চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

বইপত্র

সুখেন্দু বিকাশ দে’র খেলাঘর

সামাজিক কদর্যতা ও তারুণ্যের অবক্ষয়ের সুনিপুণ বয়ান

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, আক্ষেপ ও আবেগ এ সবই নানা উপন্যাস-গল্পগ্রন্থের উপজীব্য হতে পারে। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিকরা সময়ের চিত্র, সামাজিক নানা কদর্যতা এবং নানা বয়সী মানুষের দৈনন্দিন জীবন চিত্র এমনকি তাদের নৈতিক অধোগতি ও অবক্ষয় প্রবণতা কলমের আঁচড়ে সুনিপুণভাবে তুলে আনেন। তেমনি একজন বোদ্ধা কথাসাহিত্যিক ও শক্তিমান গল্পকার হলেন সুখেন্দু বিকাশ দে। তীক্ষè ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে এবং সরস বর্ণনায় তিনি অবক্ষয়মুখী সমাজের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস ‘খেলাঘরে’।
সুখেন্দু বিকাশ দে কেবল একজন গল্পকার, কবি ও কথাসাহিত্যিক নন, তিনি একজন বরেণ্য শিক্ষক ও শিক্ষাবিদও। ‘খেলাঘর’ উপন্যাস পাঠে তাঁর মেধা, মনন ও চিন্তাধারার গভীরতা আঁচ করা যায়। আজীবন গ্রামে অবস্থানকারী এ কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক গ্রামের তৃণমূলের মানুষের দিনলিপি, স্বাভাবিক জীবন চিত্র, তাদের জীবনাচার ও দৃষ্টিভঙ্গি ‘খেলাঘর’ উপন্যাসের মাধ্যমে বিষদভাবে তুলে ধরে সমাজ ও মানুষের প্রতি তাঁর দায় ও দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। প্রবাসী পরিবারের প্রবাসে থাকা স্বামীর অবর্তমানে বউদের ওপর এক শ্রেণির লোকের লোলুপ দৃষ্টি, সামাজিক অবক্ষয় থেকে সৃষ্ট হানাহানি-খুনোখুনি-সংঘাত, প্রেম ও পরকীয়াÑএসবই হচ্ছে সুখেন্দু বিকাশ দে রচিত ‘খেলাঘর’ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং মানুষের জীবনচারিতা পরখ করার ক্ষমতা সত্যি অসাধারণ। তৃণমূলে বসবাসকারী মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, তাদের কথাবার্তা, চালচলন ও চিন্তা ভাবনা ‘খেলাঘর’ উপন্যাসে অত্যন্ত সার্থকভাবে চিত্রিত হয়েছে। এখানেই মূলত ঔপন্যাসিক সুখেন্দু বিকাশ দে’র লেখনীর সার্থকতা নিহিত।
লোভ, মোহ, কাম, ক্রোধ দ্বারা আক্রান্ত মানুষের চরম নিয়তি ও পরিণতির বিষয়কে অবলম্বন করে সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনীর আলোকে রচিত হয়েছে এ খেলাঘর উপন্যাস। এতে বর্ণিত সব বিষয়ই কাল্পনিক। যদি কাকতালীয়ভাবে কারো সাথে এর কোন বিষয় মিলে যায় তার জন্য উপন্যাসের শুরুতেই ‘কৈফিয়ৎ’ স্তম্ভে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি কামনা করেন ঔপন্যাসিক সুখেন্দু বিকাশ দে। পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলাধীন রামগড় উপজেলার বালুখালী গ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণে নিত্য ব্যবহৃত মুখের ভাষাকে পরিমার্জন করে উপন্যাসটির কাহিনী বিবৃত করা হয়েছে। উক্ত জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষার আশ্রয়ে উপন্যাসটি রচনা করতে গিয়ে নানা ভুল-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হতে পারে বলে লেখক জানিয়েছেন। এতে তাঁর ঔদার্য লক্ষ্যণীয়।
সুখেন্দু বিকাশ দে’র ‘খেলাঘর’ গ্রন্থে প্রবাসী মজনু মিয়ার স্ত্রীর গৃহবধূ সখিনার স্বামীর জন্য অধীর আগ্রহে সারা বছর চেয়ে চেয়ে থাকা, পাঁচ বছর পর একবার কিছুদিনের জন্য দেশে এলেও সম্প্রতি ঈদে প্রবাসী স্বামীর দেশে আসতে না পারা, নিয়মিত টাকা পাঠালেও স্বামী ছাড়া পরিবারে সখিনার হতাশা-দীর্ঘশ্বাস সরস বর্ণনায় ওঠে এসেছে। সখিনার সাথে জালালের অতিরিক্ত আন্তরিকতা অনেকটা পরকীয়ার পর্যায়ে পড়ে। এদিকে, প্রবাসী মজনু মিয়ার ছেলে হাশেমের সঙ্গে পাশের বাড়ির তালেবের মেয়ের পড়ালেখার সম্পর্ক অনেকটা প্রেমের রূপ নেয়। হাশেম ওরফে হাশু, সেলিম, জাহাঙ্গির, নূরু, গনি, জলিল ও সাত্তার মিলে খেলাঘর ক্লাব গঠন করে। বছরব্যাপী এ ক্লাবে নানা রকম অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। গ্রামের জুলফু মিয়ার নাতির সাথে তৈয়বার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের (নকল বিয়ে) নিপুণ বর্ণনা রয়েছে এ ‘খেলাঘর’ উপন্যাস গ্রন্থে।
এদিকে জালালের বৌয়ের টাইফয়েড হয়েছে। আলীর মা জালালের বৌ রহিমাকে সেবাযতœ করেন নিয়মিত। কিন্তু জালাল আলীর মায়ের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। মজনু বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা পাঠিয়েছেন ঘর বানানোর জন্য। সখিনা ঘর বানাতে ম্যানেজমেন্ট করতে জালালের সহযোগিতা চায়। ফলে জালাল সখিনার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রতি শুক্রবার খেলাঘরে আসর জমে। বন্ধুরা সবাই আড্ডায় মেতে থাকে। ওদিকে, আলীর বাবা নেশাখোর ইয়াছিনের অভ্যাস হলো বিয়ে করা আর তালাক দেয়া। জালাল প্রবাসী মজনুর ঘর নির্মাণের দায়িত্ব নিলেও গ্রামের চাঁদাবাজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মজনুর পাঠানো টাকা মেরে দেয়ার ফন্দি আঁটে। সে পরিকল্পনা মতো সন্ত্রাসী দ্বারা টাকা লুটের নাটক সাজায়। নেশাখোর ইয়াছিনকে দিয়ে জালাল সখিনার কাছ থেকে সমস্ত বৈদেশিক উপার্জন ছিনিয়ে নেয়। জালালের চক্রান্ত ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হতে থাকে। সন্ত্রাসী জালাল সখিনার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা চাঁদা নেয়। সুযোগ পেয়ে জালাল আলীর মাকে ধর্ষণ করে। বিস্তারিত ঘটনা সখিনার স্বামী প্রবাসী মজনুকে চিঠি লিখে জানায়।
এদিকে, জালালের বউ রহিমার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। রহিমা অন্তিম শয্যায়। জালাল কোন সময় আলীর মাকে আবার কোন সময় সখিনাকে বউ করার কুমতলবে থাকে। রহিমা মারা গেল। জালাল নিজের মেয়ে রোখসানাকে বেদম প্রহার করল। সখিনা তার স্বামীকে বিদেশ থেকে আসতে নিষেধ করল। এলে তাকে জালাল গং মেরে ফেলবে।
এদিকে, প্রবাসী মজনু মিয়া পত্রের মাধ্যমে থানার ওসিকে অভিযোগ দেন। জালালের সন্ত্রাসী দল মোবারকের লোকজনদের ওপর নজর রাখা শুরু করে পুলিশ। পুলিশ অপারেশন শুরু করে। অনেক সন্ত্রাসীকে মেরে ফেলা হয়। জালাল এবং প্রবাসী মজনুর বউয়ের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। পুলিশি অপারেশনে জালাল গা-ঢাকা দেয়। জালাল গংয়ের ভাড়াটে ঘাতকদের হাতে সখিনা মারা যায়। সখিনার মৃত্যুর পর জালালের ভাড়া করা খুনি মোবারক গং ধরা পড়ে। মোবারক ও জালালের মৃত্যুদ- হয়। মজনু দেশে ফিরে আসে। এদিকে ইয়াছিন জুলেখাকে অর্থাৎ আলীর মাকে ঘরে নিয়ে যেতে উদগ্রীব। মজনু প্রায়ই স্বপ্ন দেখে জুলেখাকে। মজনু জালালের দুই ছেলেমেয়েকে খুবই খাতির করে। জালালের পরিবারে শান্তি নেমে আসে।
এদিকে সখিনার ছেলে হাশু ও তালেবের মেয়ে লায়লী এসএসসি পাস করে। হাশুর বাবা মজনু মারা যায়। স্ত্রী সখিনার পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। স্বপ্নে সখিনা তার ছেলে হাশুকে পুলিশ অফিসার হবার জন্য তাগাদা দেয়। এই হলো ‘খেলাঘর’ উপন্যাসের মূল চিত্র। ‘সীমালঙ্ঘন করো না, আল্লাহপাক সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না’- কুরআন মজিদের এই নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে উপন্যাসের সমাপ্তি টানেন সুখেন্দু বিকাশ দে।
সব শেষে বলা যায় ‘খেলাঘর’ একটি সুখপাঠ্য জীবনমুখী উপন্যাস। এটির বহুল প্রচার কামনা করি। খেলাঘর, সুখেন্দু বিকাশ দে, বেঙ্গল বুক হাউস, প্রকাশকাল: ২০১৬, দাম: ২৫০ টাকা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট