চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দীপক চৌধুরী দ্রোহী চৈতন্যের বিশ্বস্ত নাট্যকার

ড. ইউসুফ ইকবাল

২৫ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ধারাটি বহুমাত্রিক নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ। এ সময় নাটকের বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, বর্ণনাকৌশল এবং নির্মাণ ও উপস্থাপনে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিলক্ষিত হয়। সমকালীন সময় ও মানুষের যাপিত জীবনের নানা সংকট ও ক্ষত উন্মোচিনের পাশাপাশি অতীত জীবনের বহুবর্ণিল রূপ অনুসন্ধানের চেষ্টাও করেছেন নাট্যকারেরা। বিষয় ও বক্তব্যে বহুমাত্রিকতা থাকলেও এ বিস্তৃত নাট্যচর্চার অভ্যন্তরভাগে সবসময় একটা অভিন্ন সুর প্রবহমান ছিল। তা হলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চেতনার সুর। বলা অসংগত হবে না- স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় উন্মেষকালের মুল সুরই ছিল এ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চেতনা। এ চেতনায় বিশ্বস্ত থেকে বাংলাদেশে যে কয়জন নাট্যকার এখনো সক্রিয়ভাবে নিবেদিত, তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের দীপক চৌধুরী অন্যতম। তার প্রতিটি নাটকের চরিত্রে বা সংলাপে দ্রোহী চৈতন্য স্পষ্ট। জঙ্গীবাদ, মৌলবাদসহ সাম্প্রদায়িক যেকোন অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি সবসময় প্রতিবাদ মুখর। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সকল অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি সতত প্রতিবাদমুখর। তাই, দ্রোহী চৈতন্যের বিশ্বস্ত নাট্যকার হিসাবে দীপক চৌধুরী আমাদের গভীর অভিনিবেশ দাবি করে।

নাট্যকার দীপক চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৮ সালে। জন্ম ও বেড়ে ওঠার স্থান ৬৮, শিববাড়ি লেন, ফিরিঙ্গিবাজার, চট্টগ্রাম। আদিনিবাস পটিয়ার দক্ষিণ ভূর্ষি গ্রাম। পটিয়ার জমিদার গৌরিশংকর চৌধুরী ও নবকিশোর চৌধুরীর তিনি অধস্তন চতুর্থ পুরুষ। পিতা সৌরিন্দ্র্র্রনাথ চৌধুরী এবং মাতা দীপালি রানী চৌধুরীর পাঁচ সন্তানের মধ্যে দীপক চৌধুরী চতুর্থ। পড়ালেখার হাতেখড়ি চট্টগ্রামের জেএম সেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জেএম সেন উচ্চবিদ্যালয়ে মাধ্যমিকের পাঠ শেষ করে তিনি ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজে। এখানে তিনি উচ্চমাধ্যমিক ও ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর পর বঙ্গবন্ধু আইন কলেজে পর্যাপ্ত পাঠ নিয়ে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে যান আইন পেশায়।

নাট্যকার দীপক চৌধুরী বেড়ে উঠেছেন পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহে। তাঁর পরিবার পূর্বপুরুষের পরি¯্রুত সাংস্কৃতিক চেতনার সার্থক উত্তরাধিকার। পূর্বপুরুষের ছিল নাটকের প্রতি প্রবল আগ্রহ। পূজাপার্বণে জমিদার বাড়িতে বসতো নাটকের আসর। নাটকের নির্দেশনা, অভিনয় সহ মঞ্চায়নের যাবতীয় কাজে স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেন তাঁর প্রপিতামহবৃন্দ। মাতৃদেবী ছিলেন সাহিত্য ও সংগীত অনুরক্ত। সন্তানদের সংগীত শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছেন। হাত ধরে তাদের নিয়ে যেতেন যাত্রাপালার আসরে। এই সাংস্কৃতিক পরিম-ল দীপক চৌধুরীর মানস গঠনে প্রভূত সহযোগিতা করেছে।

দীপক চৌধুরী সচেতনভাবেই যুক্ত হয়েছেন নাট্যচর্চায়। তাঁর প্রবল আগ্রহ এবং ‘ধ্রুপদী’ নাট্যদলের জেষ্ঠ্যকর্মী আমিনুল হক ও আবদুল মাবুদ দোভাষের অনুপ্রেরণায় ১৯৭৭ সালে অভিনেতা হিসাবে তিনি যোগ দেন নাট্যদলে। এর পর ১৯৮৩ সালে ‘চট্টগ্রাম থিয়েটার’ ব্যানারে নিজেই গড়ে তোলেন নাট্যদল। এ দলের হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে তিনি সমর্পণ করেছেন নাট্যচর্চায়। কালের বর্তমান প্রান্তে এসে বলা যায়- বিগত চারদশকের চিন্তা ও চর্চায় নিজেকে অসামান্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। আশির দশকের মধ্যভাগেই খ্যাতমান নাট্যজন হয়ে ওঠেন দীপক চৌধুরী। এসময় বাংলাদেশ অতিক্রম করছিল সুস্পষ্ট এক গ্রহণকাল। একদিকে সামরিক স্বৈরাচারের বুটের আঘাত আর অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠীর তীব্র উত্থান জাতির জীবনে নিয়ে আসে ঘোর অমানিশা। গণতন্ত্র, আইন, সংবিধান, মুক্তবুদ্ধি, মানবতা, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ জাতির সকল অর্জন কলুষিত হয়েছে এ কালখন্ডে। এ অরাজক পরিস্থিতির বিরূপ বাস্তবতায় বসে দীপক চৌধুরী নাট্যচর্চায় নিবেদিত থেকেছেন। অভিনেতা হিসাবে নাট্যজগতে এলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন নাট্যকার হিসেবে। নির্দেশক, নাট্যসমালোচক এবং প্রাবন্ধিক হিসাবেও তিনি পরিচিত।

দীপক চৌধুরীর প্রকাশিত নাটকের সংখ্যা ৪০টি। অধিকাংশই পথনাটক। প্রথম প্রকাশিত নাটকের নাম ‘বস্তি’। এটিকে তিনি মুক্তাঙ্গন নাটক হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। দীপক চৌধুরী আরণ্যক পরিচালিত মুক্তনাটক দলের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। গড়ে তুলেছেন মুক্তনাটকের সংগঠন। এই কর্মসূচি তাঁর পথনাটক রচনায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া, তাঁর সমকালীন নাট্যকারদের মধ্যে সবাই পথনাটক রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন : মলয় ভৌমিক, মান্নান হীরা, প্রদীপ দেওয়ানজী, অভীক ওসমান, শংকর সাওজাল প্রমুখ। পথনাটক আঙ্গিকে রচিত তাঁর নাটকগুলোতে বিষয় বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে- প্রতিবাদ প্রতিরোধ চেতনা তার নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সামাজিক অবক্ষয়, শোষক শোষিতের দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি-সমাজ ও সময়ের নানা সংকট প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নাটকে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকে তিনি পরাজীত শত্রুর উত্থানজনিত কারণে স্বপক্ষীয় শক্তির মনোবেদনাকে তুলে ধরেছেন। স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িক শক্তি, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধী প্রভৃতি অপশক্তির বিরুদ্ধে স্পষ্ট বক্তব্য উঠে এসেছে। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো : ‘স্বাধীনতার ময়নাতদন্ত’ ‘টোকাই’ ‘বাঘ সাবধান শিয়াল আসছে’ ‘পরাজয়ের পালা’ ‘আজকের সমাচার’ ‘রাজা এলেন রাজাকার’ ‘একাত্তরের শকুন’ ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ ‘লেখাপড়া’ ‘শুল রাজার দেশে’ ‘শিখা চিরন্তন’ ‘গণ-আদালত’ ‘অদ্ভুদ আঁধার এক’ ‘বৃদ্ধাশ্রম’ ‘মজদুর’ ‘সম্প্রীতি’ ‘কারাগার’ ‘হরিজন দর্পণ’ ‘সামনে লড়াই কমরেড’ প্রভৃতি। তার নাট্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ চট্টগ্রামের ‘অনন্য থিয়েটার’, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’, ঢাকার নাট্যদল ‘সময়’ এবং ‘আর্তনাদ থিয়েটার’; চট্টগ্রামের নাট্যপত্রিকা ‘নাট্যমঞ্চ’ বিভিন্ন সময় তাঁকে সম্মাননা জানিয়েছেন।

দীপক চৌধুরীর নাটক দ্রোহী চৈতন্যের বিশ্বস্ত নাট্যভাষ্য। অতীতের রঙিন লোকজীবন বা ভবিষ্যতের রোমান্টিক স্বপ্নকল্পনার চাইতে বর্তমানের রূঢ় বাস্তবতাকে তিনি অধিক পছন্দ করেন। একারণে সমকালের দর্পন হয়ে ওঠে তাঁর নাটক। পুরো আশির দশকে স্বৈরাচার ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে অব্যর্থ অস্ত্র হিসাবে তাঁর নাটক প্রদর্শিত হয়েছে। তাঁর নাটক আড়ম্বরমুক্ত, ঋজু, নির্ভার, টানটান। তিনি আটপৌরে ভাষায় রচনা করেন সংলাপ। অপ্রয়োজনীয় কথার জঞ্জাল নেই তাঁর নাটকে। সরাসরি তিনি পৌঁছে যান সমস্যার কেন্দ্রে। দর্শকের চেতনাকে স্পর্শ করে তাকে উদ্দীপিত করাই তাঁর প্রধান লক্ষ হয়ে ওঠে। ফলত, সাধারণ দর্শকও তাঁর নাটকের সংলাপে একাত্ম হতে পারেন। নাটকের বক্তব্য কথা দর্শকচেতনাকে নাড়া দেয়। আশির দশকে প্রদর্শিত নাটকগুলোই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাঁর নাটকের তীক্ষœ সংলাপ সমকালের অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে তীব্রভাবে আহত করেছে। অনেকেই সংলাপের শক্তিকে সহ্য করতে পারেননি। দীপক চৌধুরীর নাটকের প্রদর্শনী চলাকালীন বহুবার আক্রমণের শিকার হয়েছে ‘চট্টগ্রাম থিয়েটার’এর কর্মীরা। ‘আজকের সমাচার’ ‘রাজা এলেন রাজাকার’ প্রভৃতি নাটক প্রদর্শনীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, হাটহাজারী, মহসিন কলেজ, মুসলিম হল, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ও স্বৈরাচারের পেটোয়া বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয় দীপক চৌধুরীর দল। সবচেয়ে বীভৎস হামলার শিকার হন ১৯৮২ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদিঘি মাঠে ‘রাজা এলেন রাজাকার’ মঞ্চায়নকালে। তৎকালীন আট দলীয় জোটের নেত্রী শেখ হাসিনার জনসভামঞ্চে নাটকটি প্রদর্শিত হচ্ছিল। নাটক চলাকালীন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের অনুগত বাহিনী অতর্কিতে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে চব্বিশ জনকে। গুলিবিদ্ধ হন অজ¯্র মানুষ। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান জননেত্রী। সেদিন দীপক চৌধুরীর দলের সবাই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ নাটকটি এই নির্মম ঘটনাকে অবলম্বন করেই তিনি রচনা করেছেন। উক্ত ঘটনাকে নিয়ে এটিই একমাত্র নাটক। বাংলাদেশে পথনাটকের তেজোদ্দীপ্ত ধারাটি আজ অনেকটা বিলুপ্তপ্রায়। এ বৈরীকালে দীপক চৌধুরী এখনো শিল্পের এ ধারাটিকে পরম মমতায় পরিচর্যা করছেন। বলা যায়, পথনাটকের বন্ধুর প্রান্তরে তিনি আজ অনেকটা নিঃসঙ্গ শেরপা।

দীপক চৌধুরী খ্যাতি বা মোহের বশবর্তী হয়ে নাট্যচর্চা করেন না। নাট্যচর্চাই তাঁর কাছে জীবনচর্চা। তাঁর কাছে নাটক, জীবন আর সংগ্রাম সমার্থক। কোন ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের জন্য তিনি নাটকের সংলাপ রচনা করেননি। নাটককে কখনো বিক্রি করেননি। দাতাপ্রভুর প্রজেক্ট প্রপোজাল বাস্তবায়নের উপকরণ হিসাবে নাটককে কখনো তিনি ব্যবহার করেননি। নাট্যবিশ্বাসকে তিনি ব্যবহার করেন মানুষের মুক্তির স্বপক্ষে সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়ক শক্তি হিসাবে তাঁর নাট্যচিন্তা নিবেদিত। একারণেই তিনি তরুণ নাট্যকর্মীদের জন্য একজন অনুকরণীয় আইকন। মুক্তিযুদ্ধের শত্রুমিত্র চিহ্নিতকরণে, শোষণের স্বরূপ উন্মোচনে, শোষিতের যন্ত্রণা অনুধাবনে এবং মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ বিনির্মাণে দীপক চৌধুরীর নাটক আগামী প্রজন্মের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট