চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হাবিলদার থেকে বিদ্রোহী কবি

শওকত আলী

১১ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:২২ পূর্বাহ্ণ

কাজী নজরুল ইসলামের বয়স যখন পনেরো বছর,তখন সংঘটিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে দুই বছর বিশ্বযুদ্ধের আগুনে পুড়েছেন। অন্যান্য বাঙালি শিল্পী সাহিত্যকের চেয়ে নজরুল ক্ষমতার আগ্রাসী রূপ অধিক প্রত্যক্ষ করেন।

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে বাঙালিদের ফৌজে ভর্তি করানো হতো না। বাঙালিরা যুদ্ধে অপারগ ছিলেন। এমন কথা ভাবা যায় না, তবে ভারতের ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বাঙালির হাতে অস্ত্র দিয়ে তাঁদের বিশ্বাস করতে পারতেন না। বাঙালিদের কেরানিরূপে ব্যবহার করাই ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট অনেক বেশি লাভজনক মনে করতেন। কিন্তু জোর বিতর্ক শুরু হলো। বিতর্কে সাড়া দিলেন বাংলার বুদ্ধিজীবী, সংবাদপত্র ও নেতৃবৃন্দ। বিষয়টি তাঁরা বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলেন। শেষ পর্যন্ত ভারতের ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট একটি বেঙ্গলি ডবল কোম্পানি গঠন করতে রাজি হলেন। শুরু হলো সৈন্য জোগাড়ের আহ্বান। যে আহ্বানে সাড়া দিলেন নজরুল ইসলাম।

নজরুল তাঁর বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যান কলকাতা। নজরুল ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। ছোটবেলা থেকেই বয়স অপেক্ষা তাঁর শরীর ছিল বাড়ন্ত। নজরুলের এই বাড়ন্ত ও সুঠাম দেহ পিতৃ-উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তাঁর সুঠাম শরীর সৈন্য বিভাগে যেতে বিশেষ সুযোগ করে দিয়েছিল। সৈন্য বাছাই এর মধ্যে বুকের মাপ আধ ইঞ্চি কম হওয়ার জন্য পরে শৈলজানন্দ যেতে পারেননি। এক বন্ধুর হলো,অন্য জনের হলো না। মনে ভীষণ দুঃখ নিয়ে শৈলজানন্দ ফিরে এলেন। পালিয়ে যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ‘রুবাইয়াত্-ই- হাফিজ’ গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি ইংরেজি ১৯১৭ সালে’। রাণীগঞ্জ মুসলিম হোস্টেল থেকে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক মৌলভী আবদুল গফুর সাহেবকে একটি পত্র লিখেছি। নজরুল ইসলাম সৈন্যদলে নাম লেখানোর জন্য স্কুল পালিয়েছিলেন জুলাই মাসের শেষে।

তিনি প্রথমে যান আসানশোলে, সেখান থেকে মহকুমা হাকিমের অনুমতিপত্রসহ কলকাতায় এসে ফোর্ট উইলিয়ামে ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে আসেন। তারপর সেনা ছাউনিতে মাপজোখ। সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা হওয়ার সঠিক তারিখ জানা যায় না,তবে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নজরুল ট্রেনযোগে এক বড় বাহিনীর সঙ্গে লাহোর হয়ে করাচি যান।
নজরুল করাচি সেনানিবাসে যাবার আগে নওশেরায় তিন মাস ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তিনি খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে প্যারেড ও অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং সেনাবাহিনীর কাজে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখান। ফলে,অল্প সময়ের মধ্যে নায়েক থেকে হাবিলদার,এবং পরে ব্যাটালিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীটি মুখ্যত কয়েক হাজার বাঙালি তরুণ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। যার নাম ছিল ৪৯ নং বেঙ্গলি রেজিমেন্ট বা বাঙালি পল্টন। নজরুলের সেনাসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রামের মহিবুুবুল আলম, কুষ্টিয়ার শম্ভু রায় ও কলকাতার মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়,যাঁদের সঙ্গে পল্টন ভেঙে যাবার পরেও নজরুলের সখ্য-যোগাযোগ ছিল। এদের মধ্যে শম্ভু রায় ও মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। সাত হাজার সৈন্যদের ব্যারাকে এমন কেউ ছিল না যে এই তিন জনকে চেনে না। পুরো রেজিমেন্ট তাঁরা মাতিয়ে রাখতেন। শম্ভু রায় ছিলেন জমাদার ডিসিপ্লিন-ইন-চার্জ আর নজরুল কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার। প্রথম জন সৈন্যদের সামলাতেন, দ্বিতীয় জন সৈন্যদের পোশাক ও প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতেন। অর্থাৎ নজরুল ছিলেন রসদ ভা-ারের দায়িত্বে।

নজরুল ইসলামের সৈনিক জীবনে করাচি সেনানিবাসে থাকা এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সৈনিক থাকা সত্ত্বেও নজরুল লেখা-পড়া ও সাহিত্য চর্চায় নিয়মিত ডুবে থাকতেন। সৈনিক থাকা অবস্থায় নজরুলের সাহিত্য জীবনের উন্মেষ ঘটে। করাচি থেকেই নজরুল নিয়মিত কলকাতার পত্র পত্রিকাতে বিস্তর লেখা পাঠাতে থাকেন। তার বেশ কয়েকটি লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে ছাপা হতেই বাঙালি পাঠক মহলে এক নতুন অসামান্য প্রতিরোধের বাঙালি কবির একটি স্বতন্ত্র জায়গা হয়ে গেলো।এতে কোন সন্দেহ নেই কাজী নজরুল ইসলাম-ই প্রথম সৈনিক কবি। নজরুল করাচি থাকা অবস্থা কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ছাপানো হয় নজরুলের ‘মুক্তি’ শীর্ষক কবিতাটি। যতদূর জানা যায় এটাই ছিল নজরুলের পত্রিকায় ছাপানো প্রথম কবিতা।
রাণীগঞ্জের অর্জুনপট্টির বাঁকে, নিম গাছের তলায় হাত বাঁধা ফকিরের মৃত্যুর ঘটনা কবিচিত্তে গভীর রেখাপাত করায় তারই ফলে ‘মুক্তি’ কবিতাটি তিনি রচনা করেন। এ কবিতায় হাত বাঁধা ফকির অর্থাৎ ফকির দরবেশের প্রতি নজরুলের আকর্ষণের পরিচয় বহন করে। ‘মুক্তি’ কবিতাটি নির্ঝর কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। এটি নজরুলের দ্বিতীয় প্রকাশিত রচনা ও প্রথম প্রকাশিত কবিতা।

এরপর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন সংখ্যায় ‘মাসিক সাওগাত’ এর প্রথমবর্ষ সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প ‘বাউলের আত্মকাহিনী’।নজরুলের লেখা কবিতা ও গল্প প্রকাশের পর তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টিতে যেন বাণ ডাকতে শুরু করে। এরপর প্রকাশিত হলো আরও অনেক লিখনি,‘ব্যথার দান’ গল্পটি প্রকাশিত হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়, প্রকাশিত হলো ‘হেনা’ গল্পটিও। ‘ব্যথার দান’ গল্পে রুশ বিপ্লব সম্পর্কে কাজী নজরুলের চিন্তা-ভাবনা কোন স্তরে ছিল তার বিবরণ পাওয়া গেল। শুধু দেশ প্রেম নয়, নজরুল ইসলামের এই গল্পের ভিতর দিয়ে আন্তর্জাতিকতাও ফুটে উঠেছে।যা আমাদের বাংলা সাহিত্যের নতুন দিক বলতে হবে। ‘রিক্তের বাদন’ গল্পটি ও করাচি সেনানিবাসে বসে লিখেছিলেন নজরুল ইসলাম।

কাজী নজরুল ইসলাম সৈনিক জীবনের প্রায় আড়াই বছর কেটেছে সেনানিবাসের বহু নিয়মের মধ্যে। ১৯২০ সালে যখন যুদ্ধ শেষ হলো তখন ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টে ভেঙে দেয়া হলো তখন নজরুল ইসলাম সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায়ন ফিরে আসেন। কবি কলকাতায় এসে ৩২ নং কলেজ স্ট্রিট বেঙ্গল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন।

সেখানে তার সঙ্গে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজাফফর আহমদ। এখন থেকে নজরুলের সাহিত্য সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা, বিজলী প্রভৃতি পত্রিকায় তার বেশ কিছু ক্ষুরধার লিখনি প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস-‘বাঁধন হারা’ এবং কবিতা ‘বোধন’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘বাদন প্রাতের শরাব’,‘আগমনী’ ‘খেয়া পারের তরণী’, ‘কোরবানি’, ‘মোহরম’, এর মধ্যে ১৯২২ জানুয়ারি ৬ তারিখ ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। প্রকাশিত হওয়ার পরপারে চারদিকে জয়জয়কার অবস্থা। ব্যাপক পাঠকপ্রিয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কবিতটি একদিকে যেমন ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রসৃষ্টিতে জনমনে নবজাগরণ সৃষ্টি করে।তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নজরুল ইসলাম কে বিদ্রোহী কবি আখ্যা দেওয়া হয়।
“বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর
আমি চির উন্নত শির!”

নজরুলের প্রথম বই-ই ঝাঁজালো,‘অগ্নিবীণা’। ‘অগ্নি-বীণা’র দ্বিতীয় কবিতা ‘বিদ্রোহী’। ১৩৯ পঙ্ক্তির এই কবিতায় ‘আমি’ ব্যবহার করেছেন ১৪০ বার। নজরুল-প্রতিভার ম্যাজিক হলো এখানে, এতবার আমিত্বর উপস্থিতি কবিতার কোথাও কর্ণপীড়ক হয়ে উঠেনি। মুজাফফর আহমদের বিবরণী থেকে জানা যায়, কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন পেন্সিলে,মধ্যরাতে। তখনো ঝর্না কলম আসেনি। আবেগের আগুন এমন তোলপাড় ছিল যে, সে আমলের দোয়াতের কালিতে বারবার নিব চুবিয়ে কবিতা লিখতে গেলে নজরুলের উত্তাল বিদ্রোহী অনুভব গুলো হোঁচট খেতো। আবেগের এই তীব্রতা অক্ষুণœ রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত ‘বিদ্রোহী’ লেখায় পেন্সিলের আশ্রয় নিয়ে ছিলেন নজরুল। কে না বলবে, এই কবিতা বাঙালি সত্তা ও বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ অর্জন।

নজরুলের কবিতায় যে ‘ধামি’ তা পরিবর্তনের ‘আমি’।এই আমিত্বকে তার চেতনার শ্রেষ্ঠতম অংশ হিসেবে দেখলে নজরুল-মানসের অভিলক্ষ্য নির্ণয় সহজ হয়। নজরুলের ভেতর ছিল আবদ্ধ সংস্কার ভাঙনের বাসনা। তাঁর সত্তায় লীন হয়ে ছিল সমাজ ও মানুষের প্রতিচ্ছবি। সুন্দর এশটি জ্যোতির্ময় মানবীয় পৃথিবীর স্বপ্ন তার অঙ্গীকার ছিল বলেই অবরুদ্ধ-সংস্কারে জীর্ণ এই সমাজের বিরুদ্ধে তিনি বারবার দাঁড়িয়েছেন। গোত্র-গোষ্ঠী ও বর্ণভেদের কথা ভুলে গিয়ে মানবতন্ত্রে ঐকাত্ম হতে বলেছেন।

শেয়ার করুন