চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

উটপাখি

সৈয়দ মনজুর মোরশেদ

৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ | ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

আমাকে কেন বার বার হেনস্তা হতে হয়। এ জীবনতো আমি চাইনি, নিরুপদ্রব, দীঘির মত শান্ত, পদ্মপাতার মত নিটোল পরিপূর্ণ জীবন চেয়েছিলাম। যেখানে নির্ভয়ে, নির্ভাবনায় নিমগ্ন, তুলো পেঁজার মত ছাঁচেগড়া জীবন চেয়েছিলাম ।
আজ আমি ভাবি যখন দেখি আমার পাশে কেউ নেই, কি এমন দোষ করেছিলাম। জয়া আমার দু’মেয়েকে নিয়ে শহীদুউল্লাহ মির্জা শাহরিয়ারের সাথে অন্যজীবনে চলে যাবে। যেখানে আমি কখনো যেতে পারব না। সব মায়াডোর পেছনে ফেলে, সাজানো ঘর-সংসার লহমায় তছনছ করে, যেমন মালি বাগানের ঝাঁকড়া লালহলুদ গাদাফুলের গাছ উপড়ে ফেলে ঠিক তেমনি করে চিরচেনা উঠানের চারদিকে শূন্য করে জয়া সবকিছু উপড়ে ফেলল ? এ জয়া কোন জয়া ? আমি যাকে আটটি বছর চিনেছি। তার কোথায় তিল, নাভির নিচে কাটা দাগ, বাম পাঁজরে লাল জরুল, বুকের নিচে আমার নখের বসে যাওয়া নিলাভ দাগ। কেমন সাদা নীল রক্ত তুলেছিল কিংবা যে জয়া কাঁচুলি ছুঁড়ে ফেলে আমার বেবাক বন্য হিং¯্রতা তুমুলভাবে চাইত। সে জয়া রাত-বিরাতে পত্রিকা অফিসের শেষ প্রুফটুকু দেখে বাসায় ফিরতে দেরি হলে রাতভর জেগে চোখে লাল রক্ত তুলে পিঠে বেণী দোলানো মেয়েটির মত গলাফুলিয়ে সোফায় বসে থাকত। চোখ ভিজা ভিজা কখনো লাল রক্তজবার মত হয়ে যেত। আমি কপট রাগ করে শুয়ে পড়তে বলতাম। আমার শিউলি, অঞ্জলি তখন দু’বোন তাড়াতাড়ি করে পৃথিবীর সমস্ত আদর আদিখ্যেতা বাবার জন্য বন্ধক রেখেÑ পাশ বালিশে মুখ বুঁজে ঘুমিয়ে পড়েছে। চুলের ফিতা, চুড়ি, ক্লিপ পালঙ্কের নিচে পড়ে থাকা কিডস হাউস থেকে কেনা বেবিডল চিৎ হয়ে পড়ে আছে। আমি দু’হাতে তুলে ড্রেসিং টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম আর তখন চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জয়া আমাকে আড়চোখে দেখছে। আমি সিগেরেটে শেষ টানটুকু দিয়ে দূরে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আয়নায় মুখ ফিরালে দেখতাম জয়ার বুকের উপর থেকে শাড়ি সরে পড়েছে। কেমন নিটোল সুন্দর মুখ, আর হাতকাটা ব্লাউজের পাশে বুকের বাঁ পাশ, কি অদ্ভুত ব্রীড়ার আহ্বান।
টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসে জলটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে জয়াকে শুধাতামÑ“আর পারি না”। জয়ার ঠোঁটে চিরে সুতোর মত হাসি সহসা মিলিয়ে যেত। জয়া জানে এখন আমি কি চাই, সে ডাউনলোড বক্সখাটে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ত। আমি জিরো পাওয়ারের লাইট জ্বেলে জানালার ধারে শেষ সিগারেটটি ধরাতাম। রাতের আকাশে শেষ তারাটি উঠে গেছে। বাইরে ঝিঁঝিঁরা রিরি শব্দ। পোকামাকড়ের শব্দ বাইরের নিক্ষ কালো রাতের নিরবতাকে খানখান করেছে। দূরে কোথাও চারতলা বিল্ডিংয়ের বাথরুমের বাতি জ্বলল। আশেপাশে ইঁদুর চিকার আর তেলাপোকার ফড়ফড় উড়াউড়ি দৌড়াদৌড়ি শুনলাম। ঝনঝন শব্দে হাড়িপাতিল ছিটকে পড়ার শব্দ শুনলাম। এ সময় বইয়ের শেলফের পেছনের তাকে লুকিয়ে রাখা রাজস্থলি থেকে পাঠানো চাউচিংয়ের কালো বোতলের দোচুয়ানি চেখে নিলে খুব ফুরফুরে লাগবে। জানি। এসব রাতে মাদকতা জরুরি । বহুত দিন আগে এসব হিসেবে নিয়েছি। জয়া জানে। সে খুব ভাল করে বোঝে এক-আধটু খেলে তার বশ্যতা স্বীকার করি। আজ দু’চোখ ভিজে আসে। জয়াকে তো কিছু দিতে পারছি না । সে অবশ্য কোনদিন কিছু চায়নি। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি। কতবার বলেছে রাঙ্গামাটি চল, বান্দরাবন ঘুরে আসি, চাচাত বোন সিলেটে থাকে, সে জাফলং বেড়াতে যেতে বলেছে। যাবো বলেছি। কিন্ত যাওয়া হচ্ছে না । সব সময় একটা না একটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়েছি । আজ দেখছি জয়া কেমন নিষ্পৃহতা দেখিয়ে শুয়ে পড়েছে। এ হল একটা ছল। আমি যখনই পাশে দাঁড়াতাম, শুনতাম সে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে, আমি জানিসে ফোঁসফোঁস করে ফুঁসছে। যেন পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে কাল নাগিনী হিং¯্র ছোবল দেবে, আমি জাত সাপুড়ে, আমি জানি বাঁশি না বাজিয়ে, বাশের লাঠি না ভেঙে দুধকলা দিয়ে কিভাবে বিষধর সাপ পুষতে হয়। কিন্তু জয়া সেসব কিছু করল না। সে কখনা আমার পাশে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার কাঁধে হাত রেখে সে বললÑ“ঘুমুবে না”। রাত অনেক হয়েছে। “চল শুয়ে পড়ি।” অমি চিনি এ জয়াকে, ঠা-া শীতল পানি ভর্তি কলসি গালে লাগিয়ে আঁচটুক বোঝা যায় ।
কিন্তু পরে কোনমতে বাগে আনা যাবে না। তখন সুন্দরবনের বাঘিনীকে বাগে আনতে আমাকে বাঘের ছাল পরতে হবে। তর্জন-গর্জন কপট রাগ খুনসুটি স¦গত চোটপাট করতে হবে। এও কি কম ছিনালিপনা। এওকি রঙধনু রঙের কামনা। জানি না, যখন সবকিছু হাতের মুঠোয় এসে যাবে কু-ুলি পাকিয়ে কলসিতে ঢুকে পড়বে। নেতিয়ে পড়বে দু’পা ছড়ায়ে শুয়ে পড়বে। আমি দেখব এ বাঘিনী জয়া নয়, অন্য কেউ,অন্য কোন মানবী । কেমন নির্ভার মুখে আনন্দের দাগ। এক চিলতে হাসি লেগে আছে। যেমন চাঁদ ডুবে গেলে আকাশে শেষ আঁচটুকু লেগে থাকে। জয়া ঘুমিয়ে পড়বে, আমি তখনও জয়াকে দেখব, খুঁজব, এইতো জীবন, জীবনে আর কিছু চাই না। আমারি সামান্য জীবনে এতো অসাধারণ, ফুলতোলা হাতপাখার বাতাসে সব কষ্ট, দুঃখ, অভাব। দুমূর্ল্যওে বাজারে নাভিশ্বাস ওঠা দিন। কয়েক মাইল হেঁটে আসা খোয়া ওঠা পথ, টিনশেড ঘরের সর্বনাশা দুঃসহ গরম, রোদজ্বালা দুপুরের মধুরেণ দিনগুলি, সবকিছু সুন্দর। আমি কখনও এসব ছেড়ে কোথাও যাব না। আর কোন ঠাই ্্্্্চাই না। এসব কিছু নিয়ে আমি দারুণ পরিতৃপ্ত জীবন খুঁজে পেয়েছি, যেমন শামুখ খোলসের আড়ালে মুক্তাকে লুকিয়ে রাখে। অনেক কষ্ট, ঝড়, ধূলিবালি সমূহ বিপদ-সংকুল পরিস্থিতি, অনেকদিন আগে পড়েছি, প্রুফ কাটাতে কাটাতে ভেবেছি বষ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় কপালকু-লা উপন্যাসে লেখক কি নিজেই জানতে চেয়েছিলেন এই জীবন নিয়ে কি করিতে হয়? আমি দিনের পর দিন নির্ঘুম রাত্রি জেগে জেগে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। পাইনি। দিনের শেষে ঠাকুর বাড়ির বৌঠান কাদম্বরী দেবীকেও কখনো মৌন প্রশ্ন/উত্তর করেছিলেন রবিন্দ্রনাথ তিনি কি জবাব পেয়েছিলেন? আজও সন্ধান পায়নি আহা!,আমার ছায়া সুনিবিড় জীবনটাকে যদি আবার খুঁজে নিতে পারতাম? বদলে নিতে পারতাম!!!
যেদিন জেনেছি আমাকে আমার বাবা-মা যুদ্ধের বছরে বোঝা মনে করেছিলেন সে সব ভয়াবহ দিনে সবাই যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলা!! চুয়াত্তরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দিনে চরাঞ্চলে উত্তরের মাঠে খরায় ফসল পুড়ছে, চারিদিকে ওলাওঠা রোগে মানুষ মারা পড়ছে। অনেকদিন আগে বাবা শুনিয়ে শুনিয়ে গল্প করতেনÑতিন পোয়া রাড়ের দিনে কোলের ছাওয়াল, দুধের শিশু বেছে দিয়ে এক পোয়া চাউল কিনেছে। খেয়ে না খেয়ে কচু/গেচু আর আলু সিদ্ধ করে দিনের কোন কোন বেলা উপোস সে সময় আমি যদিও মায়ের বেঁচে থাকার কিংবা বাবার সংসারে যথেচ্ছ উপেক্ষার পরও একমাত্র অবলম্বন ছিলাম। সেই আমি আজ একচল্লিশ বছরের অমল-ধবল চাকরি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে অনেক ঘাটের জল খেয়ে, নানা অলিগলি ঘুরে শেষে রফিক ভাইয়ের প্রচ্ছন্ন ভালবাসায় তিন মাস বেকার খেটে যাকে হাল আমলে ইন্টারনিশিপ বলে সে সব পাঠ চুকিয়ে প্রুফ রিডারের চাকরিতে থিতু হলাম। একে কি স্থিরতা বলা যায় ? বেঁচে থাকার জন্য এক টুকরা জমিন দাঁড়াবার জায়গা বলা চলে, আমি জানি না। একবার যখন আমি বাড়িতে না কয়ে না বলে শেষে পালিয়ে লজিংয়ে উঠেছিলাম। আমার দোস্ত বাচ্চু, যে শহরে কোরবানি গঞ্জে বলুয়ার দীঘির পাড়ে বসতবাটি ছিল, সে কিনা বাবা-মার-ভাই-বোন সক্কলের বিরুদ্ধে গিয়া যশোরের মেয়ে ইয়াছমিনরে ভালোবাইসা বিয়া করছিল, সে তো সত্যি সুখে সংসার করতাছে, এহন তার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সেসময় আমি যশোরের রোড ধইরা বেনাপোল দিয়া ইন্ডিয়া হইয়া পাকিস্তান করাচি লাহোর হয়ে কাবুল উপর দিয়া রাশিয়া যাওনের কথা ভাবছিলাম। আমার সে সময় খালি মনে হইত কাউরে ভালবাইসা কি সর্বনাশ হইল এই যে ফারহানা তবাসসুমরে ভালবাইসা লাল কলিজাটা ফালা ফালা হইল সে ও কী আজো আমারে ভুলবার পারছে? না । না পারে নাই। না হইলে নিজের মেয়ের নাম কেন দিতে গেল “তারান্নুম”। এতো কিছু মনে ঠাই লইতে পারে ? অদ্ভুত সে সময় সব কিছু ছেড়ে পলায়ন করতে চাইছিলাম। খালি ঘর ছাড়া হওনের খেয়াল আছিল। পারলাম কই? তার পরতো রাজনীতির ভিতর ঢুইকা পড়লাম তখন মনেবাও আসল, শুধু খোয়াব দেখতাম সমাজটা পাপ্লাইয়া ফেলব ? আর পারলাম ক্ই? চারু মজুমদার, কানু শ্যানাল আর নকশাল।
আন্দোলন খালি নয়ন সম্মুখে ভাসত । কৃষক বিদ্রোহ । গ্রাম দিয়া শহর ঘেরাও গেরিলা যুদ্ধ। কি হইল, কোন কিছু হইল না । খালি লাটিমের মত ঘুরলাম । কোথাও কি গেছিলাম। না যাই নাই। যাইতে পারি নাই । সব কিছু ছাইড়া কোথায় যাইতে চাইছিলাম? জানি না। তখন জানি কোথাও যাইতে চাই নাই। একবার ঘুলে ধরা সমাজটা পাল্টাবার জন্য গোপন সংগঠনে লড়ছি । সিদ্ধান্ত হল অ¯্রশস্ত্র যোগাড় কর, ইছামতি শ্মশানে লুকিয়ে রাখবার সিদ্ধান্ত হল। দু’এক জন ছাড়া কেউ এসব জানত না। কিন্ত ডিবি ঠিকই খোঁজ পেল । সব অস্ত্র মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে গেল। এর কিছুদিন পর অরুণের গলা কাটা লাশ কর্ণফুলি নদীতে খেলার ঘাটে ভাসতে দেখা গেছে। কারা মারল ? কেন মারল? আজও রহস্য রয়ে গেল । অনেক দিন পর নিখিল বল অবাক করা কথা শোনাল বিপুল কোলকাতায়। আর কোনদিন এদেশে সে আসবে না। অরুণের বোন রাধাকে বিপুল ভালোবাসত। অরুণের এমন মৃত্যু কি কাক্সিক্ষত ছিল? জানি না।
অনেক দিন পর রাধাকে দেখে একফোঁটা বোঝার জো ছিলনা এ মেয়েটি পার্টির কমরেড ছিল । আজ কি দারুণ গয়না গলায় রাজি আহমদের ঘরসংসার সাজিয়ে যাচ্ছে। হুইস্কি গলায় পুরোটা ঢেলে নিখিল চোখ ছোট করে টলতে টলতে বারান্দা ঝুঁকে বমি করতে করতে বাজখাই গলায় শোনাল ; রাধা বিপুলের সাথে নৌকায় ইছামতিতে সারারাত কাটিয়েছে । খুব ভোরবেলায় দু’জনকে চরের আ্্্্্্্্্্্্্ইল ধরে হেঁটে আসতে দেখেছে। রাধা সেদিন বিপ্লবের আর স্বপ্নের খুন করল।
জাকি তুই না রেবুকে ভালোবাসছিলি?
নিখিল ওসব বাদ দে।
চল বের হই।
কোথায় ?
তোপখানা রোড।
ওরা হাঁটতে থাকে । কিছুদূর এগুলে দেখে রেবু মিছিলের সামনে । ওর হাত মুষ্টিবদ্ধ কোরাস চারিদিকে
মুখর আকাশ, স্লোগান আর স্লোগান, রেবু হাসল পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুধাল “উটপাখি’’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট