চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কর্ম, মৃত্যু এবং রুগ্নতা (একটি রূপকথা)

অনলাইন ডেস্ক

২৬ অক্টোবর, ২০১৯ | ৪:৪১ অপরাহ্ণ

দক্ষিণ আমেরিকান ভারতীয়দের মধ্যে একটা রূপকথা প্রচলিত আছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন ঈশ্বর প্রথমে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে কোন কাজ করতে না হয়। তাদের ঘরবাড়ির দরকার পড়েনি, পড়েনি কাপড় চোপড়ের,খাদ্যেরও। তারা সবাই একসাথে বসবাস করতো  এবং যতদিন পর্যন্ত সংখ্যায় একশো ছাড়িয়ে যায়নি ততদিন পর্যন্ত অসুখ কি জিনিস সেটা  তারা অনেকেই জানতো না। কিছুদিন পর, ঈশ্বর যখন তাকালেন কিভাবে মানুষ জীবনযাপন করছে, তখন তিনি দেখতে পেলেন সুখে শান্তিতে বসবাস করার বদলে মানুষ ঝগড়া ঝাটিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল। সবাই নিজ নিজ স্বার্থের প্রতি মনোযোগী পড়ল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে জীবনটাকে তারা অভিশপ্ত মনে করতে শুরু করল।

ঈশ্বর নিজেকে বললেন, ‘এটা হয়েছে কারণ তারা একা এবং নিজের জন্য বাস করছে বলে। এ অচলাবস্থা দূর করতে ঈশ্বর এমন সব পরিকল্পনা আঁটলেন মানুষের পক্ষে একা বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে তারা ঘর তৈরি করা শুরু করল এবং ক্ষুধা নিবৃত্তে মাটি খনন করে চাষাবাদ শুরু করল। ফলমূল ও শস্যাদি উৎপাদন শুরু করল। ক্রমে তারা কর্মমুখী হয়ে পড়ল। ঈশ্বর ভাবলেন, ‘কাজের মাধ্যমে তারা একতাবদ্ধ হবে’। একা একা তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় কর্মগুলো যেমন- নিত্য ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি তৈরি করবে , কাঠ কেটে, প্রক্রিয়াকরণ করে পরিবহনের ব্যবস্থা করবে, ঘর তৈরি করবে, বীজ রোপণ , শস্যাদি ঘরে তুলবে, সুতা উৎপাদন, বোনা, এবং কাপড় তৈরি করবে। একত্রে কাজ করতে গিয়ে তারা  বুঝতে পারবে  আন্তরিকভাবে কাজ করলে তারা অধিক উপার্জন করতে পারবে এবং সুন্দরতম জীবন যাপনের সুযোগ পাবে।’

সময় গড়াতেই ঈশ্বর আবার দেখতে এলেন মানুষজন  সংখ্যায় কত হলো এবং তাদের ক’জন সুখী জীবনের অধিকারী হয়েছে। কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন তারা আগের চেয়ে আরো খারাপ অবস্থানে আছে। তারা একসাথে কাজ করেছে বটে ( যেটা তারা না করে পারেনি) , তবে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে। এক দল আরেক দলের অধিকার ছিনিয়ে নিতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হয়ে সময় নষ্ট করেছিল। নিজেদের মধ্যে কলহ- বিবাদে জড়িয়ে নিজেদের অবস্থানকে আরো দুর্বল করে ফেলেছিল তারা।

এটা দেখে ঈশ্বর  নতুন সিদ্বান্তে পৌছালেন যেহেতু আগের সিদ্ধান্তে সুফল আসেনি।  তিনি তাদের মৃত্যুর সময়ক্ষণ অনিশ্চিত করে দিলেন এবং এ সিদ্ধান্তের কথা সবার মধ্যে পৌছে দিলেন।

‘যেকোন মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে’ এ কথা জানতে পেরে ঈশ্বর ভাবলেন, তারা নিজেদের জন্য বরাদ্দ  সময়টুকুর অপচয় করবে না। কিন্তু হিতে বিপরীত হল। ঈশ্বর যখন আবার দেখতে এলেন, দেখতে পেলেন তাদের জীবন আগের মতোই শোচনীয় অবস্থায় আছে। তাদের মধ্যে যারা শক্তিধর তারা ‘মানুষ যেকোন সময় মারা যেতে পারে’ এ তথ্যের সুযোগ নিয়ে , দুর্বলদের অধীনস্থ করে নিল, কাউকে  কাউকে হত্যা করল এবং অন্যদেরকে হত্যার হুমকি দিয়ে বসল।

এটা ঘটল যে শক্তিধর গোষ্টী এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অলসতার ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করল, এবং যারা দুর্বল তারা সাধ্যতীত পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়ে আরো দুর্বল হয়ে পড়ল। এক দল আরেক দলকে ঘৃণা করতে শুরু করল। জীবন আগের চেয়ে আরো অবর্ণর্নীয় দুঃখের সাগরে পরিণত হল।

এত সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ঈশ্বর এবার শেষ পদক্ষেপ নিলেন উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে। তিনি মানুষের জীবনে সব রকম রোগ-বালাই পাঠিয়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন যারা সুস্থ থাকবে তারা অন্যদের সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব নিবে এবং পালাক্রমে এটা চলতে থাকলে নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সমানুভূতির জন্ম নেবে। ঈশ্বর পরেরবার যখন ফিরে এলেন  মানুষের অবস্থা দেখতে তিনি দেখলেন সবাই অসুস্থতার কবলে পড়ে বেহাল জীবনযাপন করছিল। যে অসুস্থতা ঈশ্বর পাঠিয়েছিলেন বান্দাদের একত্রিত করার উদ্দ্যেশ্যে সেটার হিতে বিপরীত  ঘটল। অনৈক্য আরো বেড়ে গেল। যারা সুস্থ সবল ছিল তারা অসুস্থদের সেবা করার পরিবর্তে তাদেরকে বাধ্য করেছিল শোক করতে। রুগ্ন শরীরে রাতদিন খাটুনি করে অসুস্থ ও সহায়হীনরা একেবারে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হল। শেষে দুর্বলেরা যখন প্রায় সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ল তখন ধনবানেরা তাদের দোষারোপ করতে শুরু করল রোগের উপদ্রবের জন্য। তাদের অচ্ছুত ঘোষণা করে বসল ধনীক শ্রেণী।

ঈশ্বর তখন নিজে নিজে বললেন, ‘এরপরও যদি মানুষ নিজেদের সুখ শান্তির ব্যবস্থা নিজেরা করতে পারে তাহলে তারা এভাবে ভোগান্তির মাধ্যমে একটা শিক্ষা পাক।’ এবং ঈশ্বর মানুষকে পরিত্যাগ করলেন।

ঈশ্বর কর্তৃক পরিত্যাক্ত হবার অনেক দিন পর্যন্ত মানুষ নিজেদের সুখ নিজেরা খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে এসে বুঝতে পারল কেউ কারো দাস-দাসী নয় এই জগতে। সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য সমান এবং একতাই বল। তারা বুঝতে পারল মৃত্যুর খড়্গ সার্বক্ষণিক তাদের ওপর ঝুলছে এবং তাদের উচিত তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময়টুকুর যথোপযুক্ত ব্যবহার করে  একতাবদ্ধ হয়ে ভালোবাসা। তারা বুঝতে পারল রূগ্নতা অনৈক্য-বিভেদ তৈরির পরিবর্তে সকলকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ হবার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দেয়।

মূলঃ লিও তলস্তয়

রূপান্তরঃ আলমগীর মোহাম্মদ

শিক্ষক, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্বকোণ/টিএফ

শেয়ার করুন