চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বৃদ্ধা আনোয়ারা

১ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৪২ পূর্বাহ্ণ

একটা দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আরো দরজার খবর নিতে হয়। কিন্তু আমি তেমন তাগাদা অনুভব করলাম না। বরং মনে হল ধর্মঘট চলুক আরো কিছুদিন। ঢাকা শহরে ঢোকা মানেই তো যন্ত্রকথার রাজ্যে প্রবেশ করা। কে চায়, শান্ত মনোরম সবুজঘেরা ভূ-স্বর্গ থেকে নিজেকে সরিয়ে,কান ঝালাপালা করা শব্দ আর দুর্গন্ধময় ডাস্টবিনে ঢুকে পড়তে?

বন্ধুকে বললাম, ‘তোর মেয়ে দেখার পর্ব শেষ, আপাতত সেটাই প্রাপ্তি। এখন ঢাকায় ফেরা নিয়ে টেনশন করে লাভ নাই। আমরা তো আর হেঁটে হেঁটে ঢাকায় যেতে পারবো না। তাছাড়া, আশেপাশে এয়ারপোর্ট কিংবা পিঠে পাখাও নাই যে উড়ে যাব। আমি অফিসে নক করে দিয়েছি, তোর তো ছুটি আছেই সুতরাং তুই ফোনালাপ চালিয়ে যা নিশ্চিন্তে।’

বন্ধু, তার হবু বউয়ের সাথে নিশ্চিন্তে ফোনালাপ চালিয়ে যেতে লাগল। আমি বন্ধুর বাড়ির আশেপাশে কৃত্রিমতাবর্জিত প্রকৃতির অমোঘ আবহে খুঁজে চললাম হারিয়ে যাওয়া সুখ। হরেক গাছের পাতার ফাঁকগলে যে সূর্যের আলোর খেলা চলে তা গায়ে মাখলাম হরেক পাখির কিচিরমিচির গান শুনে।

তারপর, তাঁর সাথে দেখা হল পুকুর পাড়ের বাঁশবাগানে। ছাগলের বাচ্চাকে আমি কোলে করে তাঁর কাছে নিয়ে এলাম মনোজাগতিক ভালো লাগা থেকে কিন্তু সে আমার মুখে চোখ রাখল কৃতজ্ঞতার আলোকে।

‘তুমি কে গো বাবা?’
‘আমার নাম সারস’
‘সারস পাখি?’
‘হা হা হা হা হা’
‘তোমার হাসিটা সারস পাখির মতো’
‘সারস পাখির হাসি আপনি দেখেছেন?’
‘না!’
‘তো বললেন?’
‘বললাম, রাগ করেছ?’
‘ওমা, না’
‘ শোন বাবা, যদি কুৎসিত মানুষও মন খুলে হাসে, তা সুন্দর দেখায়। তোমার হাসিটা ছিল মন খোলা। আর নাম বললে সারস, তাই সারস পাখির হাসির কথা বললাম।’
‘ বেশ বলেছেন, আপনার কথা ঐ সারস পাখির মতোই সুন্দর!’
‘ হা হা হা হা হা’
তাঁর প্রাণখোলা উচ্চশব্দের হাসি বাঁশঝাড়ের করকর শব্দভেদ করে মনে হয় আকাশে উঠে গেল, যে আকাশে কোন মেঘ ছিলনা। পরিচয় পেলাম, নাম আনোয়ারা বেগম, পাকিস্তান আমলের ম্যাট্রিক পাশ, দীর্ঘদিন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করেছেন। বন্ধু রুমির বাবা সফিক মাস্টারও তাঁর ছাত্র ছিল।
তাঁর সুস্পষ্ট আর হাস্যরসের কথা বলা, পরনের কাপড়, চশমা এমনকি হাতের মার্জিত লাঠির রহস্য খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু, পরোক্ষণে মনে হল যা খুঁজে পেলাম তা কিঞ্চিৎ।
সে আমাকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ করলে, না করলাম না। অলস সময়, রহস্য উদ্ঘাটনের ঝুলিতে কিঞ্চিতের বেশি হলে মন্দ কী? আমি রুমিকে ফোন করলাম। ‘আনুদির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তোর আর রক্ষা নাই’ লাইন কেটে গেল। আমি কিছুই বুঝলাম না, রুমি এমন কথা বলল কেন? আবার শেষে হাসির শব্দও শুনলাম!
‘বুঝলে বাবা, বুড়ো হয়ে গেলে মানুষ গুর মতো হয়ে যায়, সবাই ঘেন্না করে, আপনজনরাও কাছে আসতে চায় না।’
আমার মাথায় তখনও রুমি হাসিটা গেঁথে ছিল, ও তো ফাউ কথা বলার মানুষ না। আমি রুমির হাসিটা মাথা থেকে বের করে দিলাম, দুই নৌকায় পা দিয়ে সামনে এগুনো যায় না। তাঁর কৌতুকপ্রিয় আবার অভিমান মিশ্রিত কথা বা প্রশ্নে আমার ফেঁসে যাওয়াই বেটার মনে হল।

আমাদের কথা হচ্ছিল হেঁেট হেঁটে, আমি ছাগলের বাচ্চার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম-
‘ না, তা হবে কেনো?’
‘এটা আমার অভিজ্ঞতা রে বাবা, তুমি অমির কথাই ধর, আগে ও বাড়ি এলেই আমার সাথে দেখা করত কিন্তুএখনদেখা করা তো দূরের কথা, বিয়ে ঠিক করে ফেলল অথচ আমি কিছুই জানি না।’
এই প্রথম তাঁর কথায় কিছু পেলাম যা আমার কাছে সামথিং রং মনে হলো-
‘ অমিটা কে? আপনি যার কথা বলছেন সে তো রুমি!’
‘ও রে বাবা, তুমি অমিকে চিনো না, আমার নাতি, আজাহারের ছেলে। পায়ে ধরে বললাম ছেলেটাকে পাঠাসনা, কে শোনে কার কথা, ওরা জোর করে পাঠিয়ে দিলো। পাঁচটা না দশটা না একটামাত্র ছেলে তোদের, তোরা কোন আক্কেলে ওরে বিদেশ পাঠাইলি?’

‘তাঁর কথার কোন প্রতিউত্তর আমার জানা ছিলনা, সে যে গল্পের এক শাখা থেকে আরেক শাখায় চলে গেছে সেটাও বললাম না, তারচেয়ে আমার মনে হলো একে যত তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁচ্ছে দেওয়া যায় ততই ভালো হবে। আমি প্রসঙ্গ ঘুরানোর চেষ্টা করলা-
‘ছাগলের বাচ্চা আপনার কয়টা আছে?’
‘আমার নাতো, মনার মায়ের, রাতে বাচ্চাটা হারিয়ে গেছিল, ছাগলটার সে কি কান্না। সারারাত ভ্যা ভ্যা করছে। জানো বাবা, অমি চলে গেলে আমিও সারারাত কাঁদছিলাম। অমিটাও কেমন আমাকে ছেড়ে চলে গেল? আগের মতো কথাও বলেনা! কেনো বলে না? ও জানে না দুদিন পর আমি মারা যাব! মারা গেলে ও কার সাথে কথা বলবে, বল?’
আমার মনে হল সে যেকোনো সময়ে পড়ে যাবে।ছাগলের বাচ্চাটিকে কোল থেকে নামিয়ে আমি তাঁর কাঁধ শক্ত করে ধরলাম। প্রিয়জনের বিরহে মনোস্তাত্ত্বিক অস্তিরতায় তাঁর সারা শরীর কাঁপতেছিল। দুর থেকে মাঝ বয়সি একজন মহিলা দৌড়ে কাছে এসে খালাম্মা খালাম্মা বলে ডাকতে লাগল, জেনে নিলাম এ মনার মা, বাড়ি কাজের লোক। সে মনার মায়ের কথায় সারা দিতে পারল না, তার আগেই আমার বুকে মাথা এলিয়ে দিল।

আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তবে, ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি ট্যাকেল দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমি মনার মাকে হাসপাতালের কথা বললাম, সে আমাকে আশ্বাস দিল, এমনটা মাঝে মাঝেই হয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। দুজনে ধরাধরি করে বৃদ্ধাকে বাড়িতে নিয়ে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে রুমিকে পরিস্থিতি জানিয়ে ফোন করলাম। মনার মা সেবা-যত্ন করতে লাগল।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর বৃদ্ধা চোখ খুললে, রুমি আর মনার মা তাকে আধা শোয়া করে বসালেন। আমি অবাক হলাম রুমি বৃদ্ধার

সাথে হাস্যকৌতুক করে কথা বলা শুরু করল দেখে।‘ও দাদী আমি কতক্ষণ ধরে বসে আছি, কিন্তু তোমার ঘুম ভাঙেই না, এই অসময়ে কেউ ঘুমায় বল?’ আমি পিছনের দিকে থাকায় সে আমাকে দেখতে পায়নি। মনার মা চোখের ইশারায় আমাকে ঘরের বাইরে আসার ইঙ্গিত দিল, বাইরে আসার সময় আমি তাঁর খিলখিল করে মুক্তঝরা হাসির শব্দ শুনলাম।
আমি তখনো ঘোরের মধ্যে, আমার কাছে মনে হল পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন দেখছি।এত দ্রুত সমস্যার সমাধান,তা কি করে হয়, কেমনে সম্ভব? কিন্তু, যা ঘটল তা তো সত্যি, চোখের সামনের ঘটনা।

আমি মনার মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, ‘ ঘটনা কী বলুন তো? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
‘ চিন্তা কইরেন না, আর ডর নাই। নানিজানের মাঝে মধ্যি এমন অয়। এহনতো কমে গেছে,আগে অইতো বেশি।’
‘ বুঝলাম না, অমি কে?’
‘ অমি ভাইজান আছিল নানিজানের এ্যাকমাত্র নাতি’
‘আছিল মানে, এখন নাই?’
‘ভাইজান বিদ্যাশ পড়বের গেছিল, ঐহানে গাড়ি এ্যাকসিডেন কইরা মইরা গ্যাছে। হেরপর থেকা নানিজানের এই ব্যারাম। তয় ভাইজান যে মইরা গেছে তা উনি জানেন না।’
‘ জানেন মানে? তাহলে অজ্ঞান হয় কেনো?’
‘তা তো জানি নে, ওনি মনে অয় বুঝবের পারছে। মাস্টারি চাকরি শ্যাষ করার পর, নানিজান ঢাহাই পোলার বাড়িতে থাকতো, অমি ভাইজান বিদ্যাশ যাইয়া তো মইরা গেল, ওনি আর ফোনে নানিজানের হাতে কতা কয়না, হেরপর হুনছি নানিজান খালি কান্দাকাটি করতো আর বেহুশ অইয়া যাইত।বছরখানি পাগলও অইয়া গেছিল। পরে এটু ঠিক অইলে গেরামে চইলা আইছে। ভাইজানরে ওনি মেলা আদর করত, ভাইজানরে ওনি বিদ্যাশে যাইবের দিবের চাইছিল না। গেরামে আইস্যাও কয়কেবার বেহুশ অইছিল। বেহুশ অইলে খালি অসি ভাইজানের নাম নেয় আর আবোল তাবোল কতা কয়। তয়, যহন ঠিক অইয়া যায় তহন আর আগের কতা মনে থাহে না। ভাইজান আপনে যে ঢাহাতে আইছেন একতা নানিজানরে কইয়েন না, অমি ভাইজানতো আপনের বয়সের আছিল, তাই আবার ওনার অমি ভাইজানের কতা মনে অইবের পারে।’

আশ্বিনের আকাশ তখনও নির্মল, দুপুর গড়িয়ে যায়নি। কিন্তু আমার মনের আকাশ মনে হল বৈশাখের সন্ধ্যা। খানিক আগের মধুময় সুখস্মৃতি এলোমেলো দমকা বাতাসে যেন হঠাৎ উলটপালট করে দিল। বুঝতে পারলাম, বৃদ্ধা আনোয়ারা নামক শান্ত নদীতে অমি নামক যে মনোরম স্রােতধারা ছিল,তা ছিল তাঁর শেষ জীবনের বেঁচে থাকার প্রেরণা। কিন্তু,প্রকৃতির খেয়ালে সেই প্রেরণা বিলীন হয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তা কেবল তাঁর একার নয়, সে ক্ষত আমারও।

সে আমাকে ভালোবেসে ডেকেছিল সারস পাখি। স্বল্পসময়েইআমি তাঁর প্রেমে পড়েছিলাম, তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর আভিজাত্য, তাঁর খুনসুটি, তাঁর মমত্ব, তাঁর সরলতা, তাঁর উদারতা, তাঁর উজ্জল গোলপানা মুখ, তাঁর পানরঙা ঠোঁট, তাঁর বয়স কোঠরে ঢুকে যাওয়া চোখ, তাঁর চশমা এমনকি তাঁর হাতের লাঠিও আমাকে মোহিত করেছিল পূর্ণিমার চাঁদের মতো। কিন্তু, আমি প্রেমসমুদ্রের মধুচাকে মৌমাছি হয়ে বসতে পারলাম না। সে অদৃশ্য হয়ে নিজেস্ব দ্বীপে বসে রইল সব ভুলে। আর, আমি সেই দ্বীপের খুব কাছ থেকে বিদায় নিলাম একা, বিরহী সারস পাখি হয়ে…

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট