চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

শেষের কবিতা

পুনর্পাঠ ও মূল্যায়ন শাকিল আহমদ

১০ মে, ২০১৯ | ১:০৯ পূর্বাহ্ণ

মূলত আঠার শতকে ইউরোপের দেশগুলিতে বিশেষ করে ইংল্যান্ড সাহিত্যে উপন্যাস শিল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ। ইংল্যান্ড অপেক্ষায় প্রায় দেড়শত বছর পরে অর্থাৎ উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা উপন্যাসের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাও ইংরেজ শাসকদের সভ্যতার বহুমুখী বাস্তব প্রয়োজনে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লেখকদের হাতে এই গদ্যশিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে। জীবনের নিকটতম শিল্পরূপ বলেই দ্রুততম সময়ে বিশেষ করে বিশ শতকের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সময় থেকে দেশ-কাল, সমাজ-সংস্কৃতির জটিল ও বঙ্কিম চিহ্ন ধারণ করে গদ্যশিল্প পল্লবিত হয়ে ওঠে। আর এই আধুনিক সাহিত্যের সবকটি শিল্পমাধ্যমই মূলত রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই লালিত-পালিত ও ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। সাহিত্যের আধুনিকতা সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেনÑ নদী যেমন বাঁক ফেরে সাহিত্য ও তদরূপ গতি বদলায়। আর এই গতি বদলানোই হচ্ছে আধুনিক, ইংরেজিতে যাকে বলে গড়ফবৎহ.
উপন্যাস আধুনিক শিল্পমাধ্যম আধুনিক গদ্য শিল্পীদের হাতে এই শিল্পমাধ্যমটি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে সৃজনশীল এক ঋদ্ধ শিল্পমাধ্যমে এসে উপনীত হয়েছে। উপন্যাস জীবনের সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত মহাকাব্যরূপী এক অনন্য শিল্প মধ্যম। একটি সফল উপন্যাসের সাথে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তির মৌল প্রশ্নাবলী পরিবার, সমাজ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রতিবেশের বিশাল পটভূমি।
শেষের কবিতা’ রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের কথাসাহিত্য। এটি ১৩৩৫ সালে রচিত এবং ১৩৩৬ সালে পরিমার্জনের পর প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রে ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আসা সার্বিক বিচারে শেষের কবিতা শৈল্পিক উৎকর্ষতায় ও এক চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। তাঁর কথাসাহিত্যের প্রথম ধাপের উপন্যাস ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ এবং ‘রাজর্ষী’র শৈল্পিক অবয়ব এবং ভাষাগত দিকে যে বঙ্কিম চালে আক্রান্ত ছিলো, তা থেকে বেড়িয়ে সম্পূর্ণ একটি স্বতন্ত্র রাবীন্দ্রিক ধারার চূড়ান্ত রূপ তার পরিণত বয়সের কথাসাহিত্যগুলো।
ভাষার ও উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে মূলত বাংলা গদ্যের শালীন চলতি রীতির বিকাশ লাভ করে প্রমথ চৌধুরী এবং রবীন্দ্রনাথের হাতেই। প্রমথ চৌধুরী যথার্থই বলেছেনÑ ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে। কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলেই মুখে শুধু কালি পড়ে। মূলত রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজ পত্র’কে অবলম্বন করেই চলতি রীতির প্রচলন শুরু করেন এবং যথার্থ শালীন কথ্যভাষা বাংলা গদ্যেরূপ লাভ করে। আমরা ‘শেষের কবিতা’ পাঠে অনুধাবন করতে পারিÑ এক মাধুর্যময় গভীর ও শালীন কথ্যভাষায় কাহিনী পল্লবীত হয়ে উঠে। এ ভাষা শুধুমাত্র কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, রবীন্দ্রনাথ ক্রমাগত চর্চা করেছেন, প্রবন্ধ, সমালোচনা, শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত ভাষণ বৈজ্ঞানিক নিবন্ধসহ যাবতীয় গদ্য রচনায়ও। সুতরাং ভাষাশৈলীর ক্ষেত্রেও ‘শেষের কবিতা’ রবীন্দ্রনাথের গদ্য শৈলীর এক নিপুণ সৃষ্টি।
রবীন্দ্রনাথকে যখন বুঝার বয়স হয় নি, তখন থেকেই অনেকের মতো আমারও রবীন্দ্র সাহিত্য পড়া শুরু। আর যখন একটু একটু বুঝতে শিখি তখন এম এ শেষ পর্বের ক্লাসে এসে একদিন আমাদের জ্যোতিময় শিক্ষক ময়ুখ চৌধুরী ‘রক্ত কবরী’ পড়াতে গিয়ে বললেনÑ একবার পড়লে কিছুই বুঝবেন না, কষ্ট করে দু’বার পড়লে, তৃতীয়বার পড়তে ইচ্ছে করবে, আর তৃতীয়বার পড়লে জীবনে বারবার পড়তে ইচ্ছে করবে,Ñ এই হলো রবীন্দ্রনাথ। স্যারের কথাটিই আজ পরম সত্য হয়ে ধরা দিল। ‘শেষের কবিতা’ প্রথম পড়ি স্কুলগ-ী অতিক্রম করার একটু আগে। বিশ^বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়তে গিয়ে আর একবার পড়েনি। সে থেকে সিকি শতাব্দী পর এসে বার কয়েক পড়ে নিলাম ‘শেষের কবিতা’। কারণ যতই পাঠ করছি, যেন নতুন রথে, নতুন স্বাদে সিক্ত হচ্ছি।
রবীন্দ্রনাথ যে কোন কিছুকেই আংশিক দৃষ্টি দিয়ে না দেখে হৃদয়ের সমগ্রতা দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন। আর সেটি প্রকৃতির রূপ-রস-মানবকল্যান-সৌন্দর্য চেতনা কিম্বা ধর্মবোধ যাই হোক না কেন।
বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে ধর্মনীতি এবং সমাজনীতিকে বড় করে উপলব্ধি করেছেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ মানুষকে শ্রদ্ধা এবং ব্যক্তিত্বের আসনে বসার চেষ্টা করেছেন। আর এখানেই তিনি বঙ্কিমচন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এমন কি তিনি প্রকৃতিকেও কখনো শুধুমাত্র জড় ও বস্তু হিসাবে বিবেচনায় রাখেন নি। তিনি প্রকৃতিকে এক প্রভাবশীলরূপে বহুবিচিত্রভাবে প্রয়োগ দেখিয়ে উপন্যাসে নানা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন। শেষের কবিতায় প্রকৃতির উপাদানকে তিনি রূপ-রস-চিত্রকল্পে উপস্থাপন করে এক অপার সৌন্দর্য চেতনার জন্ম দেন। কাহিনীর অংশও নির্বাচন করেন শিলং পাহাড়ের এক নির্জন স্থান। “ফুলে আচ্ছন্ন গোলাপের লতা; এক ধারে সূর্যমুখীর ভিড়, আর এক ধারে চৌকো কাঠের টবে চন্দ্রমল্লিকা। ঢালুঘাসের খেতের উত্তর প্রান্তে এক মস্ত য়ুক্যালিপ্টস্ গাছ। তারই গুড়িতে হেলান দিয়ে সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে লাবণ্য। ছাই রঙের আলোয়ন গায়ে, পায়ের উপর পড়েছে সকালবেলার রোদদুর। কোলে রুমালের উপর কিছু রুটির টুকরো, কিছু ভাঙা আখরোট। আজ সকালটা জীবসেবায় কাটাবে টাউরেছিল। তাও গেছে ভুলে। অমিত কাছে এসে দাঁড়ালো, লাবণ্য মাথ্য তুলে তার মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল। মৃদু হাসিতে মুখ গেল ছেয়ে। অমিত সামনা সামনি বসে বললে, ‘সুখবর আছে। মাসিমার মত পেয়েছি।’ লাবণ্য তার কোন উত্তর না করে অদূরে একটা নিষ্ফলা পিচগাছের দিকে একটা ভাঙা আখরোট ফেলে দিলে, দেখতে দেখতে তার গুড়ি বেয়ে একটা কাটবিড়ালি নেমে এল। এই জীবটি লাবণ্যর মুষ্টি ভিখারী দলের একজন। অমিত বললে, ‘যদি আপত্তি না কর, তোমার নামটা একটু ছেঁটে দেব। তা দাও।’ তোমায় ডাকার বন্য বলে।”
চরিত্র সৃষ্টি উপন্যাসের অন্যতম শর্ত হলেও পারিপাশির্^কতা, সমাজ সভ্যতার অনিবার্য প্রয়োজনে প্রতিটি চরিত্রকে যথাযথভাবে রূপায়ন করেন। এখানে কোন মেদ বহুল চরিত্র ও কাহিনী গড়ে উঠেনি। চরিত্রের প্রয়োজনের খাতিরে চরিত্র, এমনটি কখনো মনে হয় নি। বিশেষ করে গৌণ চরিত্রÑ সিসি, লিসি, শোভনলাল, কেটিমিত্র, নরেন, যদুশঙ্কর গাঙ্গুলী, যোগমায়া, অবনীশ দত্ত, সুরমা এদের উপস্থিতি উপন্যাসের প্রয়োজনেই যেন অনিবার্য হয়ে ধরা দিয়েছে। লঘুসুরে অনেক গভীর কথা বলার চেষ্টা করেছেন লেখক। হালকা রসবোধের সাথে জীবনের গভীরতম দ্বন্দ্ব-সংঘাত-ট্রাজিডিকেও প্রবাহমান রেখেছে।
নিরীক্ষাধর্মী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে অধিক বৈচিত্র্যতাও নিরীক্ষার চেষ্টা করেছেন উপন্যাস সৃষ্টিতে। তাঁর উপন্যাস গুলোকে বোদ্ধা আলোচকরা কয়েকটি ভাগে শ্রেণীকরণ করার চেষ্টা করেছেন। সেক্ষেত্রে ‘শেষের কবিতা’য় নরনারীর প্রেমলীলা কে উপজীব্য করে কাহিনী পল্লবিত হয়ে উঠলেও বাংলা সাহিত্যের অপরাপর এ ধারার উপন্যাস থেকে স্বতন্ত্র। এখানে প্রাধান্য পেয়েছে নরনারীর বুদ্ধিবৃত্তি, পরিমিত হৃদয়াবেগ ও নিয়ন্ত্রণশক্তি, যা উপন্যাসটিকে উচ্চমাত্রায় আসীন করেছে। সেক্ষেত্রে সাহিত্যে নতুন আবিষ্কারের উৎস সন্ধানে রবীন্দ্রনাথ সমসাময়িক পাশ্চাত্য উপন্যাসরীতিকে আত্মস্থ করে বাংলা সাহিত্যে নবতর নিরীক্ষায় সফল হয়েছেন। শেষের কবিতার নায়ক-নায়িকা আধুনিক, পাশ্চাত্য চিন্তা চেতনায় ঋদ্ধ ও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। অমিত রায় ব্যারিস্টার আর লাবণ্য এম এ পাশ করা। দুজনের মধ্যেই আছে রুচিশীলতা, সুফল মানসিকতা ও নিজস্ব স্টাইল। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অমিত রায় বুঝার চেষ্টা করেছেনÑ ফ্যাশন আর স্টাইল এক জিনিস নয়, ফ্যাশন পরিবর্তনশীল বা চলমান। আর স্টাইল হচ্ছে একান্তই নিজস্ব। অর্থাৎ মুখেশ ও মুখশ্রীর মতো। অমিত রায় আর লাবণ্যের মধ্যে স্টাইল ছিল যা একান্তই নিজের মতো করে। কিন্তু ফ্যাশন সচেতনতার প্রতি আগ্রহ ছিল না। অপর দিকে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা অমিতের পরিবারের অন্য সদস্য সিসি-লিমি এবং কেটিমিত্রের মধ্যে ফ্যাশনসচেতনতা প্রবলভাবে লক্ষণীয়। এখানে বোধ করি ঔপন্যাসিক পাশ্চাত্য ভাবধারায় গড়ে ওঠা উচ্চ- মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনাচরণের প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে পাঠক সমাজকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন পাশ্চাত্য শিক্ষায়-শিক্ষিত হলেও নিজস্ব মন মানসিকতার কারণেই মূলত কেউ স্টাইল সচেতন, আর একই পরিবেশে বেড়ে ওঠে ও কেউ ফ্যাশন সচেতন। ‘শেষের কবিতা’ রচনার প্রায় শতাব্দীখাল পরে এসেও আজকের পাঠকেরও ঠিক একই অনুভূতি। আর এসব নানা কালাত্তীর্ণ অনুষঙ্গের কারণেই শেষের কবিতার আবেদন এখনো আকাশচুম্বী।
প্রেম-প্রকৃতি-রোমাঞ্চ এবং মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে একসূত্রে গেঁথে এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টিতে রবি ঠাকুরের পারঙ্গমতা অনুধাবন করা যায় তাঁর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে। শেষের কবিতায় এসেও অমিত-লাবণ্যের প্রথমদর্শনের মধ্যে এই কাব্যিক আবহ প্রবলভাবে লক্ষণীয়। ….. যে পথিক বধূকে এতকাল বসিয়ে রেখেছে সেই অবন্তিকা হোক বা মালবিকাই হোক, হিমালয়ের কোনো দেবদারুবনচারিণীই হোক। ওকে হয়তো কোনো একটা অভাবনীয় উপলক্ষে দেখা দিতেও পারে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে এসেই দেখলে। আর একটা গাড়ি উপরে উঠে আসছে। …. একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সদ্য-মৃত্যু-আশঙ্কার কালা স্পট খানা তার পিছনে তারই উপরে সে যেন ফুটে উঠল একটি বিদ্যুৎ রেখার আঁকা সুস্পষ্ট ছবি-চারিদিকের সমস্ত হতে স্বতন্ত্র। মন্দির পর্বতের নাড়া খাওয়া ফেনিয়ে ওঠা সমুদ্র থেকে এই মাত্র উঠে এলেন লক্ষ্মী সমস্ত আন্দোলনের উপরেÑ মহাসাগরের বুক তখনো ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে। দুর্লভ অবসরে অমিত তাকে দেখলো। ড্রয়িংরুমে এ মেয়ে অন্য পাঁচজনের মাঝখানে পরিপূর্ণ আত্মস্বরূপে দেখা দিত না। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোকও পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না।” তাদের প্রথম পরিচয় এবং প্রেমে পরার মধ্য দিয়ে নায়কের কলম থেকে প্রথম কবিতা কর্ষিত হলো।Ñ
“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
আমরা দু’জন চলতি হাওয়ার পন্থী।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত।”
প্রায় শত বছর পর এসেও এখনকার পাঠকের মনে জাগেÑ প্রথম কারো প্রেমে পরার মধ্যেও যে কবিতা সৃষ্টির এক অলৌকিক প্রবণতা তৈরী হয়, তা বোধ করি অমিত রায়ই প্রথম শিখিয়ে গেছেন। এবং এ ধারা আজও অব্যাহত আছে নব প্রেমে পড়া প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরে।
অনেক সমালোচক কেটিমিত্র চরিত্রটি পরিপূর্ণ, অপ্রয়োজনীয় এবং অস্পষ্টতা বলে মনে করেন। শেষের কবিতার শিল্পসৃষ্টিতে এক ধরনের দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেছেন কেটিমিত্র চরিত্রটি। মূলত কাহিনীতে রবীন্দ্রনাথ সীমা অসীমের ব্যবধান কে নিরূপণের চেষ্টা করেছেন বলেই শোভনলাল-কেটিমিত্র চরিত্রের অবতারণা করেছেন। এই দু’চরিত্র কাহিনীতে সংযোজিত না হলে পরে অমিত-লাবণ্যের অসীম প্রেমত্ববোধকে জাগিয়ে তোলা সম্ভবপর হতো না বলেই এই চরিত্রগুলোকে গৌণ কিংবা অপরিপক্ব করে দেখবার কোন সুযোগ নেই। কাহিনীকে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে চরিত্র গুলো অপরিহার্য ভাবে এসেছে।
উপন্যাসের ‘ঘটকালি’ পর্বে অমিত লাবণ্যের একান্তে প্রেমালাপ চলছিল। সুদূর শিলং পাহাড়ের পাদদেশে য়ুক্যালিপ্টাস্ গাছের নিচে আলাপ প্রসঙ্গে অমিত লাবণ্যকে সুদূর নোয়াখালি-চট্টগ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যায়Ñ “অথচ তোমাদের ওই তারিণী তলাপাত্র কলকাতার গোলদিঘি থেকে আরম্ভ করে নোয়াখালি চাটগাঁ পর্যন্ত চীৎকার শব্দে শূন্যের দিকে ঘুষি উচিয়ে বাঁকা পলিটিক্সের ফাঁকা আওয়াজ ছড়িয়ে এল, সেই দুর্দান্ত বাজে খবরটা বাংলাদেশের সর্বপ্রধান খবর হয়ে উঠল।” বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে (১৯২৮) লেখা শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নোয়াখালি, চাটগাঁ অঞ্চল পর্যন্ত ঘুরে আসতে গিয়ে দেশভাগের পূর্বের এই অঞ্চলকে বাংলাদেশই উল্লেখ করেছেন। শেষের কবিতার পাঠনিতে গিয়ে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠকদের শতবর্ষ আগের লিখা এই সংলাপটি পড়ে খানিকটা চমককৃত হবারই কথা।
উপন্যাসে অমিত লাবণ্যের সংলাপ এতোটাই উচ্চমানের ছিল যে, মনে হয় বাংলা কথা সাহিত্যে এসব তত্ত্বীয় এবং গভীর বাক্যের অবতারণা অন্য কোন কথাসাহিত্যিক নয়, শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব। লাবণ্যের সংলাপÑ “আচ্ছা মিতা, তুমি কি মনে কর না যেদিন তাজমহল তৈরি শেষ হল সেদিন মমতাজের মৃত্যুর জন্যে শাহজাহান খুশি হয়েছিল? তাঁর স্বপ্নকে অমর করবার জন্যেই এই মৃত্যুর দরকার ছিল। এই মৃত্যুই মমতাজের সবচেয়ে বড়ো প্রেমের দান। তাজমহলে শাহজাহানের শোক প্রকাশ পায় নি, তাঁর আনন্দ রূপ ধরেছে।” এসব কথপোকথনে শুধু অমিতকেই চমক লাগিয়ে দেয়নি, পাঠক সমাজকেও ভাবীয়ে তুলে, মগজে নতুন চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। আরো কয়েকটি সংলাপ এখানে সংযোজন করা যায়Ñ যে ছুটি নিয়মিত, তাকে ভোগ করা আর বাঁধা পশুকে শিকার একই কথা।” ‘শিমুল কাঠই হোক আর বকুল কাঠই হোক, যখন জ¦লে তখন আগুনের চেহারাটা একই। অধিকাংশ বর্বর বিয়েটাকেই মনে করে মিলন, সেই জন্য তারপর থেকে মিলনটাকে এতো অবহেলা।’ মূলত এটি রবীনাথের পরিণত বয়সের সৃষ্টিকর্ম বিধায় ভাবের জগতের এতোটা পরিপকতা পরিলক্ষিত হয়। বাক্য-বিন্যাস, বাস্তবধর্মী, উপমা, গঠনশৈলী ও ভাষা রীতির উৎকর্ষতায়ও ‘শেষের কবিতা’ যেন রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস-কাব্যের এক আন্তরিক শিল্প-প্রেরণায় নবতর কৌশল।
রবীন্দ্রনাথের চেতনা বা প্রতিভার মূলেই কিন্তু নীহিত আছে সুরের চেতনা। যার ফলে তাঁর কবিতার প্রতিভা, গানের প্রতিভা এমন কি ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটকের প্রতিভারও গীতিধর্মের সুর বিরাজমান থাকতে পারে এমনটি ভাবা সচেতন পাঠকের পক্ষে সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর কিছু গল্পকে গীতিধর্মী বলতে চেয়েছেন। আমাদের আলোচ্য বিষয় ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটির রচনাকালের এতো বছর পরও অনেক সময় বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়Ñ শেষের কবিতা কী কাব্যগ্রন্থ, না উপন্যাস! শেষের কবিতা উপন্যাস হলেও এটি একটি উৎকৃষ্ট কাব্যধর্মী উপন্যাস। কাব্যের বিশেষ গুণাবলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়Ñ কল্পনার প্রসারতা ও অলঙ্কারের বাহুল্যতা। রবীন্দ্রনাথের অনেক কথাসাহিত্যের মতো শেষের কবিতায়ও এসব ধারা প্রবলভাবে বিদ্যমান। যেমনÑ “আজ কোনো এক সময় অমিত লাবণ্যকে কানে কানে বললে, ‘একটি আংটি তোমাকে পরাতে চাই।’ লাবণ্য বললে, ‘কী দরকার মিতা!’ ‘তুমি যে আমাকে তোমার এই হাত খানি দিয়েছ। যে কতখানি দেওয়া তা ভেবে শেষ করতে পারি না। কবিরা প্রিয়ায় মুখ নিয়েই যত কথা করেছে। কিন্তু হাতের মধ্যে প্রাণের কথা ইশারা; ভালোবাসার যত কিছু আদর, যত কিছু সেবা, হৃদয়ের যত দরদ, যত অনির্বাচনীয় ভাষা, সব যে ওই হাতে। আঙটি তোমার আঙুলটিতে জড়িয়ে থাকবে আমার মুখের ছোটো একটি কথার মতো, সে কথাটি মধু এই পেয়েছি। আমার এই কথাটি ‘সোনার’ ভাষায় মানিকের ভাষায় তোমার হাতে থেকে যাক না।” ভাবাত্মক রচনার ক্ষেত্রে এসব কাব্যধর্মীতা শিল্পরসের অতিরিক্ত সংযোজন বটে। অবশ্য এই কাব্যধর্মী শিল্পরস রবীন্দ্রনাথের আগে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা ‘কপালকু-লা’ তে আমরা খুঁজে পাই। তবে গীতিময়থার ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ গীতিধর্ম ও কাব্যধর্ম এক জিনিস নয়। প্রমথনাথ বিশীর মতেÑ “ কাব্যধর্ম কাব্যের সাধারণ গুণ, গীতিধর্ম বিশেষএকশ্রেণীর কাব্যের গুণ, এ দুই স্বতন্ত্র পদার্থ। কাব্যধর্ম কাব্য মাত্রেই বর্তমান বলিয়া গীতিকাব্যেও বর্তমান, কিন্তু গীতিধর্ম সব কাব্যে থাকে না। কেবল গীতি কাব্যেই থাকে।” উপন্যাসের নায়ক অমিত চরিত্রকেও সৃষ্টি করা হয়েছে একজন কাব্যিক হিসেবে। যার ফলে শেষের কবিতার উপন্যাসের শুরু অবয়ব জুড়ে গদ্য সংলাপে যেমন কাব্যের আবহ খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি কবি হিসেবে অনেক সংলাপ কাব্যকারেও স্থান করে নিয়ছে। উপন্যাসের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে শেষ পর্বটির নামও রাখা হয়েছে ‘শেষের কবিতা’। ‘শেষের কবিতা’ অমিত ও লাবণ্যকে নিয়ে একটি রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস বটে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এ ধারার রোমান্টিক উপন্যাস অসংখ্য রচিত হলেও, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে সৃষ্ট, অমিত-লাবণ্যকে নিয়ে গড়া ‘শেষের কবিতা’ একটিই রচিত হয়েছে। উপন্যাসের সমাপ্তিও টানা হয়েছে দীর্ঘ কবিতার মধ্য দিয়ে।
সুতরাং প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে নতুন করে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। আসলেই শেষের কবিতা কী? উপন্যাস না কাব্যগ্রন্থ! আর এখানেই শেষের কবিতার নামেরও শিল্প সৌন্দর্যের এক অনন্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট