চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কবি খালিদ আহসানের ঝিঁঝিঁর কনসার্ট

প্রকৃতির রং আর রেখার বৈচিত্র্যে ভরা জীবনের জলছবি

ডেইজী মউদুদ

১১ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:২২ পূর্বাহ্ণ

‘ঝিঁঝিঁর কনসার্ট’ কবি ও শিল্পী খালিদ আহসানের দশম কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটির নামকরণে কবি যেন আমাদের বলেন, তিনি এই গ্রন্থে পাঠকদের প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ উপহার দেবেন। প্রকৃতির নানা রং, বিত্ত আর বৈভব এখানে বিশেষ এক চেতনায় পল্লবিত।

গ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় তিনি ঝিঁঝিঁদের কনসার্ট শোনান। তবে এ গান শোনাতে গিয়ে, প্রকৃতির রূপরস-বর্ণ-গন্ধকে উপস্থাপন করতে গিয়ে, জীবনের নানা জটিলতা, উত্থান- পতন, সামাজিক অবক্ষয়, হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ, রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাই, ইতিহাসচেতনা, শিল্পবোধ, ঐতিহ্যপ্রীতি ও মৃত্যুচেতনা উঠে এসেছে কখনো পরোক্ষভাবে কখনো বা প্রত্যক্ষভাবে। কবি গ্রন্থটির প্রতিটি কবিতায় প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ ফুল, পাখি, বালিহাঁস, লতাগুল্ম, শিশির, কুয়াশা, মেঘ বৃষ্টি রোদকে কখনো সরাসরি, কখনো বা তির্যক ভঙ্গিতে নানা উপমায়, নানা উৎপ্রেক্ষায় সাবলীল ও প্রাঞ্জল ধ্বনিতে ফুটিয় তুলেছেন। প্রকৃতির নানা উপকরণে খুঁজে পাওয়া নিজের উপলব্ধিগুলোকে তিনি দান করেছেন কাব্যিক ব্যঞ্জনা। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে কবির নিজস্ব এক দর্শন অত্যন্ত রোমান্টিক আবহে কবিতাগুলোর ছত্রে ছত্রে গভীরভাবে প্রোথিত।

গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘কবি ও পতঙ্গ’-এ তিনি বলছেন, ‘পৃথিবীর নাগাল যদি না পাও/ তবে ধরে রাখ গ্যাস বেলুনের সুতো/ আর উড়তে থাকো’। আবার দ্বিতীয় কবিতা ‘স্মৃতি’ তে বলছেন, ‘টিকটিকি লেজ হারিয়ে টের পায় না কি হারালো/ আমে তো শব্দের সম্মোহন হারাতে পারি না/ এতো জাগতিক প্রলোভন সাজানো চারদিকে / পৃথিবীতে কত লক্ষ বছর আগে প্রাণ সঞ্চার হয়েছিলো, কি হয়নি অভিধান ঘাটতে হবে।’ ঝিঁঝিঁ পোকাদের বাজানো পিয়ানোর গান শুনতে শুনতে তিনি কখনোবা পানশালার পথ ধরে সভ্যতার সোপানে উঠছেন ( আরো কিছুদিন), গভীর মৃত্যুচিন্তায় ধাবিত হয়ে তিনি কবি সিলভিয়া প্লাথের মতো বলছেন, ‘মৃত্যু এক অনিবার্য বিমূর্ত শিল্প’ (নীলপদ্ম)। ‘সুপার মুন’ কবিতায় কবি চাঁদকে মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন চেনা আলয়ে। কিন্তু সেখানে গর্তে রয়েছে একটি সাপ যা কবিকে নাচ দেখায়, কবিতা লেখায় অনেকটা বিশ^কবির জীবনদেবতার মতো। কিছু কিছু কবিতা জীবনানন্দ দাশের কবিতা (হাওয়ার রাত) এর মতোই। ‘অন্ধকারের আলখেল্লা পরা /খোলামেলা নির্জন বারান্দা/ আমি তোমাকে দিলাম/ গোপন ক্রন্দনের জন্য এই তো যথার্থ স্থান’ (টানা বারান্দা)। কিছু কিছু কবিতায় সমাজের অন্ধকার জগৎ এর চিত্র দীপ্যমান। রাতের শহর কবিতায় সন্ধ্যাতারা গণিকা, রাস্তার ওঁৎ পেতে থাকা ছিনতাইকারীর গাঁজা সেবন দেখেছেন। কবি তাঁর ¯œানঘরে রামধনু দেখে আঁৎকে উঠলেও তিনি ফুলদানিতে ভোরের প্রথম ফুল ফোটার আশায় উদ্বেলিত ছিলেন।

মূলত ঝিঁঝিঁর কনসার্টের কবি খালিদ আহসান মনে প্রাণে একজন শিল্পী।তাই গ্রন্থে কবি সত্তার পাশপাশি অত্যন্ত সরব তাঁর শিল্পী সত্ত্বা। এই দ্বৈত সত্তা কবিকে একবার পৃথিবীর নানা জাগতিক মোহে মুগ্ধ করেন। আবার অতি রোমান্টিকতায় আক্রান্ত করে তাঁকে নিয়ে যায় কল্পনার এক অলীক ভুবনে। ফলে তিনি আইনস্টাইনকে যেমন ঝিনুক কুড়াতে দেখেন, তেমনি দেখেন তৃষ্ণার্ত বালিহাঁসকে জলাশয়ে গা ভেজাতে। দেখেন পুরানো বাড়ির দেয়ালে ফোটা নিশিপদ্মটিকেও-‘তখন জীবন রোদ জলে ভেজা / তখন কবিতা আমার শব্দ বন্ধ খেলা/পুরানো বাড়ির দেয়ালটিতে /নিশিপদ্ম ফুটেছে রাত্রি গভীরে’ ( নিশিপদ্ম)। ‘সূর্য আমার মামার বাড়ি’ কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘শিকার’ কবিতায় শিকারীরা যখন হরিণ শিকার করে ঝলসানো মাংস খাচ্ছিলেন, তখন তিনি গভীর অরণ্যভেদ করে আসা সঙ্গীহারা ঘাই হরিণীর চিৎকার ও কান্না শুনেছিলেন। কবি খালিদ আহসান পাহাড়ী অরণ্যে বসে লিখেন, ‘কলাপাতায় ভুনা লাল মাংস, ঝোল লাল আলু ও আনাজসহ জিব জ¦লে যায়/ সাদা ভাত গিলি গোগ্রাসে/বিকেলে উঠবে কোজাগরী চাঁদ/ তাকে ডুবিয়ে দোচোয়ানি খাটি পানীয়ের সাথে /আমরা ঘরে ফিরেছি চার যুবক’। তিনি এখানে প্রকৃতিকে মানবায়িত (পারসনিফাই) করেন।

‘পথ চলার গল্প’ কবিতায় তিনি তাঁর স্বপ্নচারীর গল্প বলতে গিয়ে তাকে চিনতে পারেন না। তিনি বলেন,
‘কে আসে কে যায় সূর্য ডোবার কালে /সূর্য ডোবার পালে/ কে দোলা দেয় রঙে বর্ণে বিদ্যুৎছটায়/ গল্পটা আসলে এ রকম দিক চিহ্নহীন দীর্ঘ পথচলা/গল্পটা আসলে ভালোবাসা শব্দটাকে পালে তুলে দেয় দোলা।’
কিছু কবিতায় শিল্পী কবি জীবনের জলছবি এঁকেছেন ‘শব্দ আমার জোড়াসন্ধি/ জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে সাঁকো/ শব্দ আমাকে বলে শিশু হও/ বসে বসে জলরঙে জীবনের ছবি আঁকো’

এভাবে কবি তাঁর কাব্য গ্রন্থের ছাপ্পান্নটি কবিতায় জীবনের জলছবি এঁকেছেন। প্রকৃতির নানা উপাদান তাঁকে বিভিন্নভাবে আপ্লুত করেছে। প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গে তিনি মুগ্ধ ছিলেন। আবার প্রকৃতির মানুষগুলোর বৈরি আচরণে তিনি আহত ও ছিলেন। দ্রোহ আর মুগ্ধতা এই দুয়ের সম্মিলনে কবির কবিতাগুলো সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে পাঠকের কাছে, তা বলতে কোন দ্বিধা নেই।
৬৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেন উত্তম কুমার রায়। উৎসর্গ করেন কবিপত্নী শিল্পী আইভি হাসানকে। গ্রন্থটির প্রকাশক ‘খড়িমাটি’। মূল্য ১৫০ টাকা ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট