযোগ্য পুত্রকে বিয়ের বাজারে দুর্মূল্য করে তোলে। তারপর উচ্চ পণে একের পর এক বিয়ে করায় এবং পুত্রবধূদের বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। পরে পুত্র ভূতনাথ বাবার সত্য উদ্ঘাটন করে, ফলে তার তৃতীয় স্ত্রী অকালমৃত্যু থেকে রক্ষা পায়।
সাধারণভাবে জগদীশ গুপ্ত প্রথম কয়েক অনুচ্ছেদে গল্পের আবহটি তৈরি করেন এবং তারপর থেকে মূল ঘটনা শুরু হয়। তবে তিনি অনেক বাক্য বা অনুচ্ছেদের পরে উদ্দেশ্যহীন ড্যাশ ব্যবহার করেছেন, যা পরবর্তী বাক্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। যেখানে চিন্তার অবকাশ আছে, সেখানে … (ডট চিহ্ন) দিয়েছেন। শুরুর দিকের গল্পগুলো সাধুভাষায় লিখলেও পরে চলিতভাষায় লিখতে শুরু করেন।

সাহিত্য গবেষক সরকার আবদুল মান্নানের এম.ফিল. গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল জগদীশ গুপ্তের সাহিত্য। তাঁর গবেষণাপত্রের গ্রন্থরূপ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ (২০০১)। এখানে তিনি জগদীশ গুপ্তের গল্পকে চারভাগে ভাগ করেন।
ক. যৌন জটিলতা ও যৌন অপরাধমূলক গল্প। এ ধারার গল্প চন্দ্র-সূর্য যতদিন, আদি কথার একটি, প্রলয়ঙ্করী ষষ্ঠী, বিধবা রতিমঞ্জরী, কলঙ্কিত সম্পর্ক, অরূপের রাস, শঙ্কিত অভয়া ইত্যাদি।
খ. স্বার্থসর্বস্ব মানুষের নিষ্ঠুরতাভিত্তিক গল্প। এ ধারার গল্প পয়োমুখম, পুরাতন ভৃত্য, মায়ের মৃত্যুর দিন, চার পয়সায় এক আনা ইত্যাদি।
গ. নিষ্ঠুর নিয়তি ও অতিপ্রাকৃত বিষয়ক গল্প। এ ধারার গল্প দিবসের শেষে, হাড়, তৃষিত আত্মা, দৈব ধন ইত্যাদি।
ঘ. কৌতুকরস ও রোমান্টিক গল্প । এ ধারার গল্প আঠার কলার একটি, কামাখ্যার কর্মদোষে ইত্যাদি।
একই গ্রন্থে তিনি জগদীশ গুপ্তের সাহিত্যে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যগুলোকেও তুলে ধরেছেন। জগদীশ গুপ্ত জীবনের বেদনা ও স্বভাবের অন্ধকার দিকটিকে প্রথম উদ্ঘাটন করেছেন। তিনি আমাদের সমাজের প্রেক্ষিতে নিঃসঙ্গতাকে আবিষ্কার করেছেন। নির্মোহ ও নিরাবেগে মানুষের স্বভাব স্বার্থান্ধতা এবং মনের অশুচিতাকে বর্ণনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে নারী পুরুষের সম্পর্কে যৌনতার দিকটি নিয়ে তিনিই প্রথম আলোকপাত করেছেন, কোন অতীন্দ্রীয় অপার্থিব প্রেমের চিত্র আঁকেন নি। তাঁর পূর্বে এভাবে ভাবাটাই ছিল ভয়ের। জীবনের সমস্ত অবদমন মেনে নিয়ে মর্মে মরে যেত মানুষ, কিন্তু প্রকাশের সাহস ছিল না। জগদীশ গুপ্ত প্রথম খুলে দিলেন অবদমনের কুৎসিত দরজা। তাঁর সাহিত্যেই প্রথম দেখা যায়, নারী নির্যাতিতা বলেই সহজ সরল নয়, বরং জটিল মনস্তাত্ত্বিক আবর্তে সে দুর্বোধ্য। তাঁর গল্পে নিয়তি কোন কর্মফল হিসেবে নয়, বরং কাকতাল হিসেবেই এসেছে। কিন্তু তবু সে এমনই তীব্র যে, পাত্র-পাত্রীর পক্ষে তা দুর্লঙ্ঘ্য হয়েছে। জগদীশ গুপ্ত জীবনের রূঢ় বাস্তবতার চিত্র এঁকে গেছেন। পাপ-পূণ্য, শুভ-অশুভের আলাদা মূল্যায়ন করেন নি। জীবন যেমন, তাই লিখে গেছেন।

জগদীশ গুপ্তের প্রথম উপন্যাস লঘু-গুরু। এখানে তিনি যে সমাজের বর্ণনা দিয়েছেন তা রবীন্দ্রনাথের কাছে বাস্তবিক মনে হয় নি। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসটির সমালোচনা লিখেছিলেন পরিচয় পত্রিকায়। সেখানে তিনি উপন্যাসটির কিছু মৌলিক ত্রুটি তুলে ধরলেও এক জায়গায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসেছিলেন, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্ভবত দ্বিতীয়বার করতে দেখা যায় নি।
এদেশে লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে কাটালুম,এই উপন্যাসের অবলম্বিত সমাজ তার পক্ষে সাত-সমুদ্র-পারের বিদেশ বললেই হয়। দূর থেকেও আমার চোখে পড়ে না। লেখক নিজেও হয়তো বা অনতিপরিচিতের সন্ধানে রাস্তা ছেড়ে কাঁটাবন পেরিয়ে ও-জায়গায় উঁকি মেরে এসেছেন। আমার এই সন্দেহের কারণ হচ্ছে এই যে, লেখক আমাদের কাছে তাঁর বক্তব্য দাখিল করেছেন, কিন্তু, তার যথেষ্ট সমর্থন যোগাড় করতে পারেননি।
উত্তরে জগদীশ গুপ্ত লিখেছিলেন- ‘লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে এতকাল’ আমাকে কাটাইতে হইয়াছে সেখানে ‘স্বভাবসিদ্ধ ইতর’ এবং ‘কোমর বাঁধা শয়তান’ নিশ্চয়ই আছে; এবং বোলপুরের টাউন-প্ল্যানিং-এর দোষে যাতায়াতের সময় উঁকি মারিতে হয় নাই, ‘ও-জায়গা’ আপনি চোখে পড়িয়াছে। কিন্তু, তথাপি আমার আপত্তি এই যে, পুস্তকের পরিচয় দিতে বসিয়া লেখকের জীবন-কথা না তুলিলেই ভাল হইত, কারণ, উহা সমালোচকের ‘অবশ্য-দায়িত্বের বাইরে’ এবং তাহার ‘সুস্পষ্ট প্রমাণ’ ছিল না।
জগদীশ গুপ্তের গল্পে যৌনতা বড় চালিকার ভূমিকা পালন করেছে। মানুষের একটি শক্তিশালী প্রেষণা হিসেবেই যৌনতাকে গল্পে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। যে যৌনতা জীবনে নেই, তেমন কোন অলীক গল্প শোনান নি। তাঁর গল্পের যৌনতা অশ্লীল নয়। যদি হত তবে তিনি সহজ জনপ্রিয়তা পেতে পারতেন। নিদেনপক্ষে নিজকালে বা একাংশ পাঠকের কাছে তাঁর কাটতি ভাল হতে পারত। কিন্তু তাঁর লেখা কোনকালেই তেমন পরিচিতি পায় নি। এমনকি, কোন বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণও বের হয় নি।

কল্লোল যুগ গ্রন্থে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত জগদীশ গুপ্ত সম্পর্কে লিখেছিলেন- ‘অনেকের কাছেই তিনি অদেখা, হয়তোবা অনুপস্থিতও বটে।’
তখন জগদীশ গুপ্ত ব্যক্ত করেন- এই একটি শব্দ ‘অনুপস্থিত’ শব্দটি আমার সঙ্গে পাঠকের যোগরেখা চমৎকার নির্বিশেষভাবে দেখাইয়া দিয়াছে। একটি শব্দের দ্বারা এতটা সত্যের উদ্ঘাটন আমার পক্ষে ভয়াবহ হইলেও আনন্দপ্রদ। সরল ভাষায় কথাটার অর্থ এ-ই যে, অনেকেই আমার নাম শোনেন নাই।
জগদীশ গুপ্ত সার্থক গল্পকার হলেও বিরলপঠিত। এর মূল কারণ, রচনার দুর্বোধ্যতা নয়, বরং তাঁর অভিনবত্ব ও দুষ্প্রাপ্যতা। নিজকালে জনপ্রিয় ছিলেন না বলে তাঁর অনেক লেখাই সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। তাঁর রচনাসম্ভার অন্তত পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পারলেও পাঠক আগ্রহ বোধ করতেন এটা নিশ্চিত। গল্পকার জগদীশ গুপ্ত মননশীল সাহিত্য সৃজন করে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন, এবার সেটাকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করা এবং ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের। তাঁর মত লেখকদের বিস্মৃত হতে দেওয়াটা আমাদের জন্যই ক্ষতিকর হবে। আমরা কিভাবে আমাদের দায়িত্ব পালন করছি, তার উপর নির্ভর করবে, আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ।

সহায়ক গ্রন্থ:
১) জগদীশ গুপ্তের শ্রেষ্ঠ গল্প, সম্পাদনা: সরকার আবদুল মান্নান ও মনি হায়দার, মনন প্রকাশ, ২০১২।
২) সরকার আবদুল মান্নান, জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ, বাংলা একাডেমী, ২০০১।
৩) জগদীশ গুপ্ত শ্রেষ্ঠ গল্প, সম্পাদনা: আবদুল মান্নান সৈয়দ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০০১।
৪) সৈয়দ শামসুল হক, মার্জিনে মন্তব্য, অন্যপ্রকাশ, ২০০৫।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট