চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

স্টুডিও এ্যাপার্টমেন্ট

এমিলি মজুমদার

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:২৪ পূর্বাহ্ণ

ফ্ল্যাটে উঠেছে বেলি। ছোট্ট ফার্নিস্ড ফ্ল্যাট। একটা বেডরুম, কিচেন, বাথরুম , আর ড্রইং /ডাইনিং/ লিভিং মিলে খোলা জায়গা। বেশ সুন্দর প্ল্যান করে সাজানো হয়ছে ফ্ল্যাটটা। প্রথম দেখেই বেশ শিহরিত ছিল সে। দুটো বারান্দা। ২২তলা দালানের ১৭তলায়। প্রথম যেদিন দেখতে এসেছিল, বারান্দাতে দাঁড়াতেই শরীর হিম হয়ে এসেছিল ওর। রেলিং দিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই পারছিল না। পা থেকে শুরু করে সারা শরীর শিরশির করছিল । আকাশের বেশ কাছাকাছি । আনন্দ-ভয় উভয় মিশ্রিত এক অনুভূতি। চারপাশটা বেশ সুন্দর । পর পর অনেকগুলো সু-উচ্চ সমমাপের দালান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুন্দরভাবে। চারদিক খোলামেলা। এক দালান থেকে অন্য দালানের দূরত্বও একেবারে কম নয়। প্রতিটা দালান ঘিরে লাগানো হয়েছে কৃষ্ণচূড়া, আর পাম ট্রি। কৃষ্ণচূড়া দেখে অবাক হয়েছিল ও। যাই হোক একটা দেশ দেশ ভাব ফিল করছে কৃষ্ণচূড়া দেখে। প্রতি দালানের সামনে রয়েছে ছোট ছোট রকমারি ফুলের সাজানো বাগান। পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে সুপরিসর জায়গা। কিছুটা দূরে একটা লেক দেখা যাচ্ছে। বসার জন্য সারি সারি রংবেরংয়ের বসার জায়গা। মন জুড়িয়ে যাওয়া এক পরিবেশ ।

বেলি, ২৫ বছর বয়সি তরুণী। বাবা-মা, দু-বোন নিয়ে পরিবার। বাবা মাঝারি আয়ের একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেন, মা গৃহিণী। প্রাচুর্য্য বলতে যা বোঝায় তা নেই, কিন্তু আছে স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে ভোগ করার আনন্দ। বেলি ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে একটা বিদেশী ফার্মে বেশ ভালো মাইনের একটা চাকরিতে জয়েন করেছে বছর দুয়েক আগে। ছোট বোন জুঁই অনার্স পড়ছে। দু’বোন পাঁচ বছরের বড়ছোট হলেও হরিহর আত্মা, ভালো দুই বন্ধুর মত ।
অফিস থেকে যখন দু-বছরের একটা প্রজেক্ট নিয়ে মালয়েশিয়াতে আসার এ সুযোগটা পায়, লুফে নিয়েছে বেলি । কিন্তু মা বেঁকে বসেছিলেন, মেয়েকে একা এভাবে বিদেশে পাঠাতে রাজি ছিলেন না মা। অনেক কষ্টে বাবা আর জুঁইয়ের সাহায্য নিয়ে তবে মায়ের পারমিশন পাওয়া যায়।

অফিস থেকেই দিয়েছে ফ্ল্যাটটা। ম্যানেজার ফ্ল্যাটের সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। এখানে জয়েন করেছে প্রায় ১৫ দিন। এ ক’দিন হোটেলেই ছিল বেলি। অফিস-ই ব্যবস্থা করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর এই প্রথম দেশের বাইরে পা রেখেছে একা। মা তো কাঁদতে কাঁদতে শেষ । কিন্তু বাবা খুব উৎসাহ দিয়েছেন সবসময়। বাড়িতে দু’বোন এক সাথে একই রুমে থাকতো। চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়া আসার পর খুব রোমাঞ্চিত ফিল করছে বেলি।
ফোন বেজে ওঠে। মা ফোন করেছে। একটু পরে করছি বলে ফোনটা রাখে বেলি। ম্যানেজার ফ্ল্যাটটা বুঝিয়ে দিয়ে বের হতে চাইলে ও আটকায়। কিছু খাবার দাবার কিনতে হবে। তাই এ ব্যাপারে ম্যানেজারের সাহায্য চাইলো। ম্যানেজারকে সাথে নিয়ে সুপার মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা সেরে নেয় সে। বেলিকে ফ্ল্যাটের নিচে নামিয়ে ম্যানেজার ফিরে যায়। লিফ্টে ছোট একটা ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে ওর মা আরেক হাতে একটা ‘পাপ্পী’ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। বেলি লিফ্টে উঠতেই মহিলা একটু সরে দাঁড়ায়। সাদা লম্বা লম্বা লোমে আবৃত পাপ্পীটা থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। আরেকজন ছিলেন বৃদ্ধা, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ছোট একটা ব্যাগে বোধ করি ডিনার কিনে ফিরছেন। চোখে চোখ পড়তেই হাসি বিনিময়। ১০তলায় নেমে পড়লেন বৃদ্ধা। ছোট মেয়েটা মায়ের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। বেলি ওর দিকে তাকাতেই, চোখ পিটপিট করে, জামার কলার কামড়াতে কামড়াতে, মায়ের দু’পায়ের মধ্যখানে ঢুকেই যাচ্ছিল প্রায়। বেলি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয়। মহিলা বাচ্চা আর কুকুর ছানা হাতে ১৪তলায় নেমে যায়। বাচ্চা মেয়েটা কলার কামড়াতে কামড়াতে, চোখ পিটপিট করে আমারদিকে তাকাতে তাকাতে নেমে যায় লিফ্ট থেকে। হাত নাড়িয়ে বাই জানায় বেলি।

ফ্ল্যাটে এসে ঢোকে ও। রয়েল ব্লু একটা ডাবল সিটের সোফা, সামনে একটা গোল গ্লাসের টেবিল, আরেক পাশে রাখা আছে সোফার সাথে সেট করা দুটো মোড়া। মাঝখানটা অফ হোয়াইট একটা কার্পেট। এক পাশে একটা কর্নারে রাখা দুটো শোপিস। আরেক কর্নারে একটা টেবিল ল্যাম্প। ছোট ছোট তিনটে একই সাইজের পেইন্টিং টাঙানো আছে এক দেয়ালে। ড্রইংরুমের একপাশ পুরো গ্লাস দেয়া। ভারী অফ হোয়াইট পর্দা সরাতেই নীল আকাশ। ছোট্ট ছিমছাম ছবির মত একটা ড্রইং রুম। মা’কে তাড়াতাড়ি ভিডিও কল করে বেলি। মা ফোন ধরতেই খুব খুশি মনে পুরো ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখাতে থাকে। এতক্ষণ ম্যানেজার থাকাতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারছিল না। মায়ের মুখেও পরিতৃপ্তির হাসি। অনেক কষ্ট করেছে মেয়েটা। এখন একটু ভালো থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে শংকিতও হয়ে ওঠে মায়ের মন, একা সবকিছু সামলে নিতে পারবে তো মেয়েটা ! স্বামীর হাতে ফোনটা দিয়ে, দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে ঠাকুরকে স্মরণ করে মা। মায়ের পর বাবা, বাবার পর বোনের সাথে কথা বলে ফোন রাখে ।
বেডরুমে এসে ঢুকে জানালার ভারী রয়েল ব্লু পর্দা সরাতেই নজরে আশে হাল্কা আকাশী নেটের পর্দা। ভারী পর্দা সরিয়ে ধড়াস্ করে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়, হাল্কা আকাশী দেয়ালের রঙ। আর একই রঙের মোটা গদীআঁটা খাট। দুপাশে দুটো বেডসাইড টেবিলে রাখা আছে দুটো টেবিল ল্যাম্প, যার শেড পর্দার সাথে ম্যাচ করা। একপাশের ওয়ালে লাগানো হয়েছে টিভি। মাথার কাছের ওয়ালে পাশাপাশি তিনটে একই সাইজের চিকন লম্বা পেইন্টিং স্টেপ করে লাগানো। একপাশে একটা ওয়ালে চার দরজার আলমিরা। বেলি উঠে বসে। আলমিরার একটা দরজা টান গিয়ে খুলতেই বুঝতে পারে যে, ওটা ড্রেসিং টেবিল। এক কোনায় রাখা আছে একটা ছোট টেবিল আর একটা চেয়ার।

বড্ড চায়ের নেশা পেয়েছে। নিজেকেই করে নিতে হবে, এখানে তো ফরমাযেশ খাটার জন্য মা নেই। ধীর পায়ে কিচেনে ঢোকে ও। কেবিনেটের দরজা টান দিতেই সব প্রয়োজনীয় জিনিস থরে থরে সাজানো। ছোট্ট জায়গা কিন্তু কি সুন্দরভাবে কেবিনেট সাজানো। ওরা জানে কিভাবে ছোট্ট জায়গায় সুন্দর পরিপাটি ফ্ল্যাট করা যাায়। ছোট একটা পাত্রে অল্প চায়ের জল চড়িয়ে দেয়। ছোট একটা বিস্কিটের প্যাকেট আর এক কাপ চা হাতে করে ৪ সিটের ডাইনিং টেবিলটাতে গিয়ে বসে ।
চা শেষ হতেই স্যুটকেসটা খুলে বসে। কাল সকালেই অফিস। ধীরে ধীরে কাপড়গুলো নামিয়ে আলমিরাতে গুছিয়ে রাখে। বাবা-মায়ের একটা ছবি, আর দু-বোনের একটা ছবি দুটোই পাশাপাশি একটা বেডসাইড টেবিলে রাখে। এরপর স্নান সেরে সোফায় এসে বসে টিভিটা অন বেলি। একটার পর একটা চ্যানেল দিচ্ছে আর বদলাচ্ছে। নাহ্, হবে না। একটাও বাংলা বা হিন্দি চ্যানেল দেখা যাচ্ছে না। কালই ম্যানেজারকে বলতে হবে। মোবাইলটা হাতে নেয় বেলি। এফবি-তে স্ট্যাটাস আপডেট করে “পদার্পণ” ক্যাপশান দিয়ে ফ্ল্যাটের একটা ছবি দিয়ে। মেসেজ চালাচালি করছে বন্ধুদের সাথে। শব্দহীন ফ্ল্যাটে শুধু টুং টুং নোটিফিকেশনের আওয়াজ । বেলি এখন অনেকের হিংসার পাত্রী। জ্বলছে মনে মনে আর মেসেজে মেসেজে তার পোড়া গন্ধ পাচ্ছে বেলি। নিজে একটু গর্বিতও ফিল করছে বৈকি।

এভাবে কখন যে রাত এগারটা বেজে গেছে, খেয়াল করেনি বেলি। হঠাৎ বেলি নোটিস করে, খুব বেশী নিস্তব্ধ ফ্ল্যাটটা। নিজের অজান্তেই গাটা শিউরে ওঠে বেলির । একা এভাবে কোনদিন তো থাকেনি আগে। হঠাৎ মনে হলো পর্দাটা নড়ে উঠলো ! কিন্তু বেলি তো সব জানালা দরজা বন্ধ করে রেখেছে। পর্দাতো নড়ার কথা নয়। আবার যখন ফিরে তাকায়, নাহ্, পর্দাতো নড়ছে না ! মনে হয় দৃষ্টিভ্রম তার। ধীরে ধীরে উঠে কিচেনে ঢোকে একটু দুধ গরম করে নেবে বলে। আজ ডিনার দুধ আর ফল দিয়েই চালিয়ে দেবে। কিচেনে ঢুকে চমকে ওঠে, চুলোটা জ্বলছে। যতদূর মনে পড়ে, চা বানিয়ে ওতো বন্ধ করেছিল বার্নারটা। মা এ ব্যাপারে বারবার সাবধান করেছে। প্রথম দিনেই এতবড় ভুলটা করে সে ভয় পেয়ে গেছে। নাহ্ তাকে আরো সতর্ক হতে হবে। দুধ চুলোয় চাপিয়ে কিছু ফল কেটে নেয় বেলি। ফ্ল্যাটের নিস্তব্ধতা আর মনের ভয়টা কাটাতে বোনকে ফোন করে। সব কথা বোনের সাথে শেয়ার না করলেও নয়, এতদিনকার অভ্যেস বলে কথা। কথা বলে বলে ফলগুলো দিয়ে ডিনার সেরে নেয় । প্লেটটা কিচেনে রেখে, বোনকে গুডনাইট বলে দুধের মগটা হাতে নিয়ে বেড রুমে ঢুকে বেলি। কিন্তু বেলির বারবার মনে হচ্ছে ওর পেছন পেছন কেউ যেন হাঁটছে। ও থামলেই থামছে । পেছন ফিরে তাকালে শূন্য ঘর এদিক ওদিক কোনদিকে কেউ নেই। ও ভাবছে প্রথম দিনেই এই অবস্থা। ও বোধহয় একা থাকতে পারবে না। কত স্বপ্ন, কত প্ল্যান এই একা থাকা নিয়ে মুক্ত জীবন আহাঃ। শেষে কি না একদিনেই পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে এই স্বপ্নের !

তড়িঘড়ি করে ঢকঢক করে দুধ শেষ করে বাথরুমে ঢুকে বেলি। শোবার আগে দাঁত ব্রাশ করে স্নান করার অভ্যাস বেলির, ওর মনে হলো কেউ যেন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শাওয়ারটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। নাহ্ কোন আওয়াজ তো নেই। শাওয়ার ছাড়লেই আবার সেই আওয়াজ। বেলির ইচ্ছে করছে চিৎকার করে মা’কে ডাকতে । কিন্তু কোন লাভ নেই- চোখ দিয়ে বেলির জল গড়াতে থাকে। স্নান সেরে সোজা বিছানা । চুলটাও আঁচড়ালো না বেলি। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে রাখলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। ওর শুধু মনে হচ্ছে ঘরে যেন কে আছে। রাত তখন বোধকরি তিনটে। হঠাৎ ওর মনে হলো, মেইন দরজাটা ঠিকভাবে বন্ধ করেছে তো! রীতিমত ঘামছে বেলি। চেষ্টা করছে নিঃশ্বাসেরও যেন কোন শব্দ না হয়। আস্তে আস্তে ওপরওয়ালার নাম জপ করতে করতে দরজার সামনে গিয়ে ‘থ’ বনে যায় বেলি। দরজার লক পুরো খোলা। অথচ ওর পুরো মনে আছে দরজা বন্ধ করেছিল ও। ওর পা আর এগুচ্ছে না দরজার দিকে। কাঁদতেও ভুলে গেছে। দমটা আটকে আসছে। কোনভাবে দরজার খিল আটকে খাটে এসে চোখ বন্ধ করে বেলি। মাঝে মাঝে চোখটা পিটপিট করে খুলে দেখছিল চারপাশ। না কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কারো অস্তিত্ব বেলি ফিল করছিল। পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে গেছে। হাত বাড়ালেই বেডসাইড টেবিলে জল। কিন্তু হাত এগুনো যাচ্ছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বেলি পড়ে থাকে। হঠাৎ বেলির কাঁধে একটা হাতের ধাক্কা বেলি চোখ আরো জোরে বন্ধ করে। দমটা বোধহয় এখন আটকেই যাবে। বুকের ভেতর হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন মারছে। এবার ঝাঁকুনিটা একটু জোরেই পায়ে লাগলো। মা’ ডাকছে কি রে বেলি, আর কত ঘুমাবি? এগারটা তো বাজালো। ভার্সিটি বন্ধ হলেই কি ঘুমিয়ে দিন কাটাতে হবে ?
মায়ের গজগজানিতে ধড়মড় করে উঠে বসে ও। বেলির চোখমুখ দেখে মা চমকে যায়। কি রে ? কি হয়েছে
তোর ? কোন স্বপ্ন দেখছিলি ?

বেলি এতক্ষণে ধাতস্থ হয়। চোখ খুলে মা’কে দেখে জাপটে ধরে কেঁদেই ফেলে। বলে, মা কি যে সাংঘাতিক স্বপ্ন।
মা বলে ওঠে , রাত জেগে জেগে আরো বেশী বেশী হরর মুভি দেখ।
বেলি আরো জোরে ওর মা’কে সাপটে ধরে। কথা দিচ্ছি মা, আর হরর না, আর হরর না, না না কখনও আর হরর নয়।।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট