চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জাহানারার বলা-মুসিবৎ

আহমেদ মনসুর

১১ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:২২ পূর্বাহ্ণ

নয় বছরের ছেলেটি, জাহানারার অন্ধের যষ্ঠী, যখন চলে যায় মায়ের ভোগে, ত্রিভুবনে আর থাকে কি! দেবহাটি গ্রামে ওর চেয়ে সতী আর পতিভক্তা কেউ ছিলো না। স্বামী দল করতো বলে প্রতিপক্ষ গুম করে দিলো, ফিরে আর এলো না। সুযোগ পেয়ে দেবর-ভাসুরদের রাত্রকালীন দুয়ারঠেলানির চোটে সতীত্ব আর ধরে রাখা গেলো কই। তবু ওই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মাটি কামড়িয়ে পড়েছিলো শ^শুর বাড়িতে। শ^শুর বাড়ি, না অসুরের কেল্লা! যাতনা সহ্যের সীমা ছাড়ালে বাপের বাড়ি গিয়েছিলো একবার। বাপ আর কী- মা যখন মরেছে, সে তো তালই। নতুন বউয়ের সংসারে পুরানো ইজা কী করে টানবে সে।

: ‘নারী হয়ে জন্মেছিস, শ^শুর বাড়িটাই আসল। বাঁচলেও সেখানে, মরলেও থাকতে হবে সেখানে।’
ভীষণ জ্বরে পড়ে গেলো ছেলেটি। হাতে দু’টো পয়সা নেই যে, ঔষধ কিনে খাওয়াবে। দেবর ভাসুরদের কাছে অনেক চেয়েছে, দেয় না। দয়া করে দু’মুটো যে খেতে দেয় কত না, আবার ডাক্তার-বৈদ্য, ঔষুধ-পত্যি! ওরা চায় ছেলেটা মরুক, আপদ ঘুচবে। মৃত ভাইয়ের সম্পত্তির ভাগটা তাহলে বাগে চলে আসে সহজে।

জাহানারা দু’চোখের জলে বুক ভাসানো ছাড়া কিছু করতে পারলো না। এগারো দিনের জ্বরে ভুগে ছেলেটি তার হাতের উপরেই মা মা করতে করতে দেহটা রাখলো। পরে অবশ্য দাফন-কাফনের ব্যাপারে ওকে ভাবতে হয়নি। এক প্রকার সু-ব্যবস্থাই হয়েছে। চিরবিদায় স্টোরে সেদিন রীতিমত ধুম পড়ে গিয়েছিলো। দেবর আনে তো আতর সুরমা, ভাসুর আনে লোবান-কাফন। জাহানারার বড় উপকার হলো, এই আকালে ছেলেটার দাফন-কাফন কী করে করতো সে?

জাহানারা নামের মেয়েটির মুখের উপরেই জগতের সমস্ত দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। আত্মহত্যার দরজাটি খোলা থাকলেও মন সায় দেয় না। শুনেছে আরকটি দরজা নাকি খোলা আছে উত্তরের এক গ্রামে। বাবা সাঁইজির দরগাহ। উঁচু গম্বুজের মাজার, সামনে বিরাট প্রাঙ্গণ। এর এক কোণে লঙ্গর খানা। অন্য কোণায় অভ্যাগতদের থাকার ব্যবস্থা। এর সবই হয় ভক্তকুলের দানের টাকায়। দানের সমস্ত পয়সা যে এসব কাজে লাগে তা অবশ্য নয়। এর সিংহভাগ যায় খাদেমদের পকেটে। ভাগ বরাত শেষে ছিঁটেফোঁটা যা থাকে তা দিয়ে চলে দরগাহ সরগরম রাখার যাবতীয় এন্তেজাম।

বড় বড় ব্যবসায়ী, সরকারি আমলারাও ইদানীং লাইন দিয়ে আসে দারগাহে। দু’হাত খুলে দান করে। কুপথের আয় তাতে পরিশুদ্ধ হয় বলেই হয়তো তাদের ধারণা। দিন শেষে এটুকু স্বস্তি তাদের বড় বেশি প্রয়োজন। দরগাহে পয়সাপতিদের আগমনের খবর গ্রাম চাউর হতে বেশি সময় লাগে না। এর মধ্যেই পার্টির ছেলেপুলেরা এসে হাজির। নেগাহ্করম হাসিল করা তাদের উদ্দেশ্য নয়, খাদেমের নির্বিঘœ আয়ে ভাগ বসানোর জন্যই তাদের দরগাহ আগমন।

: ‘বুঝলে মৌলভি; একরত্তি শান্তি কোথাও রইল না আর। বাবাজান কেবলার অছিলাই দু’পয়সা দান দক্ষিণায় পেট চলে। সেকি শুধু নিজেরা খাই, এ দরগাহ পরিচালনা করতে কি কম পয়সা খরচ হয় বলুন? তাতেও দেখুন শকুনের নজর।’
: ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না হুজুর। পুরো দেশটাই তো শকুনের করতলে। আপনার এ দরগাহটা বাদ পড়বে কেন? টিকে থাকতে হলে মানিয়ে চলতে হয়। জলে থেকে কুমিরের সাথে বিবাদ কি আর চলে?’
: ‘না, আসলে বলছিলাম ওই নাঙা-ভোখা ফকির-ফোকরারা লঙ্গরখানায় চারটে খেতে পায়, তা কি তাদের সহ্য হয় না?’
: ‘তাদের চেয়ে ফকির আর কে, যাদের ক্ষুধা পেটে নয়, মস্তিষ্কে! এ ক্ষুধা মিটবার নয়।’
দরগাহের চারদিকে খোলা বারান্দা। দক্ষিণের বারান্দাটা মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। জাহানারা এর এক পাশে বসে অজোর ধারায় কাঁদে। বিলক্ষণ সময়ের কথা ভুলে গিয়ে কাঁদে। দু’টি চোখ যেন দু’টি ঝর্নাধারা।
: ‘এমন করে কাঁদছিস কেন বোন? নিশ্চয় সমস্ত খেয়ে তারপর এলি।’
জাহানারা মহিলার প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারে না। অপলক তার দিকে চেয়ে থাকে শুধু।
: ‘বাবার কাছে যখন এসেই পড়লি, তবে আর কাঁদবি কেন? আয় আমার সাথে। কই? ওঠ্।’
নিশ্চল বসে থাকতে দেখে মহিলা তার একটা হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে গেলো একটি ঘরে। ঘর বলতে ফকির- ফোকরারা যেখানে পড়ে থাকে রাতদিন।
: ‘আজ থেকে এখানে থাকবি, আমাদের সাথে খাবি। কোন চিন্তা নেই।’
জাহানারা এখনো চুপ, খালি তাকিয়ে থাকে বেদমের মতন।
সারাদিন গল্প-গুজব করে, মাঝেমাঝে ছোটখাটো বিষয়ে একে অপরের সাথে ঝগড়া বিবাদ করে সময় কাটে তাদের। প্রশ্রাব, পায়খানা, গোসল, খাবার-দাবার নিয়ে প্রথম প্রথম জাহানারার বেশ কষ্ট হলেও এখন সয়ে গেছে। দিনমান আনমনে ভাবে, মাঝেমাঝে দু’চোখের জলে শাড়ির আঁচল ভেজায়। তবু দিন কেটে যায়। কখন ফুরাবে মেয়াদ সে-তো কোনকালেই মানুষ জানতো না; আশা- শুরু যখন হয়েছে, শেষ নিশ্চয় আছে। পরম্পরার ধারাবাহিক বিদেয় নেওয়ার ইতিহাস তো তা-ই বলে। একটা দিন গত হয়, জাহানারা ভাবে এই আরেকটা দিন কমলো।
বাকিরা রাতের আঁধারে নেশাটেশা করে এটা-ওটা করে, জাহানারা সেসবে নেই। গতরের চাহিদা মাঝে মধ্যে মাথাচাড়া দেয় বটে, সে পাত্তা দেয় না। শরীরের নিয়মে শরীর জাগলেও মনের উপর তার এখন প্রবল প্রভাব, জাগতে দেয় না। সে যে বৈরাগ্যের ব্রত নিয়েছে।
: ‘তোর ইচ্ছে করে না দুনিয়ার স্বাদ একটু-আধটু হলেও গ্রহণ করতে?’
: ‘আমি না থাকলে দুনিয়ার কি-ই বা এমন ক্ষতি হয়ে যেতো? বিধাতা আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন কি করতে সেটাই তে বুঝি না। শরীরটা শুধু সচল আছে, আপনার বলতে আমার আর কিছু নেইরে সই।’
: ‘তোকে বাপু বুঝা বড় দায়। কী করে পারিস নিজেকে এভাবে ধরে রাখতে?’
প্রতি সোমবার বাদে এশা দরগাহ মাঠে বসে মারফতি গানের আসর। দূর-দূরান্ত থেকে গানের দল আসে। মারফতি-মুর্শিদি গানের একেবারে মজমা জমে ওঠে। শুধু পুরুষেরা অংশ নিতে পারে তাতে। গানের তালে এমন ধারা নাচ, সে কী যেন-তেন! দুনিয়া ভোলানো নৃত্য। জগতের সমস্ত যন্ত্রণা ওরা একরাতের জন্য বেমালুম ভুলে যায়। এ-দেখে জাহানারার ঈর্ষে হয়। ইচ্ছে করে পাগলের মতো নাচতে। ঢোলের তাল কানে এলে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সে। তবে মাথার উপর যে নিয়মের খড়গ, মেয়েদের তাতে যোগ দেওয়া মানা।
চারদিকে আজ সাজসাজ রব। মহাসমারোহে চলছে মাজার ধোয়া-মোছার কাজ। প্রাঙ্গণে সামিয়ানা টানানো হচ্ছে। বড় ডেকচিতে চলতে আখনি রান্না। এ এক এলাহি কা-। আজমির থেকে বড় কাওয়ালির দল আসছে। ও-দিকে জাহানারার হৃদয়াকাশে জমেছে মেঘ। বাপের বাড়ি, শ^শুর বাড়ি, একমাত্র সন্তান আর স্বামীর কথা মনে হচ্ছে খুব। মেঘ জমে আকাশটা কালো হয়ে এলে ঝমঝমিয়ে শ্রাবণ ধারা নেমে আসে চোখে।
: ‘একি, তুই এখানে বসে কাঁদছিস? ও-দিকে যে কাওয়ালি শুরু হয়ে গেলো। চল্ খেয়ে-দেয়ে বারান্দায় বসি গে, নে, চোখের পানি মোছ, আজ বললাম সেই গান হবে।’
: ‘তুমি খেয়ে আস গিয়ে। আমার খিদে নেই।’
শিল্পীরা এর মধ্যেই গান গাইতে শুরু করেছে। একের পর এক গান গেয়ে আসর মাতিয়ে দিয়েছে তারা। জমায়েতও হয়েছে অন্যদিনের তুলনায় তিন চারগুণেরও অধিক। জাহানারা শত চেষ্টার পরও নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সবার অগোচরে আসরের এক কোণায় বসে পড়ে আলগোছে। তবলার প্রতিটা বোল ওর মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলছে। শূন্য পেটে মদ পড়লে যেমন দ্বিগুণ ক্রিয়া করে, জাহানারারও হয়েছে সে একই দশা। অবচেতনে পুরো শরীর তার বিদ্রোহ ঘোষণা করে। গানের তানে কখন দাঁড়িয়ে যায়, মাথা দোলায়, সমস্ত শরীর দোল খেতে আরম্ভ করে সে বুঝতে পারে না। তবলার প্রতিটি বোলের শেষে জটা চুলের জটা এমনভাবে শূন্যে ছুটছে গান ভুলে সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়ছে ওর ওপর। কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে বাধা দিতে উদ্যত হলে কাওয়াল নিজেই ইশারায় তাদের নিবৃত করেন। সে যতক্ষণ গানের আসর ছিলো, আসর ভাঙতেই পুরুষেরা তার ওপর হামলে পড়তে আর বিলম্ব করে না। সে দরগাহের নিয়ম ভেঙেছে, পবিত্রতা নষ্ট করেছে। ওকে এখানে আর থাকতে দেয়া চলে না।
সকলে তার শরীরের দুলুুনিটুকুই দেখেছে, হৃদয় অন্তঃপুরের খবর কেউ নিলো না। নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করলো না। ভাগ্য ভালো যে, গায়ে হাত তোলোনি, মানে মানে বিদেয় দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে। এতোগুলো পরপুরুষের সামনে সে এভাবে নাচতে পারলো? এ-তো ঘোর অন্যায়, মহাপাপ। ওকে এখানে থাকতে দেওয়াটাই তাদের অন্যায় হয়েছে। সকলে পরস্পরের মধ্যে এ কথাই এখন বলাবলি করছে। জাহানারা টু শব্দটি পর্যন্ত না করে পুঁটলি বেঁধে পরনের কাপড়গুলো নিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়ে। সে জানে না কোথায় তার গন্তব্য, তবু পা ফেলছে, তবু এগিয়ে চলছে।
চলতে চলতে কখন সে রেলস্টেশনে এসে পৌঁছে গিয়েছে বুঝতে পারেনি। ট্রেন গঞ্জ অভিমুখে দাঁড়িয়ে। ছেড়ে দেবে বলে জোরে জোরে হুইসেল বাজাচ্ছে ট্রেন চালক। জাহানারা সন্তর্পণে একটা কামরায় উঠে বসে পড়ে। ট্রেন চলছে। গ্রামের দৃশ্যসমূহ একে একে পিছনে ফেলে ট্রেন এগিয়ে চলছে। ট্রেনের দুলুনিতে জাহানারার ক্লান্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।
মুখে পানির ছিটা পড়তেই হুঁশ ফেরে ওর। চোখ মেলে দেখতে পায় চারপাশে মানুষরূপি কিছু হায়েনা দাঁড়িয়ে। বিশেষ অঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ব্যথায় সমস্ত শরীর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। জাহানারার অনুযোগ নেই। ওরা তার থাকা-খাওয়া আর পোশাক-পরিচ্ছদের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। প্রতিরাতে ওদের খুশি করাই এখন ওর একমাত্র কাজ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট