চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ড. মনিরুজ্জামানের

সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চট্টগ্রাম

এম আনোয়ার হোসেন

৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যের ইতিহাস চর্চায় বিভিন্ন গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন লেখকের আবির্ভাব ঘটে। আবার অনেক সময় সাহিত্যানুরাগীগণের মধ্যে কেউ কেউ এসব গ্রন্থের মধ্যে প্রাণ- সঞ্চার ঘটান। আবার কেউ কেউ লেখকগণকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত কিংবা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা বা প্রেরণা দিয়ে থাকেন। সাহিত্য জগতের ক্ষেত্রে তেমনি একটি অসামান্য গ্রন্থ রচিত হয় একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সাহিত্যের ইতিহাসকে ঘিরে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র কিংবা শিক্ষক-গবেষক অথবা অনুরাগীগণ ব্যতিত কিংবা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিচরণ তেমন একটা সহজ নয়। এ কঠিন ধ্যান-ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ড. মনিরুজ্জামান। তিনি সাহিত্যকে যেমন সহজ করে তুলেছেন, ঠিক তেমনি জানার বা জ্ঞানের জগতকেও সহজ করে তুলেছেন। তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে কঠিন পর্দাটি উন্মোক্ত করে দিয়েছেন সর্বসাধারণের জন্যে। এ লক্ষ্যে তিনি রচনা করেছেন “সাহিত্য ও সংষ্কৃতিতে চট্টগ্রাম” গ্রন্থ।

ড. মনিরুজ্জামান তার রচিত “সাহিত্য ও সংষ্কৃতিতে চট্টগ্রাম” সাহিত্য গ্রন্থে মূলত চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংষ্কৃতিকে ধারণ করেছেন। ফুটিয়ে তুলেছেন চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংষ্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে। চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সাহিত্যের ইতিহাসকে তুলে এনেছেন গভীর থেকে। সমাহার ঘঠিয়েছেন বাংলাসাহিত্যের অসংখ্য বিখ্যাত সাহিত্যিকের। সংকুচিত আকারে হলেও ৬৭৬ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থ। তাতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মধ্যযুগীয় বাংলাসাহিত্যের দিকপাল কিংবা আধুনিক সাহিত্য-সংস্কৃতির কর্ণধারগণের কথা বাদ যায় নি। লেখকের সাহিত্য-প্রীতি, বিচক্ষণতা, পা-িত্য এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে সাহিত্য জগতে কালের মহাসাক্ষী। গ্রন্থটি ১ম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে। প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের বিখ্যাত প্রকাশনী কোহিনুর প্রকাশন। লেখক নিজেও একজন বাংলাসাহিত্যের ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। বাংলাসাহিত্যে অসংখ্য পিএইচডি করা গবেষকেরও অভিভাবক বা শিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলাসাহিত্যে পড়া-লেখা শেষ করে চট্টগ্রাম কলেজেও শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি বাংলাসাহিত্য বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি একক কোন অভিধায় অন্তরিত নন। তিনি বহুমাত্রিকতায় কিংবা বহু অভিধায় পরিচিত। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, গল্পকার, ছড়াকার, উপন্যাসিক, ভাষা বিজ্ঞানী, গবেষক ও সম্পাদক। তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে পিতার কর্মস্থল ঝিনাইদহে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস নরসিংদী জেলার অন্তর্গত রায়পুর উপজেলার আদিয়াবাদ গ্রামে। তিনি রচনা করেছেন অনেক গ্রন্থ। তিনি নজরুল পদক, চট্টগ্রাম (২০০৭) এবং বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম শ্রেষ্ঠ গীতিকার সম্মাননাসহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। “প্রকাশকের কথায়” গ্রন্থের প্রকাশক কোহিনুর প্রকাশনার স্বত্ত্বাধিকারী দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, “লেখক ২০১৬ সালে গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। নজরুল ইনস্টিটিউট-র নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন ১৯৯০ সালে। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বহু সম্মান ও পুরুস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। এ গ্রন্থটি লেখকের বহুদিনের পরিশ্রমের ফসল। চট্টগ্রামের সাহিত্য সংষ্কৃতির মোটামুটি একটি সামগ্রিক চিত্র যথাসম্ভব তুলে ধরাই এখানে লেখকের উদ্দেশ্য। এ ক্ষেত্রে লেখকের যোগ্যতা অবিসংবাদিত ও প্রশ্নাতীত।”
সাহিত্য ও সংষ্কৃতিতে চট্টগ্রাম গ্রন্থে অনেক বিখ্যাত কিংবা গুণী সাহিত্যিকের জীবন কর্মস্থান করে নিয়েছে স্বমহিমায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশবরণ্য অথবা বিশ^বরণ্য মণীষী রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে প্রাচীন কাল, মধ্যযুগ এবং আধুনিক কালের সমন্বয়ে বিশাল এক গবেষণা লেখক তুলে ধরার প্রচেষ্টায় যথেষ্ট সফলও হয়েছেন। সর্ব পরিশিষ্ট ও নির্ঘণ্টসহ নয়টি ভাগে গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম ভাগে ভূমিকা ছাড়াও বাংলাসাহিত্যে চট্টগ্রামের অবস্থান এবং চট্টগ্রামের অঞ্চলগত অবদান নিয়ে বিশদভাবে বর্ণনা রয়েছে। চট্টগ্রামের অঞ্চলগত অবদান-র ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে সাহিত্যিকগণের বা এ কর্মের সাথে সম্পৃক্তদের নামের বিশাল এক তালিকাও তিনি প্রণয়ন করেছেন। যা লেখকের পক্ষে সত্যি কষ্টসাধ্য ছিল বলা যায়। এখানে অনুবাদ কর্ম, কবিবৃন্দ, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাট্য, সাহিত্য, ছড়াকার, গল্পকার, শিশুতোষ সাহিত্য, রঙ্গ-ব্যঙ্গ সাহিত্য, জীবনী, আত্মজীবনী, স্মারক গ্রন্থ, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞানও চিকিৎসা, ভাষা, অভিধান, কোষগ্রন্থ, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি সাহিত্য কর্মে সংশ্লিষ্টদের তালিকা রয়েছে। গ্রন্থের তৃতীয়ভাগে মধ্যযুগ আবিষ্কারের বিস্ময়কর সাধনায় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (সুচক্রীদ-ী, পটিয়া), ড. মুহাম্মদ এনামুল হক (বক্তপুর, ফটিকছড়ি), ড. আহমদ শরীফ (সুচক্রীদ-ী, পটিয়া) নিয়ে যেমন সাহিত্যাঙ্গনের আলোচন হয়েছে, তেমনি চতুর্থভাগে ইতিহাস ও লোকালয় সংস্কৃতির ইতিহাস সন্ধানে ঐতিহাসিক ড. আবদুল করিম (চাঁপাছড়ি, বাঁশখালী), আবদুল হক চৌধুরী (রাউজান), আবদুস সাত্তার ও অন্যান্যরা সম্পর্কে বর্ণনা উপস্থাপন হয়েছে।

অবশ্যই চট্টগ্রামের সপ্তর্ষিম-লে আলোচন হয়েছে দুই মহাকবি তথা নবীন সেন ও হামিদ আলী এবং এতে বরণীয় কৃতী পঞ্চক যথাক্রমে মাহবুব উল আলম, আবুল ফজল, সুচরিত চৌধুরী, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ নিয়ে বিশদ আলোচনা এসেছে। গ্রন্থের অন্যান্য ভাগে প্রয়োজনীয় ব্যাপক আলোচনাও হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-বুলবুল চৌধুরী, জগদানন্দ বড়–য়া, কামাল এ খান, সত্য সাহা, মোহনলাল দাশ, রমেশ শীল, ভা-ারী শিল্পী আবদুল গফুর হালি, মৌলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী, কমরেড কাকা বাবু, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম আসহাব উদ্দিন আহমদ, নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস, বেণী মধাব বড়–য়া, মনীন্দ্র বড়ুয়া, অমিতাভ বড়–য়া, শিমুল বড়–য়া, কবি বিমলেন্দু বড়–য়া, সুমন, রেবতপ্রিয় বড়–য়া এবং জ্যোতিপাল মহাথেরো প্রমুখ। গ্রন্থের, প্রথম ভাগ : চট্টগ্রামের সাহিত্য পরিস্থিতি-ভুক্ত ‘কবিবৃন্দ’ অনুচ্ছেদে পনের পৃষ্ঠার তালিকায় অসংখ্য কবিদের আমার পরিচিত এবং বর্তমানে সজস্বী কবিগণের মধ্যে- কবি অরুণ দাশগুপ্ত (ধলঘাট, পটিয়া), কবি আবুল মোমেন,কবি স্বপন দত্ত, কবি সুভাষ দে, কবি রাশেদ রউফ, কবি মাহমুদল হাসান নিজামী, কবি আইনুন নাহার, কবি তহুরীন সবুর ডালিয়া, এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা, মুনির আহমেদ, আহমেদ মওলা, ঋত্বিক নয়ন, উৎপল দত্ত, জান্নাতুল নাঈম, জরিনা আকতার, সৈয়দা লুৎফুন্নিসা স্ব স্ব জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। (পৃষ্ঠা ঃ ৩৫-৪৬)।

অধুনান্তিক তৎপুরুষে নবম ভাগে- দ্রোহী আহমদ ছফা (গাছবাড়িয়া, চন্দনাইশ), কবি অরুণ সেন (বোয়ালখালী), কবি খুরশীদ আনোয়ার (পাঠানটুলি, চট্টগ্রাম মহানগর), কবি মহীবুল আজিজ (জন্ম: ১৯৪৭-মৃ.২০১৪), বিপ্রদাশ বড়য়া (ইছামতি, রাংগুনীয়া), হরিশংকর জলদাস (উত্তর পতেঙ্গা,মহানগর), দেবাশীষ ভট্টাচার্য, চৌধুরী জহুরুল হক (বাজালিয়া, সাতকানিয়া), সত্যব্রত বড়–য়া, দরখ শাঁ আখতার ফাহমিদা খাতুন, সবিহউল আলম, মোহাম্মদ হোসেন খান (আনোয়ারা), এজাজ ইউসুফী (কবি সম্পাদক, উত্তর আধুনিক আন্দোলন-লিরিক), উমরতুল ফজল (১৯২১-২০০৫), বেগম মুশতারী শফি, অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম (রাউজান) সহ কক্সবাজার পর্বে অধ্যক্ষ মোশতাক আহমদ, ড. শফিউল আলম প্রমুখের সাহিত্যের ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল কর্ম নিয়ে আলোকপাত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যায়ের ৩২ পরিবার ও নতুনচন্দ্র সিংহ, চট্টগ্রামের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার সংষ্কৃতি: আজাদী ও পুর্বকোণের কথা এবং ছোট দেশের এক বড় বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলামকেও স্বমহিমায় সাহিত্যে ও সংষ্কৃতিতে যথাযথ প্রকাশের প্রয়াস চালিয়েছেন গ্রন্থকার।

চট্টগ্রামের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার সংষ্কৃতি: আজাদী ও পুর্বকোণের কথা সর্ব পরিশিষ্টে সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও তার দৈনিক আজাদী পত্রিকা নিয়ে তথ্যবহুল গবেষণা স্থান পেয়েছে। যদিও কোন কারণবশত পূর্বকোণের কথা নির্দিষ্ট পরিশিষ্টে আলোকপাত হয় নি। আশা করি গ্রন্থের পরবর্তী সংষ্করণে সেটি বাদ যাবে না। লেখক এ গ্রন্থে স্বীয় বন্ধু, চট্টগ্রামের সন্তান অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ড. অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস এবং বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংষ্কৃতিতে স্ব স্ব গুণ এবং কর্মের কথা অকপটে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও কর্মজীবনের সাথী হিসেবে নিজস্ব সংষ্কৃতি ও কিছু স্মৃতি তুলে ধরেছেনে। যেমন, লেখকের গ্রামে বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরের আদিয়াবাদে গ্রামীণ ব্যাংক করার সময় লেখকের খালি বাড়িতে ঘুরে আসেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনুস, (২)এ কথাও তুলে ধরেছেন লেখক। অন্যদিকে উল্লেখ করেছেন, বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলামের মাতা রাহাত আরা ১৯৪৩/৪৪ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক অনুবাদ করে সাহিত্যে পরিচিতি লাভ করেন।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে কেউ যদি জন্ম গ্রহণ করে থাকেন অথবা এখানে বসতি করে থাকেন অথবা এখানে আপনার সাহিত্য কর্ম ছিল লেখকের গবেষণাকালীন সময়ে অথবা এ সময়ের পূর্বে, তবে আপনার নামটি এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। অন্তত নামটি তুলেছেন এবং তাতে লেখক কার্পণ্য করেননি। লেখক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট অথবা সাহিত্য জগতে যদি আপনার বিচরণ থাকে তবে আপনি এ গ্রন্থ থেকে বাদ পড়েছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু গ্রন্থের বিজ্ঞ লেখক স্বীয় অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে অনুল্লেখিত থেকে যাওয়ার সন্দেহেকে উড়িয়ে দেন নি। এ কারণে তিনি গ্রন্থের ভূমিকায় দুঃখবোধের কথাও উল্লেখ করেছেন। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে চট্টগ্রাম শুধুমাত্র ঘটনাবহুলই নয়, বরং বিভিন্ন দিক থেকে তা তাৎপর্যময় এবং বৈচিত্রপূর্ণও বটে। এ বিষয়টি তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশাল এ গ্রন্থে লেখক স্বীয় ঐকান্তিক প্রচেষ্টার তেমন ত্রুটি করেছেন বলে মনে হয় না। লেখক যেহেতু আধুনিক কালের একজন উঁচুমাপের সাহিত্যিক, যিনি সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, আবার তাও বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, সেহেতু তিনি সাহিত্যের এ গ্রন্থে মেধা, মনন, অভিজ্ঞতা কিংবা সৃষ্টিশীলতা পুরোপুরিই রেখেছেন বলা যায়। চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংষ্কৃতির ক্ষেত্রে লেখকের এ বিশাল গবেষণায় যেমন ফুটে উঠেছে মহাকবি নবীন সেন, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মৌলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড.আহমদ শরীফ, জগদানন্দ কিংবা রমেশ শীল প্রমুখের সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম, তেমনি আধুনিক কালের খ্যাতিমান অথবা অখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, লেখকের পাশাপাশি নবীন কিংবা প্রধান পদচারীগণের বিশাল এক তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে সাহিত্যেকে সমৃদ্ধ করেছেন নিঃসন্দেহে। গ্রন্থে সন্বিবেশিত যে কোন একটি তালিকায় হয়ত আপনিও আছেন, যদি আপনি সাহিত্য-সংষ্কৃতির যে কোন ক্ষেত্রে ন্যূনতম ভূমিকা রেখেছেন লেখকের গবেষণার সমসাময়িককালে অথবা এর পূর্বে।

চট্টগ্রামের প্রাচীন, মধ্যযুগ কিংবা আধুনিক কালে লেখক-সাহিত্যিকগণের কর্ম-দর্শন ফুটে উঠেছে স্ব-মহিমায় এ সাহিত্য গ্রন্থে। ‘কথাসাহিত্য: ছোটগল্প ও উপন্যাসের’ তালিকায় স্থান করে নেয়া অসংখ্য নবীন-প্রবীণের মেলা। যেমন,অনন্ত চক্রবর্তী, অনীশ বড়ুয়া, অভীক ওসমান, অমিত প্রসাদ মুৎসুদ্দী (রাউজান), আকাশ মাহমুদ (মীরসরাই), আহমেদ মুনীর (ফেনী), ওহীদুল আলম (ফতেয়াবাদ, হাটহাজারী), খালেদ বেলাল (সন্দীপ), দেবাশীষ ভট্টাচার্য (সীতাকু-), ফজল উশ শিহাব (হাজীপাড়া, চন্দনাইশ), বিশ^জিত সেন (বোয়ালখালী), মশউদ-উদ-শহীদ (সাতকানিয়া), মোরশীদুল আলম চৌধুরী (বাঁশখালী), অধ্যাপক এম এ হাসান (মেহেদীগুল, ধামাইরহাট, রাংগুনীয়া), নুরুল হুদা (পুকখালী,কক্সবাজার), মোহাম্মদ হোসেন খান (আনোয়ারা), সবিহ-উল-আলম (কাজীর দেউড়ী, আলম পরিবার), অভিনেতা-লেখক সাফায়াৎ খান (নালাপাড়া, মহানগর), সৈয়দ ইকবাল (ওআর নিজাম রোড, মহানগর), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (লাল সালু, শুলকবহর, পাঁচলাইশ, মহানগর), সৈয়দ মোহাম্মদ হাসেম (রাংগামাটি) প্রমুখ। এ তালিকায় মহিলা কথাশিল্পীগণের মধ্যে কয়েকজনের নাম, যেমন- খালেদা হানুম, (নানুপুর, ফটিকছড়ি), শহীদজায়া মুশতারী শফী, মুক্তিযোদ্ধা মিনু রানী দাশ (পাথরঘাটা), তাহুরুন সবুর ডালিয়া, ফেরদৌস আরা আলীম, রুনু সিদ্দিকী, মমতাজ সবুর, মর্জিনা আখতার, সৈয়দা সেলিমা আক্তার, অধ্যক্ষ সুনন্দা বড়–য়া, শিরীন আখতার (রামু, কক্সবাজার), খালেদা সিনহা (ডুলাহাজারা, কক্সবাজার), আলেয়া চৌধুরী (কোয়ে পাড়া, রাউজান). নাজনীন আকতার রেখা (কাটিরহাট, হাটহাজারী), ফরিদা হোসেন (মীরসরাই), নিশাত হাসিনা শিরীন (ফতেনগর, চন্দনাইশ), নুরুন্নাহার শিরীন ( কুমিল্লা, অভিবাসিত), নাসরিন সুলতানা, নিগার আহমদ, ড.রনজিৎ কুমার বিশ^াস (পোমরা, রাংগুনীয়া), রফিক আনোয়ার (নানুপুর, ফটিকছড়ি) প্রমুখ।

প্রফেসর ড. মনিরুজ্জমান এ গ্রন্থের প্রথম ভাগের পরিযোজন-এ ‘চট্টগ্রামের সাহিত্য ধারা ও লেখক-নামের তালিকা’ মধ্যযুগ ও আধুনিক কালের সমন্বয়ে শত শত লেখকের নাম সংযোজন করেছেন। (৫) তাতে বিভিন্ন শ্রেণী ভেদে উপস্থাপন করা হয়। এতে যারা খ্যাতিমান তারা স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন। যেমন, বঙ্গানুবাদ ও ইংরেজি অনুবাদ কর্মে ড. অনুপম সেন, ড. আনিসুজ্জামান, ড. মনিরুজ্জামান, ড. মোহাম্মদ আলী, ড. মোহিত উল আলম, ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী, ড. শাব্বির আহমদ, আবুল মোমেন, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ড. আহসান সাইয়েদ, আবদুর রশিদ সিদ্দিকী (কক্সবাজার), সৈয়দ আহমুদুল হক, ফজলুল হক, নেছারুল হক (মুসলিম শরীফের প্রথম বঙ্গানুবাদ), অজয় দাশগুপ্ত, এটিএম শামশুদ্দিন (সাংবাদিক), ওমর কায়সার, নাজিম উদ্দিন শ্যামল, রাশেদ রউফ (সুকুমার বড়–য়া প্রমুখের নির্বাচিত ছড়ার অনুবাদ), অধ্যাপক সরোজ বড়–য়া, সুরেশ রঞ্জন বসাক, নীলুফার শামশুদ্দীন, সুপর্ণা দাশ, মধুমিতা কানুনগো, ফজিলাতুন কদর (কোরান থেকে অনুবাদ), সুমঙ্গল বড়–য়া (ত্রিপিটক অনুবাদ, রাউজান), প্রমুখ। তেমনি তালিকায় রয়েছে এতদ্ব অঞ্চলের কবিগণের নামের তালিকা। নাট্য-সাহিত্যে পূর্ব ধারা-আধুনিক ধারা, প্রবন্ধ, ইতিহাস ও গবেষণায়-পূর্বসূরীগণ ও আধুনিক ধারা, লোক সাহিত্য-সংষ্কৃতি, ভ্রমণ সাহিত্য, শিশু সাহিত্য, রঙ্গ ব্যঙ্গ সাহিত্য, জীবনী, আত্মজীবনী, স্মারক গ্রন্থ, দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা, ভাষা, অভিধান, কোষগ্রন্থ, শিক্ষা, সংষ্কৃতি, সমাজ এবং চট্টগ্রামের অঞ্চলগত কয়েকটি পর্বে শত শত লেখকের নাম তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে এ গ্রন্থে। বিভিন্ন শ্রেণীতে খ্যাতিমান ছাড়াও আধুনিক কালের প্রবীণ কিংবা নবীন লেখকগণের নামও দেখা যায় তালিকায়। যেমন পরিচিতগণের মধ্যে কয়েক জনের নাম উল্লেখ করা হল- আহমদ রায়হান, ইকবাল করিম রিপন, ইলু ইলিয়াস, এম এ জিয়া হাবিব আহসান, কাশেম শাহ, খনরঞ্জন রায়, চিন্ময় মুৎসুদ্দী, (পৃষ্ঠা- ৬৮-৬৯)। অনন্ত ইউসুফ, অনিল চক্রবর্তী (চিহ্ন সম্পাদনা), অর্নিবাণ বড়–য়া, অরূপ বড়ুয়া, আ.ব.ম খোরশেদ আলম খান (সাংবাদিক, লেখক), আকাশ মাহমুদ, একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার, আজাদ বুলবুল, আরিফ চৌধুরী (কবি, প্রাবন্ধিক), আলম খোরশেদ (ফটিকছড়ি : কবি ও সম্পাদক), এড. আসিফ ইকবাল (সম্পা.মাসিক জিবি সংবাদ) (পৃষ্ঠা : ৬৬-৬৭)। দিদার আশরাফী, নুর মোহাম্মদ রানা, বেলাল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ আবদুল বাতেন (পৃষ্ঠা- ৬৩ ও ১১৩), সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক, অধ্যক্ষ গোপাল কৃঞ্চ মুহুরী, অধ্যাপক মুফিজুর রহমান, ড. জিনবোধি ভিক্ষু, অধ্যাপক বাদল বরণ বড়–য়া, অধ্যাপক মাওঃ মনিরুল ইসলাম রফিক, ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ, অধ্যাপক রতন কুমার তুরী, রফিক সিকদার, রায়হান মিজান (কলামিস্ট), মাওঃ জহুরুল আনোয়ার, সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন, উৎপল কান্তি বড়য়া, নজরুল ইসলাম হাবিবী প্রমুখ।

(উপরোক্ত নামগুলো পাশে উল্লেখিত পৃষ্ঠা নম্বরে রয়েছ, নামের সাথে পৃষ্ঠার ধারাবহিকতা নেই, পৃষ্ঠা- ৭৫,৭৮, ১০৮,১০৯, ১৩১,১৩৯, ১৪২,)।

প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামানের “সাহিত্য ও সংষ্কৃতিতে চট্টগ্রাম” গ্রন্থটি আধুনিক কালে এক অভাবনীয় সফলতা এনে দিয়েছে সাহিত্যের ক্ষেত্রে। চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সাহিত্যের ইতিহাসকে একীভূত করে বিশালাকারে এর পূর্বে সম্ভবত আর কোন গ্রন্থ প্রকাশ হয় নি। এ গ্রন্থে যেমন প্রাচীন ও মধ্যযুগের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ঠিক তেমনি আধুনিক কালেরও সমন্বয় ঘঠেছে। শ্রেণী বিন্যাসের মাধ্যমে লেখক-সাহিত্যিকের বিশাল এক আলোচনা এবং বিশাল এক তালিকাও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি কিন্তু খুব একটা সহজ সাধ্য কাজ ছিল না। এটি এক তথ্যভিত্তিক দীর্ঘ গবেষণার ফলশ্রুতিতে সম্পন্ন হয়েছে নিঃসন্দেহে। লেখক নিজের গবেষণাকে পরবর্তী গবেষকের ভাবার কথাও এড়িয়ে যান নি। আবার অন্যদিকে লেখার আকার ও মান বিষয়ে সকল অভিযোগ লেখক স্বীয় শিরোধার্য হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। তবে এটাও ঠিক যে, সাহিত্যাঙ্গনে চট্টগ্রামের একটা বিশাল অবদান ছিল এবং আছে, সেটাই তিনি প্রমাণ করেছেন এ গ্রন্থে। সম্ভবত এ কারণেই গ্রন্থটির বিষয়ে লেখককে বারংবার তাগাদা দিতেন প্রকাশক। তবে এটি আজ নিঃসন্দেহে বলা যায়, সাহিত্যাঙ্গনে গ্রন্থটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। থাকবে কালের সাক্ষী হিসেবে। আগামী প্রজন্মের কাছে লেখকও স্বরণীয় বরণীয় থাকবেন নিঃসন্দেহে।

শেয়ার করুন