চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

খোঁপায় কবির ফুল

মুহাম্মদ আবু নাসের

৮ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:১৩ পূর্বাহ্ণ

নজরুলের গানে ও কবিতায় অনেক রকম ফুল এসেছে নানা মাত্রায়, নানা উপমায়, নানারূপে। কখনো নারীর অলংকার, কখনো বা কাব্যের ছন্দে। তাঁর বিদ্রোহী সত্তার আড়ালে আছে দরদমাখানো নরম-নিসর্গের আলাপচারিতা। নরম সৌন্দর্যের বর্ণনা। আছে নন্দনকানন থেকে পারিজাতকে পাওয়ার বাসনা। তাই তিনি বইয়ের নামকরণে বেছে নিয়েছেন অনবদ্য ফুল দল। দোলন চাঁপা, ঝিঙে ফুল, ফণীমনসা, রাঙা-জবা, মহুয়া-আনো কত নাম। এসব পুষ্পসৌরভ তাঁর রচনা সম্ভারকে সুরভিত করেছে বারবার। এতে নানাভাবে পুষ্প-বৃক্ষের প্রসঙ্গ এসেছে। কখনো উপমায়, কখনো সরাসরি। যেমন-নার্গিস কখনো প্রিয়তমা’ কখনো ফুল হিসেবে এসেছে। তিনি গেয়েছেন:
‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে
ঝরা বন-গোলাপের বিলাস শোনে।’

নার্গিস মূলত ফুলের নাম। আমাদের দেশে গুলনার্গিস নামে একটি কন্দজ ফুল আছে। সেটি নজরুলের সেই নাির্গস নয় বলেই মনে করা হয়। তবে এই উপমহাদেশে নার্গিসের আগমন ও কদর সম্ভাবত মোগলদের হাত ধরে, যা পৃথিবীজুড়ে নার্সিসাস নামেই বেশি পরিচিত।
গভীর ভাবনা-বোধ থেকে কোন নারীর পরনে কবি দেখেছেন কানে অর্জুনের ফুল আর গলায় কদম ফুলের মালা।
“অর্জুন মঞ্জরী কর্ণে, গলে নীপ-মালিকা….”।

অর্জনকে বলা হয় নিগৃহীত সুন্দর। ঔষধি গুণ থাকায় অর্জুনের বাকল তুলে নেওয়ার কারণে গাছটি শ্রীহীন হয়ে পড়ায় এমন নামকরণ। অর্জুনের ফল দেখতে কামরাঙার ন্যায়। কবিতায় উল্লেখিত ‘নীপ’ মানে আমাদের বহুল পরিচিত কদম। বাংলার অবহেলিত বুনোফুলও তাঁর কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি ফুলকে মেখলা সাজিয়ে দেখতেই বেশি আনন্দ পান। বাবলা ফুলের নাকছাবি আর নীল অপরাজিতার শাড়ি তাই উপমায় মূর্ত হয়ে ওঠে।
‘বাবলা ফুলের নাকছাবি তার, গায়ে শাড়ি নীল অপরাজিতার চলেছি সই অজানিতার, উদাস পরশ পেতে।’
আবার খোঁপায় পরিয়েছেন অবহেলিত ধুতরা ফুল। এর সৌন্দর্যও তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি গান বেধেছেন, ‘ কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল লো, খোঁপা খুলে কেশ হ’ল বাউল লো।…”

কোন এক অভিসারের পথে কবি তাঁর প্রিয়তমার জন্য পুষ্পার্ঘ্য কামনা করেছেন। তিনি চেয়েছেন তাঁর মানসপ্রিয়া হেঁটে আসুক পুষ্পবিছানো পথ ধরে।
‘দিও ফুল দল বিছায়ে পথে বধূর আমার, পায়ে পায়ে দলি ঝরা সে ফুল দল: আজি তার অভিসার।’
সাত ভাই চম্পার পারুল কিন্তু একটি দুর্লভ ফুলের নাম। এই বিখ্যাত এবং দুর্লভ ফুলটি নিয়ে তিনি কাব্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর রচনায় পারুলের প্রসঙ্গ এনেছেন অনেকবার।
‘সাত ভাই চম্পা জাগোরে, কেন বোন পারুল ডাকোরে।’
নজরুল কিশোরী রাধার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন,
‘তুমি অপরাজিতার সুনীল মাধুরী
দু’চোখ আনিলে করিয়া কি চুরি?
তোমার নাগ কেশরের ফনী-ঘেরা মউ
পান করাল কে কিশোরী?’

এখানে নজরুল অপরাজিতা এবং নাগেশ^রের কথা বলেছেন। নীল, সাদা এবং বেগুনি রঙের অপরাজিতা মূলত বর্ষজীবী লতানো গাছ। এর মধ্যে নীল অপরাজিতাই বিখ্যাত। আর নাগেশ^র এই অঞ্চলের প্রাচীন ফুল। আমাদের কাব্য-কলা-উপমায় এর প্রসঙ্গ এসেছে বারবার।
খানিক স্পর্শে নুয়ে পড়া লজ্জাবতীও কবির দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি লিখেছেন-
‘লজ্জাবতীর লুলিত লতায়, শিহর লাগে পুলক-ব্যথায় মালিকাসম বঁধূরে জড়ায়, বালিক-বধূ সুখ-স্বপনে’
নজরুল অসংখ্য গানে পুষ্প-বৃক্ষের কথা বলেছেন, বলেছেন তাদের রূপ-মাধুরীর কথা। তিনি পেয়েছেন।
‘পরো কুন্তলে, ধরো অঞ্চলে, অমলিন প্রেম-পারিজাত।’ এই পারিজাত মানে মান্দার, স্বর্গীয় ফুল। অন্যত্র তারই ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়:
‘আনো নন্দন হাতে পারিজাত কেশর
তীর্থ-সলির আনোভরি ‘মঙ্গল-হেম-ঝারি।…’

নজরুল তাঁর লেখনীতে তুলে এনেছেন আমাদের চারপাশের সমস্ত চেনা ফুল। যে সব ফুলের সঙ্গে আমাদের প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। যেমন-চামেলি, জুঁই, শিউলি, চাঁপা, মালতী, টগর, বকুল, বেলি, শাপলা, পদ্ম, বইচি, পলাশ, কেয়া, হাসনাহেনা ইত্যাদি।
‘বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি
যুথী বেলি।’
এই চেনা ফুলগুলোর আবেদন যেমন চিরন্তন, তেমনি এ যুগের সাজে। এই সময়ে তরুণীদের পছন্দের সঙ্গে বেশ মানানসই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট