চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ফাউজুল কবির জেগে ওঠেন পাখির প্রমায়

জিললুর রহমান

৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

আমি কবি ফাউজুল কবিরকে এখনো বুঝিনি, এখনো চিনে উঠতে পারিনি পুরোপুরি। অথচ এই যে আধচেনা রহস্যময়তায় মগ্ন এই কবিকে আমি খুব ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। এই ‘কবির বাড়ি’ মেঘের নীলে’। বিশ্বাস করেন তিনি নিজেই তা বলেছেন ২০০৯ সালে। এর আগে আমরা দেখেছি কবি ‘একা হলে জলতরঙ্গ নীলকণ্ঠ বাউল’ হয়ে ঘুরে ফিরেছেন শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে সেই ১৯৯৭ সালে।

যেদিন দূর থেকে প্রথম এই সুন্দরকান্তি সুউজ্জ্বল কবিকে দেখি, এক অমোঘ আকর্ষণ আমি বোধ করেছিলাম। যেন কবিতার রাজপুত্তুর, এক গভীর মগ্নতায় যিনি নিজের সৌন্দর্যকে ১৯৯৬ সালে ব্যাখ্যা করেন ‘আমার সুন্দর আমার টেন্টেলাস’ বলে। অথচ ১৯৮৭ সাল থেকে আমি তাঁকে দেখেছি কবিতার সাথে। কিন্তু কিতাবের সাথে প্রথম দেখা মিললো ১৯৯৬ সালে। কবি ফাউজুল কবিরের জন্ম ৭ আগস্ট ১৯৫৫। সত্তর দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি প্রথম গ্রন্থাকারে আত্মপ্রকাশ করেন নব্বইয়ের দশকে।
কবিকে খুব কাছে কাছে পাই আমাদের এই শিল্পকলার আড্ডায়। আমার চোখে যিনি কবিতার রাজপুত্তুর ছিলেন, তিনিই যেন নিজে থেকে আমাকে একান্ত বড় ভাইটির মতো আপন করে নিলেন। এমন দিনগুলোতে আমার কবিতা লেখা তাঁরই প্রবল অনুরাগে তরান্বিত হলো। তাঁর কাছ থেকে শিখলাম ‘প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন যাদুমন্ত্র’ (২০০৯)।

২০১০ সালে আমার শাদা অন্ধকার কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পেছনে কবি ফাউজুল কবিরের প্রণোদনা অনস্বীকার্য। গভীর জীবন বোধের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে দেখেছি কবিকে খুব কাছ থেকে। কবির অন্তর্গত রোমান্টিকতা কবিকে ক্রমাগত শিহরিত করে। তিনি বলেন “শিহরণ বড় ভাল লাগে”। তিনি নিজেকে কখনো বলেন মুসাফির মানুষ কিংবা ভ্রমণ-পিপাসু। কিন্তু এরপরও কবি নিজেকে মনে করেন “নিঃসঙ্গ এক কাকতাড়–য়া। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ অনিবার্য। তাঁর কবিতার সরল শব্দাবলী এবং অনবদ্য দৃশ্যকল্পের পাশাপাশি মিথলজির ব্যবহার মনকে ভরিয়ে দেয়।
এর মধ্যে কিছুদিন বিরতি দিয়ে তিনি আবার প্রকাশ করলেন ‘মেডুসার খেলা’ (২০১৫), ‘রহস্যের চাবিকাঠি’ (২০১৫), ‘সময়ের মায়াবী রাখাল’ (২০১৭), ‘জেগে ওঠো পাখির প্রমায়’ (২০১৯)।
কবি ফাউজুল কবিরের ইদানিংকার কবিতাগুলো আপনাদের কাছে নিয়মিত আসে ফেসবুকের কল্যাণে। তাঁর কবিতা সরল সহজ ভাষায় জীবন বোধের এক মহত্তর জগতে পাঠককে উপনীত করে। কবির কিছু অতি সাম্প্রতিক কবিতা থেকে উদ্ধৃত করছি:
১.
“জুতোজোড়া ছিঁড়ে গেছে জুতোদের প্রাচীন নিয়মে
কিছুদিন আগে বেশ কিছুদিন আগে
পেরেক গেঁথেছে পায়ে
তাই রক্ত ঝরে তাই কষ্ট পাই বেদনাও পাই
অনেকে শুনেছে এখবর তবু কেউ জানে নাই জানে নাই
বোধ হয় কেউ বাসে নাই ভালো তাই জ্বালে নাই আলো
সময় সেলাই করে করে আপাতত একান্ত নিজের কবরে কাটাই” (ছবি আঁকা শেষ হলে : জেগে ওঠো পাখির প্রমায়)
২.
“যার ঘর নাই
সে ঘরের দিকে যেতে চায় ।
আর
যার ঘর আছে
সে ঘরের দিক থেকে উল্টো পথে হাঁটতে চায়।”
( ইচ্ছা )
৩.
“অহংকার থাকা ভালো। নম্র মুগ্ধ সাহসী বকুল
যেভাবে ছড়ায় প্রাণ, ভালোবাসা কিরিচের ধার
যেমন মূর্ছনা তোলে টান দেয় আনন্দের মূল
বিশুদ্ধ আগুন জ্বালে সংগীতের অলোকের সুর
আকাশে হাওয়ায় কাঁপে জাগে ধ্বনি মধুর ! মধুর !
অহংকার থাকা ভালো- বলে ওঠে সমস্ত সংসার”
(অহংকার থাকা ভালো)
৪.
“চমৎকার রোদ ফুটে আছে বৃক্ষের হাসির মতো।
বনে উপবনে যারা গায় বিতরণ করে সুর
রবীন্দ্র সংগীত তারা আমাদের বোন”
(সুন্দর তোমার নাম)
৫.
“যে খাদ্যকণাটি হঠাৎ তোমার হাত থেকে
খসে পড়ে গেলো মৃত্তিকায় ধুলায় অথবা ঘাসে
তার জন্য দুশ্চিন্তা করো না
করো না বেদনা নিয়ো না কষ্টের শোক
(৬৫তম জন্মদিনে : ফেসবুক ওয়াল)
৬.
“কবিতার চেয়ে সহজ মেধাবী
সর্বগ্রাসী কোনো আগুনের পথ নেই”
(ফেসবুক ওয়াল)

সর্বোপরি আবারও বলতে হয় কবির ভাই আমার নিত্য প্রেরণা। আমার যে মহাকাল পরিভ্রমণ সংক্রান্ত সিরিজ কবিতাবলী সম্প্রতি আর্টস বিডিনিউজ.কম-এ প্রকাশিত হয়েছে তার পেছনেও কবির ভাই প্রায় প্রাত্যহিক প্রণোদনার কথা আমি স্মরণ না করে পারি না। তাঁর অগাধ পাঠ অভিজ্ঞতা, অপরিসীম বিনয় এবং বন্ধু বাৎসল্যের তল আমি আজও খুঁজে পাইনি। তাই প্রতিনিয়ত পরিবর্তমান ভাষা ও আঙ্গিকের এই কবি চিরচেনা হয়েও নিয়ত অচেনা থেকে যান আমার কাছে।
কবির দীর্ঘ সৃষ্টিশীল সুস্থ জীবন কামনা করি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট