চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ওলগা তোকারচুকের উপন্যাসে মানবজীবনের ক্ষত-বিক্ষত চিত্র

রনি চক্রবর্তী

১ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৪২ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান প্রেক্ষাপটের উপর দাঁড়িয়ে, অতীতকে জেনে, ভবিষ্যৎকে যিনি ইঙ্গিত করতে পারেন তিনিই হন কালোর্ত্তীর্ণ। আর প্রকৃত লেখক-সত্তা একজন মানুষকে করতে পারে কালজয়ী। এটা বলা হয় যে ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য বা শিল্পের লিখিত বা লেখকের বাস্তব জীবনের অনুভূতি হচ্ছে সাহিত্য। আবার অপরদিকে সাদাত হাসান মান্টো বলেছেন, “সাহিত্যের প্রদীপ লেখকের মগজ দিয়েছে জ্বলে। তাই লেখক একজন সাধারণ মানুষ নন। তারা হন প্রচ- অনুভূতিপ্রবণ।” লেখকের কল্পনা শক্তি হয় সুদূরপ্রসারি। তিনি তাঁর কল্পনা শক্তিকে বাস্তবতার মিশেল দিয়ে দৃষ্টিকে পৌঁছে দিতে পারেন অনেক দূর। পৃথিবীকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার, মানবতা প্রতিষ্ঠা, সকল প্রকার সীমানা প্রাচীর ভেঙে দিয়ে সকল মানুষের সমান জয়গান গাওয়ার জন্য লেখকের কলম সর্বকালে হয়ে উঠেছে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অস্ত্র। সেই নিরিখে বলতে গেলে বর্তমান সময়ে বিশ্বসাহিত্যে যে কজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক দ্যুতি ছড়িয়েছেন তাদের মধ্যে ওলগা তোকারচুক অন্যতম।

পোল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর সুলেখোফ শহরে ১৯৬২ সালের ২৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন এই কৃতী লেখক, যাকে মনে করা হয় পোল্যান্ডের তাঁর সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে সর্বাধিক সমাদৃত এবং ব্যবসা সফল। তাঁকে বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম মেধাবী লেখকও বলা হয়। তাঁর পাঠকদের দৃষ্টিতে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্ম জুড়ে যে বুদ্ধিদীপ্ততা ছড়িয়েছেন তা নিসন্দেহে প্রশংসনীয়। পেশায় তাঁর বাবা-মা শিক্ষক হলেও তাঁর বাবা স্কুলের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করতেন। তোকারচুক ১৯৮০ সালে ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি কিশোরদের আচরণগত সমস্যার জন্য নির্মিত কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৫ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি ভ্রোক্লাউ ও পরে ভালব্রিচে চলে যান, সেখানে তিনি থেরাপিস্ট হিসেবে অনুশীলন শুরু করেন। তোকারচুক নিজে কার্ল জাঙের শিষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন এবং জাঙের মনস্তত্ত্ব তার সাহিত্যকর্মের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তোকারচুক নোয়া রুদার নিকটবর্তী একটি ছোট গ্রামে বসবাস করছেন এবং সেখান থেকে তিনি তার ব্যক্তিগত প্রকাশনা কোম্পানি রুটা তত্ত্বাবধান করেন। তিনি রাজনৈতিক দল দ্য গ্রিনসের সদস্য এবং বামপন্থী ধারণায় বিশ্বাসী।কবিতা লেখার মধ্যে দিয়ে তিনি পা রাখেন সাহিত্যে অঙ্গনে।

১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার সংকলন ‘মিলস্তা উ লুস্ত্রাচ’। তাঁর সমগ্র সাহিত্য কর্মের বিস্তার সংখ্যার দিক দিয়ে খুব বেশি না হলেও তা মানের দিক দিয়ে বিশ্লেষকদের দ্বারা মূল্যায়িত হয়েছে প্রশংসার সহিত। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জার্নি অব দ্য পিপলস্’ যার অপর নাম ‘পদ্রোজ লুদজি সিয়েগি’। বইটি সপ্তদশ শতাব্দীর ফ্রান্সের পটভূমিতে রচিত যেখানে দেখা যায় দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকাকে একটি বইয়ের রহস্য খুঁজতে। এখানে লেখক রূপক আশ্রয় নিয়ে জীবন আর বেঁচে থাকা, এই দু’টির পার্থক্য খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। শুধু মাত্র নিজের জন্য না বেঁচে সবাইকে সাথে নিয়ে সীমানা ও বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করে বাঁচার বার্তা দিয়েছেন।

১৯২০-এর দশকে বেরস্লাউয়ে এক জার্মান-পোলিস বুর্জোয়া পরিবারে বেড়ে ওঠেন এর্না এলৎজনার যিনি অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন আর তাকে কেন্দ্র করে এবং তার নামের প্রথম দু’অক্ষর থেকে নামকরণ করে ১৯৯৫ সালে প্রকাশ করেন তাঁর পরবর্তী উপন্যাস ই. ই.। যদিও অষ্টাদশ শতকের পটভূমিতে রচিত ৯০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘দ্য বুকস অব জ্যাকব’ তাঁকে এনে দেয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তবে তাঁর রচিত উপন্যাস ‘ফ্লাইটস্’ পোলিশ ভাষায় যার শিরোনাম ‘বাইগুনি’ তাঁকে এনে দেয় সম্মানজন ম্যান বুকার পুরস্কার এবং পোল্যান্ডের সবচেয়ে সম্মানজনক নাইক পুরস্কারও। তোকারচুকের সামগ্রিক সাহিত্যেকর্ম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তিনি স্থানিক আবর্তে থেকে সারা বিশ্বকে অবলোকন করেছেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। তিনি তাঁর সমসাময়িক সময়কে উপস্থাপন করতে গিয়ে দারস্থ হয়েছেন ইতিহাসের এবং পৌরাণিক উপাদানগুলোকেও গ্রহণ করেছেন সাদরে। তিনি তাঁর। পাঠকদের উৎসাহিত ইতিহাসকে অধ্যয়ন করতে বারবার আর সেখান থেকে পাঠ নিয়ে ভবিষ্যৎ ইউরোপের একটা নতুন রূপরেখা তৈরির। যদিও তিনি ‘দ্য বুকস্ অব জ্যাকব’কে সাজিয়েছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর আবর্তে কিন্তু নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বিংশ শতকের তাঁর সমসাময়িক সময়ের ভাবধার আবার তা একুশ শতকেও যথেষ্ট যৌক্তিক। পৃথিবীর অন্য অংশের সাথে ইউরোপের বড় ধরনের বিভক্তি যা ক্রমে বেড়ে গিয়ে তা সমস্যাকেন্দ্রিক বৈচিত্র্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়েও তাঁর সচেতনতা ও উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেয়েছে লেখনিতে। বর্তমান পৃথিবীর অসহিষ্ণুতার চিত্র যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, ঠিক তেমনি সহিষ্ণু হবার পাঠও দিয়েছেন। আবার উপনিবেশবাদের প্রত্যেক্ষ প্রভাব চলে গেলেও পরোক্ষভাবে যে তা অন্যভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে প্রকটভাবে সেই ইঙ্গিত যেমন মিলে তেমনি পুঁজিবাদের চরম উত্থানকেও তিনি তুলে ধরেছেন যা তাঁর মতে মোটেও মঙ্গলজনক নয় একটি একটি শ্রেণীহীন পৃথিবী বিনির্মাণে।

আবার তোকারচুককে তাঁর চিন্তা চেতনায় যে যথেষ্ট আধুনিক তা তাঁর রচনায় স্পষ্ট। তিনি যেমন প্রাচীন এবং পৌরাণিক উপাদানগুলোকে তুলে এনেছেন ঠিক তেমনভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকেও স্বীকার করে নিয়েছেন। বর্তমান বিশ্ব যে বিজ্ঞান-নির্ভর, প্রযুক্তির নতুন নতুন বিস্ময়কর আবিষ্কারসমূহ সব কিছুকে করে দিচ্ছে সহজ এবং তার বিপরীতে অবস্থান করলে যে সাহিত্যেও অচল তা তিনি অনুধাবন করতে ভুল করেন নাই। কথায় আছে প্রকৃত লেখক তিনি যিনি পাঠকের মন পড়তে পারেন। তিনি এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত সার্থক। তাঁর উপন্যাস ‘ফ্লাইটস’কে তিনি একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া বলে মনে করেন যেখানে তিনি আধুনিক ভ্রমণের সব দিক তিনি এখানে তুলে ধরেছেন পুঞ্জিভূত কাহিনীর মাধ্যমে। আবার ঐতিহাসিক শরীরবিদ্যা, মানব শরীর সংরক্ষণ বিষয়ে আগ্রহ আবার নেদারল্যান্ডসে আবাসিক লেখকের মর্যাদায় থাকাকালীন সময়ে এইসব পরীক্ষা করা, শরীরবিদ্যার জাদুঘরে অধিক সময় কাটানো এবং হাজেনের প্রদর্শনী দেখা ইত্যাদি অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগান এই উপন্যাসে। তাই তিনি যে শুধুমাত্র একজন লেখক নন, একজন গবেষকও তা প্রতীয়মান। যদিও অনেক সমালোচক মনে করেন তাঁর লেখা বেশি বর্ণনাধর্মী। এতো বর্ণনার ঘনঘটা না থাকলেও চলে। এইক্ষেত্রে তিনি মনে করেন সাহিত্য হল গবেষণার আর তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার ফল। তিনি যখন নিজে পাঠকের আসনে থাকেন তখন সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা না পেলে সেই সাহিত্যে তাঁর কাছেও আকর্ষণীয় মনে হয়না। কারণ সাহিত্যে যথার্থতার মর্যাদা পেতে গেলে তার প্রতি পাঠকের আকর্ষণবোধের জায়গাটা তৈরি করতে হবে বলে তিনি মনে করেন যাতে কোন উপন্যাস একবার পড়া শুরু করলে তা এমন একটা অনুভূতি সৃষ্টি করবে যে অনুভূতি পাঠককে পুনর্বার তার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য করবে।

তাঁর লেখায় আর একটা বিষয় ফুটে উঠেছে আর তা হল বর্তমান পৃথিবীর সবার মধ্যে যথার্থ আত্মপরিচয় খোঁজার প্রবণতা। কেউ যেন তার অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। ধর্ম পরিবর্তন, দেশান্তরিত হওয়া, খ-তা, বিভক্তি এইসব বিষয়গুলো বারবার তুলে এনেছেন। তিনি নিজেকে চিন্তাশীল এবং সংবেদনশীল লেখন মনে করেন আর তা প্রকাশ পায় যখন তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনের মত পৈশাচিক ঘটনায় খুব পীড়ন অনুভব করেন। তিনি ঐক্য চান, বিশ্বকে জানতে চান, নারীর মুক্তিকামিতাও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সমৃদ্ধ সাহিত্যেভা-ারে। গভীর মমতার সাথে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে সীমারেখা ভেঙে চলা মানবজীবনের চিত্র এঁকে যাওয়া পরিশ্রমী লেখক ওলগা তোকারচুক তাঁর। সাহিত্যেকর্মের জন্য ২০১৮ সালে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ১৫ তম নারী হিসেবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট