চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

মহি মুহাম্মদ এর কয়েকজন শেফালির গল্প

সিরাজুল মোস্তফা

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৮ পূর্বাহ্ণ

অন্ধকার রাত। চারদিক নিস্তব্ধ হাহাকার। এ শহর ঘুমের রাজ্যে পতিত হয়েছে। আকাশে মেঘেদের আনাগোনা। তাই চাঁদের আলো খানিকটা ধূসর বর্ণের লাগছে। রাস্তার ধারে সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলছে। নৈশব্দ্য এ রাতে আরও কিছু তৃষ্ণার্ত চোখ অন্ধকারে খাবি খাচ্ছে। যা দেখার সুযোগ সবার ভাগ্যে জুটে না। যা কেবল ধরা পড়ে চাতক পাখির মতো ওঁৎ পেতে থাকা লেখকদের তৃতীয় দৃষ্টিতে। মহি মুহাম্মদ তাঁদেরই একজন। যাঁর গল্পের উপকরণ চারপাশটার বিচিত্র সব উপকরণ। ভিন্ন ধারার রকমারি সব মণিহার তাঁর গল্পে লক্ষণীয়। ‘কয়েকজন শেফালির গল্প’ এমন একটি গল্পগুচ্ছ। এতে বারোটি গল্পের বেণিসুতোর মালা রয়েছে। লেখক তাঁর গল্পে সমাজপতিদের মুৃখোশ টেনেহিঁচড়ে খুলে দিয়েছেন। পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একই জগতে বসবাসকারী ভিন্ন চরিত্রের দুর্লভ চরিত্রাদির সাথে। তাঁর প্রতিটি লেখনীতে সমাজকালের বৈষম্য, বৈসাদৃশ্যতা কবিতার অমোঘ শক্তির ন্যায় জেগে ওঠে। প্রান্তিক মানুষগুলোর অসহায়ত্ব দুর্বলতার সুযোগ লুটে নেওয়ার লুটতরাজ গল্পগুলো নাড়া দেবে মননের গভীর শিকড়ে। এ গল্পটির পাঠককে ধৈর্য্যরে খানিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। দু’চারটা অলিগলির বইয়ের মতো পড়ে তার স্বাদ আহরণ দুষ্প্রাপ্য হতে পারে। সচেতন পাঠক পড়তে পড়তে চলে যাবে এক ভিন্ন জগতে। যে জগতে তাঁর সাথে পরিচয় হবে পরিচিত কিছু মুখের বিকৃতরূপ। যা তাকে ভাবনার দোলাচলে দোলাবে। নিশিযাপন নামক প্রথম গল্পে লেখক অজানা অচেনা এক নারীর খপ্পরে পড়ে। তাঁকে নিয়ে সে হাস্যরস্য করে। সে বলে, ‘আশ্চর্য পুরুষ মানুষ তো আপনি। ওভাবে রিকশার কোণে পুঁটলি হয়ে আছেন কেন? রিলাক্সড্ হয়ে বসুন। এক অজানা পথে নিয়ে যায় সে লেখককে। আলোর যতি টেনে দিয়ে অন্ধকারে জ্বেলে দেয় তাঁর দেহে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। দ্বিতীয় গল্পটি শেফালির করুণ জীবনের। হরিশ বাবুর লাইনে হাজার টাকায় সে ঘর ভাড়া নেয়। বাবার সংসারের টানাপড়ন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তার মা তাকে কাজ খুঁজতে বলে। সাদেক তাকে গার্মেন্টে কাজ দেবার লোভ দেখিয়ে একসময় হরণ করে। তাকে নামিয়ে দেয় ভিন্ন এক জগতে। যে জগতে কত আলো মনের অনিচ্ছায় অন্ধকারের চোরাবালিতে তলিয়ে যায়। তৃতীয় গল্প, বর্ণা, খোকা ও আমি। সে গল্পে উঠে আসে ভার্সিটির সবার ক্রাশের সে মেয়েটিও নিশিকন্যা বনে যাওয়ার করুণ চিত্র। জীবন তাকেও ক্ষমা করেনি। চতুর্থ গল্পে ফোটে উঠে রাবেয়ার কণ্ঠে, ‘বেবাক পোলারা কুত্তার ছাও, কাম করার আগে মেয়া মাইনষের মুত পর্যন্ত খাইতে পারে কাম শেষ তোমাগো মিষ্টি মিষ্টি কথাও শেষ।’
রাবেয়া জাতগত লোপার। বিয়ের পর স্বামীর মাামাতো ভাইয়ের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায়। পরে স্বামীর ঘর ছাড়া হয়্ তাতেও ক্ষান্ত হয়নি সে। নানা পুরুষের বিছানার গন্ধ নেয়। শেষে বোনের স্বামীর হাত ধরে পালায়। পঞ্চম গল্প ‘পুরুষের মৃত্যু’।

রিমি গায়ে গতরে বেশ সুশ্রী। অপ্সরী বলা যায়। বড় জায়গায় চাকুরি করত। মাইনেও ছিল বেশ। অফিসের স্যারদের নজরে আসে তার রূপের খাবিখেলা। ব্যবহার হতে থাকে অর্থের মাতাল মোহে। একসময় তার মালিকের নজরে আসে সে। ধনবান মালিক অর্থবিত্তের প্রাচুর্যে তাকে রক্ষীতার আসন দেয়। মাঝেমধ্যে আসে বন্ধুবান্ধব নিয়ে সুরা পান করে। রিমির ভাবনায় আসে ধনী পুরুষের মতো তারও একটা পুরুষ রক্ষীতা প্রয়োজন। তাই অচেনা মিন্টুকে নিয়ে আসে আপন আলয়ে। ষষ্ঠ গল্প ‘নিশিগন্ধা’। নিশি ভালো ছাত্রী ছিল। বাবা কটন মিলে কাজ করে। তিনবোন এক ভাই মা-বাবা। ছোট্ট সংসার। বেশ চলছিল দিনকাল। হঠাৎ বাবার চাকুরি হারানো। ছিন্নভিন্ন করে দেয় সোনার সংসারকে। এ শহরে টাকা ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। বাবা-মা আর ভাই-বোনদের কষ্টের প্রতিটি শিখা তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে। বাধ্য হয় সে নারীত্ব বিলীন করতে। তারেকের সাথে তার কলেজ জীবনে প্রেম। এ পথে নামার আগে তারেকের কথা তার মনে বারবার দোল খাচ্ছিল। তবে সংসারের বিস্বাদের কাছে এসব পানসে লাগছিল। একদিন সাতসকালে তারেকের বাবার অফিস থেকে বের হওয়ার পথে তারেকের সাথে দেখা। সে বলে চাকুরির খোঁজে এসেছে। তারেক বুঝতে পারে বাবার অফিসে সাতসকালে কীসের চাকুরি। পরবর্তী সে চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয়। সংসারে আলো ফিরে আসে। একরাতে ছোট বোন তিশাকে তার বন্ধুর সাথে রিকশায় অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দেখে প্রশ্ন করতেই সে মুখের উপর বলে, তোর মতো বেশ্যাগিরি তো করিনি। নিশি পুরো পৃথিবী অন্ধকার দেখে। রাতের শেষ ট্রেনটির অপেক্ষায় থাকে। পৃথিবী থেকে মুছে যায় সে রাতে তারাটি। সপ্তম গল্প ‘বারনারী’। এ গল্পে বারনারীর মুখ ফোটে খইয়ের মতন। সে বলে, ‘তোমরা পুরুষ তোমাদের আমার চেনা আছে, অধরা নারীর কাছে কবিতা বের হয়। আর স্ত্রীর উপর টাকা নিয়ে হাপিত্যেশ কর। অষ্টম গল্প ‘পঞ্চাশ টাকা’। এ গল্পে ময়না মাত্র পঞ্চাশ টাকার জন্য হন্যে হয়ে উঠে। শেষমেষ কাউকে না পেয়ে পথের দ্বারে তাসের খেলায় মশগুল তিন গাঁজাখোরের দিকে নজর পরে। তাদের টাকা নিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়। পরিশেষে ধরা পড়ে চুরিকাঘাতে ভূপাতিত হয়। নবম গল্প ‘ফইরানির কুকুর’। ফইরানি তাঁর দুর্বিষহ কষ্টে লেদুর মতো সহচর পায়। যার কাছে সে কুকুরের মতো পড়ে থাকতে চায়। দশম গল্প ‘ছাইরঙা হাঁস’। এ গল্পে মণির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আলমস্যার তাকে লুঠে নেয়। বিনিময়ে সেও অর্থ আর স্যারের বউয়ের গয়নাগাটি নিয়ে যায়। রাস্তার ধারে সে নেতিয়ে পড়ে। একাদশ গল্প ‘কুলটা’। বারভাতারি বিথীকে দেখে প্রেম জেগে উঠে লেখকের। কিন্তু তার পরিণতি কয়েকটা কিল ঘুষি ছাড়া অর কিছু জুটেনি। দ্বাদশ গল্প এবং শেষ গল্পটি হলো ‘বৃষালী’। মহামায়ার ঘরে জন্ম নেয় অম্বপালি। রূপে গুণে অনন্যা। দিনে দিনে সে বড় হয় মহামায়ার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। মেয়ের বিবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। নগরপিতা বলে, ‘অনর্বিহ স্ত্রীরত্নম’ অর্থাৎ: স্বাধীনা নারী সকলের ভোগ্য। অম্বপালি রাজি হলো। তবে শর্ত জুড়ে দিল । সে কল্পিত এক রাজপুত্রের অপেক্ষাই কাটায়। রাজা বিম্বিসারের খ্যাতি তখন তুঙ্গে। বিশ্বস্ত অনুচর থেকে তিনি বৈশালি নগরের খবর পেলেন। অবশেষে বিম্বিসারের সাথে আম্বপলির সার্থক সাক্ষাৎ হয়। এর মধ্য দিয়ে এই গল্পগুচ্ছের ইতি হয়। রাতটাও তখন শেষের প্রহর গুণছে। প্রিয় কথাসাহিত্যিক মহি মুহাম্মদের লেখনীর তীব্রতা যেমন হীরক খ-ের ন্যায় ধারালো তেমনি কবিতার মতো অবিশ্রান্ত। যুক্তির মোহনীয় শক্তিতে হারিয়ে নিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। কয়েকজন শেফালির গল্প পাঠক প্রিয়তার চ’ড়া স্পর্শ করবে আশা করি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট