চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পরাবাস্তববাদের কবি জীবনানন্দ দাশ

হামীম রায়হান

৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্র যুগে জন্মগ্রহণ করে রবীন্দ্র প্রভাবকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে গিয়ে কবিতায় পাঠকের হৃদয়ে এক নতুন চেতনার সৃষ্টি করেন ‘পরাবাস্তববাদী কবি’ জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। নিজেকে আড়াল রাখার স্বভাবের জন্যে বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ আবার কোথাও ‘আমাদের নির্জনতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। আবার সব্যসাচী লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘শুদ্ধতম কবি’ বলে।

‘পরাবাস্তববাদ’ শব্দটির ইংরেজি সুরেলিয়িজম।। একে আবার অধিবাস্তবতাও বলা যায়। ১৯২৪ সালে ফরাসিীকবি আঁদ্রে ব্রেতোঁর ‘মেনিফেসটো ওন সুরেলিয়িজম’ নামক দলিলটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরাবাস্তবতা শব্দটি এসেছে। মূলত এটি একটি আন্দোলন যা ফ্রান্সে শুরু হয়। ডাডাবাদ থেকেই এই ধারার শুরু। এটার মূল কথা হল- কোন বিধি নিয়ম এবং যুক্তি না মেনে অবচেতন মনকে শিল্প সাহিত্যে রূপায়িত করা।
ডাডাবাদীরা নতুন কিছু সৃষ্টির লক্ষ্যে পুরাতন সবকিছুকে ওড়িয়ে দেয়ার পক্ষপাতী কিন্তু নেতিবাচক ও উদ্দেশ্যহীন বলে এ ধারা টিকতে পারেনি। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ মগ্নচৈতন্যের জগৎ অবাস্তব বলে মনে করত না। তারা স্বপ্নকে বাস্তবেরই প্রতিরূপ মনে করত। এবং এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করত। এক কথায় বিধিনিয়ম এবং যুক্তিতর্কের গ-ির বাইরে অবচেতন মনকে রূপায়িত করাই হল পরাবাস্তবতা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মানববিধ্বংসী কর্মকা-, রুশ বিপ্লব, সামন্তবাদী আন্দোলনের প্রসার, আশা-নিরাশার দোলাচাল, নৈরাশ্য, নৈরাজ্য, বর্থ্যতা ও বেদনাসহ জীবনের এক জটিল সময় বাংলা কাব্যাঙ্গনে জীবনানন্দের আর্বিভাব।
বিশ শতকের এই সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়, জীবনের জটিল সমীকরণের ক্লান্ত, অবসাদ, নৈরাশ্য, নৈরাজ্যকে জীবনানন্দ তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। চেতনার এক অজানা রাজ্যের করুণ উদ্দাস, প্রশান্ত, নিরস সুর তাঁর কবিতায় রং রেখায় ফুটে উঠেছে।

জীবনানন্দ যেমন জীবনকে রূপায়িত করতে প্রকৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ডুব দিয়েছেন। তেমনি তিনি হয়ে উঠেছেন পরাবাস্তববাদী। কবি সারাজীবন সত্যকে সন্ধান করেছেন। চৈতন্যমগ্ন হয়েও তিনি সত্য সন্ধান থেকে পিছপা হননি। সমকালীন যুগ যখন যান্ত্রীকতা ও জটিলতার কাছে পরাস্থ হয় তখন তিনি আশ্রয় নেন পরাবাস্তবতাবাদে।
বাস্তবজগতের নিত্য আঘাতে অতিষ্ঠ কবি বার বার ডুব দিয়েছেন পরাবাস্তব জগতে। যেখানে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা নেই। যেখানে তার রূপ শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মত, পাখির নীড়ের মত চোখ, কমলার মত রোদ। তাঁর সমস্ত কবিতায় হতাশা, ব্যথা, কষ্ট ইত্যাদির বিবিধ প্রকাশ লক্ষ্য করি। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, তাঁর দুঃখবাদী মানস এমন দুঃসহ পাথরের মতো কবিতার অন্তরে জেঁকে বসে যে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যকে মনে হয় একটি সমাধিলিপি।
বোদলেয়ার যেভাবে ভিক্টর হুগোর প্রভাব এড়াতে নিজের ইচ্ছায় ভিন্ন জগৎ গ্রহণ করেছিলেন। ঠিক তেমনি হয়ত রবীন্দ্র প্রভাব এড়ানোর জন্যে জীবনানন্দ এই ধারায় যান। ফলে তিনি হয়ে উঠেন দুঃখবাদী, বাস্তব থেকে পরবাস্তববাদী কবি।
‘নগ্ন র্নিজন হাত’ কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রকাশ পাই।
“আবার আকাশে অন্ধকারে ঘন হয়ে উঠেছে।
আলোর রহস্যময়ী সহোদরের মতো এই অন্ধকার।”
এখানে যদি ‘আবার’ শব্দটির দিকে তাকাই তবে বুঝা যায় কবির আকাশ আগেও অন্ধকার ছিল। আবার বলেছেন-
“যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।”
তিনি এমন এক নারীর কথা কল্পনা করেছেন থাকে তিনি কোনোদিন দেখেননি। এমন এক ধূসর রাজ প্রসাদের রূপ মনে জাগে যা কবির কাছে মনে হয়েছে বিলুপ্ত। কিন্তু সে প্রাসাদ কোথাই তা কবির জানা নেই। পরে তিনি পরাবাস্তবতায় ডুব দিয়ে বলেন,
“এইসব ছিল সেই জগতের একদিন।”
একদম শেষের লাইনে বলেছেন,
“তোমার নগ্ন র্নিজন হাত।”
কিন্তু এই ‘তোমার’ বলতে কবি কাকে বুঝিয়েছেন। কি বুঝিয়েছেন তা বলেননি। এই ‘তোমার’ শব্দটি কবির কল্পনার প্রতীক। কবি বাস্তব জগৎ ছেড়ে ছুটে গেছেন পরাবাস্তবতার দিকে।
কবির বহুল আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ এর প্রায় সব কবিতায় পরাবাস্তবতার চিত্র পাই।
‘হাওয়ার রাত’ কবিতাটি বাংলা কাব্যের প্রথম পরাবাস্তববাদী কবিতা। এটার মাধ্যমে তিনি পরাবাস্তবতায় পৌছেন।
“সারারাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে,

মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো,
কখনো বিছানা ছিঁড়ে
নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে।”
তিনি ধূসর প্রিয় মৃতমুখগুলোকে দেখেছেন নক্ষত্রের মাঝে। আবার এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় প্রসঙ্গ এনে মরে যাওয়া রূপসীদের কথা এনে জীবনের জয়গান করেছেন। যারা কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। এই যে পরাবাস্তবতার এক অদ্ভুত জগৎ সৃষ্টি হয়েছে কবির অবচেতন মনে।
‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতায় পাওয়া যায় পরাবাস্তবতার প্রকাশ। কবি প্রথম লাইনেই বলেছেন,
“হাজার পথ ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।”
এ পথ যেন বাস্তবতার পথ নয়, অতিবাস্তবের এক পথের কথা নির্দেশ করেছেন কবি। আবার বলেছেন,
অনেক ঘুরেছি আমি, বিম্বিসার আশোকের ধূসর জগতে।
তিনি প্রেয়সীর চুলকে তুলনা করেছেন অন্ধকার বিদিশার নিশার সাথে। মুখের সৌর্ন্দয হয়েছে শ্রাবস্তীর কারুকার্য। কবি যেন একেক লাইনে সৃষ্টি করেছেন পরাবাস্তবতার জগৎ। যেখানে প্রেয়সী পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে বলে, “এত দিন কোথায় ছিলে?”
কবি ‘বনলতা সেন’ কাব্যে ‘নক্ষত্র’ শব্দটিকে পরাবাস্তবতার একটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘বুনো হাঁস’ কবিতায় আছে-
“পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে,”
আবার-
“হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু’একটা কল্পনার হাঁস,
মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁয় অরুণিমা সন্যোলের মুখ।
‘কল্পনার হাঁস’ শব্দটিই যেন বলে দিচ্ছে কবি বাস্তবতার মায়া ছেড়ে চলেছেন পরাবাস্তবতার মায়ায়। এভাবে উল্লেখ করা যায়-
১) আকাশের রং ঘাস ফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল। (শিকার)
২) পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে বনে বনে হরিণের চোখে,
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।
হীরে প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে। (হরিণেরা)
৩) আবার বিকেল হলে অতিকায় হরিণের মতো শান্ত থাকে
এই সব গাছগুলো। (অবশেষে)

এভাবে এই কাব্যের কবিতাগুলিতে কবি যে চিত্রকল্প তৈরি করেছেন তা যুক্তিগ্রাহ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু কী সুশৃঙ্খল। মনকে দুর্নিবার আকর্ষণ করে। সার্থক পরাবাস্তবতার এক জ্বলজ¦লে উদাহারণ। তিনি সার্থক পরাবাস্তবতার মাধ্যমে এমন এক চরিত্র অংকনে সামর্থ্য হয়েছেন যা আমাদের চেতনার মধ্যে প্রবেশ করে আমাদের আত্মাকে নাড়া দেয়।
রোমাণ্টিক কবিদের মতো অধরা সৌন্দর্যের পিয়াসী তিনি নন। তাই তিনি বাস্তবের সীমা অতিক্রম করে মগ্ন চৈতন্যে পরাবাস্তবকে খুঁজছেন। গাণিতিক মাপকাঠিতে যেমন কাব্যের রস পরিমাপ করা যায় না, তেমনি বাস্তবের দিনপঞ্জী দিয়ে পরাবাস্তবকে ছোঁয়া যায় না। বাস্তবকে অতিক্রম করে গিয়েই পরাবাস্তবতার সূচনা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট