চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রসঙ্গ

একটি চিঠির অদেখা লেখকের কথা

ড. মনিরুজ্জামান

৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

এই রচনার উদ্দেশ্য কোনও তৃতীয় ব্যক্তি নয়, হয়তো বা নিজেকেই খোঁজা,Ñ এক ধরনের আত্মসন্ধানী পরিব্রাজ্য। এর মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছি পুরনো কিছু চিঠি বা পত্রাবলী। আজ কাল কেউ চিঠি লেখে না, সে চল উঠে গেছে। প্রথমআলো, সুপ্রভাত প্রভৃতি পত্রিকায় সে সব নিয়ে লেখালেখি চলছে দেখতে পাই। চিঠিতে অনেক তথ্য থাকে, যা অনেক বড় সাহিত্যিক লেখাতেও (প্রবন্ধে) হয়তো পাওয়া যায় না। চিঠিতে থাকে উদ্ধৃতিযোগ্য কবিতাংশ, থাকে ব্যক্তিচরিত্র-উন্মোচক ঘটনা-সূত্রের (রেফারেন্স) কিছু ইঙ্গিত, প্রভৃতি এবং তারও বেশি থাকে হারানো তথ্য । চিঠির ভাষারও থাকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এক একজনের চিঠির মূল্যায়ন হয় এক একভাবে। রবীন্দ্রনাথের ‘চিঠিপত্র’ বা ‘ছিন্নপত্র ’ (‘জীবনস্মৃতি’ ও ইংরেজি গীতাঞ্জলির সমকালীন), ‘যোগাযোগে’র কালে লেখা ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’ এমন কি হিবার্ট লেকচারের পরে লেখা ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ কিংবা সেই বিখ্যাত ‘পোয়েট টু পোয়েট’ কবির জীবনীকারদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ বিশেষ।
সব চিঠির মূল্য হয়তো সমান নয়। আবার ‘মূল্য’ তো আপেক্ষিক ব্যাপার। আর পত্র লেখক তো আর ঠিক ঠাক সেটা বুঝে ইতিহাসের মত করে চিঠি লিখতে বসেন না, কোনও কোনওটা ইাতহাস হয়ে যায় বা হয়ে ওঠে কালের সাক্ষী। চিঠি হচ্ছে কথা শেষ তো চিঠি শেষ বা চিঠি শেষ তো কথারও শেষ,Ñসেখানেই তার ইতি। রবীন্দ্র ভাষায়, ‘যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি সে মুহূর্ত্তে কিছু তব নাই’। তাকে নিয়ে আর কিছু করার নেই।
তবু কোনও কোনও চিঠি ঝোলার ভেতর থেকে উঁকি মারতে থাকে। বলতে চায় আরও কিছু। যা বলতে পারে নি আগে, কালের জানালা ধরে সে কথা সে বলার অপেক্ষায় থাকে। আরেক পাঠক তা বুঝতে পারে । এই অন্য পাঠক কিন্তু মূল পাঠকও হতে পারে। সে-ই তখন পাঠক থেকে হয়ে ওঠে মাস্টারমশাই । আসলেই তখন সে ‘অন্য কোথা অন্য কোনও খানে’র মতো অন্য কোনও লোক, অন্য কোনও বোদ্ধার মত নিবিড় অধ্যায়ক, হয়তো সে রবীন্দ্রনাথের সেই ‘নতপৃষ্ঠ পাঠনিবিষ্ট অদ্ভুত লোকটি’ কিংবা চোখে পিচুটি পড়া জীবনানন্দীয় ‘অজর অমর অধ্যাপক’ কোনও এক।
সে যাক, আপাতত সে এখন আর কেউ নয়, এই আমিই সে। মানে ‘আর পাব কোথা ?’ আর চিঠিও আমাকেই লেখা। আমিই প্রাপক। তবে লেখকের পরিচয় জানা নেই। সে আকাশের ঠিকানায় লেখে নি, কিন্তু সে আজ, আজ কেন তখনও, আকাশের ঠিকানায়ই বোধ হয় উধাও হয়ে গেছে। এ ভারী মজার ্উধাও। কোনও যোগাযোগ বা দেখা সাক্ষাৎ তো করেই নি, তার পাঠানো এতগুলি ডকুমেন্টও সে ফিরিয়ে নিতে আসে নি। এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডার ল্যান্ডে আছে গাছের ওপর বসে একটা বিড়াল হেসে হাসিটা রেখে উধাও হয়ে গেল। এটা অবশ্যই প্রতীক। মানুষেরও কী অদ্ভুত প্রকৃতি,Ñসে পরিচয়ও দিতে চায়, আবার অপ্রকাশও করে রাখতে চায় নিজেকে! নারী হলে বুঝতাম ‘সে কেবল পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে’! এ তো তা নয়, তার নাম-ঠিকানা যে দিয়েছে সে পত্রান্তে, একভাবে । জলজ্যান্ত এক সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র সে। তবে হয়তো কবিও, নয়তো ভাল কবিতা পড়ু–য়া, অর্থাৎ ভাল সমঝদার পাঠক। কেন প্রশংসা করছি সেটা চিঠির মধ্যেই রয়েছে তার প্রকাশ। এই চিঠির মূল্যটা আমার কাছে তাই সেই মূল্যের। আর আমার ৮০ বছরের প্রাক-কালে এই স্মৃতির আবেশটুকু আমাকে খানিকটা নস্টালজিকও করে বৈকি!
ভণিতা ছেড়ে এবার মূলে আসা যাক। সুপ্রিয় পাঠকের সাথে আমিও পড়তে চাই চিঠিটা আবারও। সম্বোধন এবং শেষে উল্লিখিত তারিখটা বাদে চিঠির গর্ভাংশ পুরোটাই সবুজ কালিতে লেখা। আমি সম্পূর্ণ চিঠিটা উদ্ধৃত করে কারও সময় নষ্ট করতে চাই না।কিছু অংশ বাদ দিলেও ক্ষতি নেই। তবে মাঝখানে কিছু প্রশ্ন আছে, সেটা নেহাৎই ছাত্রসুলভ, যার শেষ প্রশ্নটি (৪ নং.) আবার বেশ তাৎপর্যক, তাতে তার (পত্র লেখকের) জিজ্ঞাসার এবং কৌতূহলের সীমা এবং গভীরতার পরিমাপ বোঝা যায়। চিঠিটা এই রকমÑ
‘শ্রদ্ধাভাজনেষু,
আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। ‘ইদানীং বিপন্ন বড়ো’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে আমি বিশেষ আনন্দ লাভ করেছি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাবাশ্রিত কবিতাগুলো সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক ও সুপাঠ্য। ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রতিবেশের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াজনিত (গঁঃঁধষ ওহঃবৎধপঃরড়হ) জনসমাজের দ্বান্দ্বিক/দ্বন্দ্বময় অগ্রগতি এবং সমাজস্থ জনসাধারণের চেতনাগত পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ছবি আপপনার কবিতায় জীবন্তরূপে ফুটে উঠেছে। এই আমার একান্ত পর্যবেক্ষণলব্ধ ধারণা। আমি কবিতার একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আপনার কবিতা প্রতিভার প্রশংসা করছি।
সাহিত্যে আমার অনুরাগ প্রবল । রবীন্দ্র ও নজরুল রচনাবলী আমাকে বরাবরই আকৃষ্ট করে। যে কোন কবিতা তো বটেই। আপনার রচিত ‘মুহম্মদ আবদুল হাই’ নামক কবিতাটি আমার মনে একটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। আর তা হলো : আবদুল হাই স্যার… ‘ধ্বনিতত্ত্বে কীর্তিমান’, অনন্য ব্যাক্তিত্বের অধিকারী,‘আমৃত্যু রবীন্দ্রপ্রেমিক’ মানুষটি সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন করে আপনার গহনে এই অনন্য কবিতার আকার লাভ করলো!
অধ্যাপক [মুহম্মদ] আবদুল হাই বহু গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর বলিষ্ঠ সম্পাদনায় ষান্মাসিক ‘সাহিত্য পত্রিকা’ প্রকাশিত হতো।… আমি দীর্ঘদিন যাবত [সাহিত্য সম্পর্কিত] কিছু প্রশ্নের সমাধান প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আছি, সে সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত [জানতে ইচ্ছুক]। যেমনÑ
… ৪। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর জীবন-ধারা ও মানস-কাঠামো কি বাউল-সংস্কৃতির প্রভাব বর্জিত ? এ অঞ্চলে দরবেশ ও সূফী প্রভাব ঐতিহাসিক, এটা সবার কমবেশি জানা।
সে যাই হোক, আমার নিজস্ব সংগ্রহ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক কবিতা এবং রবীন্দ্র-নজরুল বিষয়ক কয়েকটি প্রবন্ধ পাঠালাম । সেই সংগে বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আমার একগুচ্ছ পত্র। আপনার মূল্যবান মতামত, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনামূলক একটি বড় গোছের স্বলিখিত চিঠি কামনা করছি।… ইতি (আশীর্বাদপ্রার্থী)- ‘পত্রের তারিখÑ ‘৩১ শে অক্টোবর ২০০৬’ ।
এখানে পত্রলেখকের পরিচয়টি নি¤œরূপ দেখতে পাইÑ ‘ছালেহ মুহাম্মদ শাহরিয়ার/ রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ/ চতুর্থ বর্ষ অনার্স/ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।’ একই ঠিকানায় ‘দি ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত তার অনেকগুলি চিঠিও লক্ষ্য করলাম। কিন্তু এই ঠিকানায় চিঠি পাঠালে তা সঠিক জায়গায় যেত কিনা সন্দেহ থাকায় আমার আর উত্তর লেখা হয় নি।
এই লেখক আমার ছাত্র নন, কিন্তু আমি তখনও একই বিশ^বিদ্যালয়ে, তবে এলপিআর-এ, ছিলাম। সেদিন উত্তর দিলে কি লিখতাম জানি না, তবে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে একটি ছাত্র যার এতটাই অগ্রসরশীল চিন্তা, যার কবি-মন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, তার কথা এই এক যুগ পরে হলেও আজ নতুনভাবে বিচারযোগ্য। ‘ইয়ারো রিভিজিটেড’ যেমন। এখনকার ছাত্রের কাছে তার মত চিন্তা কতটা আশা করা যাবে জানি না, পত্র-লেখক ‘ছালেহ মুহাম্মদ শাহরিয়ার’ এই ১২ বছরে বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের কাছেই হয়তো ঈর্ষণীয়ই মনে হবে আমার বিশ^াস।
‘শাহরিয়ার’ আজ কোথায় কে জানে? হয়তো সে কোনও কর্পোরেট অফিসে বা ক্যাডার অফিসার হয়ে এস.এম. শাহরিয়ার রূপে বিদ্যমান হয়ে আছে কোথাও। কিন্তু এ-ফোর সাইজে তার দুই পাতার চিঠিটা আমার পুরনো কাগজ-পত্রের ভেতর এতকাল কেমন করেই যেন থেকে গেছে। সাথে তার পাঠানো ‘দেড় শত’ নির্বাচিত আধুনিক কবিতার ফটোকপিও। দেখে আমি আজও বিস্মিত হচ্ছি। বোঝা যায় যতœ করেই কবিতাগুলি সংগৃহীত। কবিতা পাঠের অভ্যাস না থাকলে এবং কবিতাগুলি না পড়ে থাকলে এ ভাবে কেউ তা সংগ্রহ করতো না। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোনও কবিতা প্রেমির কাজ এটি। তাকে সাক্ষাতে পেলে আমি নিশ্চয় অভিবাদন জানাতাম অসংশয়ে, নিঃসন্দিগ্ধ চিত্তে। আমার নিজেরই সবগুলি কবিতা পড়া আছে কিনা বলতে পারবো না। যে পড়েছে এবং তার সংগ্রহে এগুলি রেখেছে, তাকে আমি সাধারণই বা ভাবি কী করে? হয়তো সে কারণেই তার এই চিঠি আমি ফেলে দিই নি, যেমন ফেলে দিতে পারি নি তার সংগ্রহরাশিও। অবশ্য ফটোকপি সব জায়গায় স্পষ্টতা পায় নি, ভাল করে পড়া যায় না। লেখকের কপিগুলি নিশ্চয় এরকম নয়। তবে আমার তা জানা জরুরি নয় এখানে। আমি শুধু অবাক হয়েছি তার এই সংগ্রহের চেষ্টা এবং আমাকেও সেগুলি পাঠ করাবার আগ্রহ দেখে। আমি কবিতা লিখি, তাই কি এই সংকলকের মনে হয়েছে যে এই কবিতাগুলি আমারও অধীত হওয়া বাঞ্ছনীয় ? (সংগ্রহটি রীতিমত ঋদ্ধ ও প্রশংসাযোগ্য তাতে সন্দেহ নেই। নতুন ধারার কবিতার একটি ভাল সংকলন হতে পারে এগুলি।)
আমার স্ত্রী বলেন একটা ছোট কাগজও নাকি আমি ফেলি না। কিন্তু কাজের বেলায় তার পরীক্ষা হয়ে যায় এবং ভাল ফল পাই না। এইতো কদিন আগে বাংলা একাডেমির মোবারক হোসেন আমাকে বললেন, ‘কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে আপনি একটা স্মৃতিকথা লিখেছিলেন, সেটা আমার প্রয়োজন, তার কপি কোথায় পাই?’Ñ আমার মনে পড়লো কবি ১৯৫৪-৫৫ সালে আমি যখন সেন্ট গ্রেগরিজ (পরে নটরড্যম) কলেজের ছাত্র, তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাকে মাত্র দুই লাইনের একটি চিরকুট পাঠিয়ে ছিলেন। চাকরি শেষে ঢাকায় ফিরে আসার সময় আমার অনেক মূল্যবান বইপত্রের সাথে এই চিরকুটখানিও কোথায় উবে গেল শত খুঁজেও আর সেটা পেলাম না। এই সংসার বিস্মৃতিরই জায়গা। কিছুই থাকে না এখানে। যেন সে এক পরশ পাথর, পেয়েও হারাতে হয়। তার মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ কিছু কিছু অতীতের ধন কেমন করে আবার সামনে আসে। শাহরিয়ারকে সেভাবেই পেলাম আকস্মিক। কিন্তু হায় সে যেন আর এক ‘এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডার ল্যান্ডে’র বিড়াল। তার বাঁশী আছে, সে নাই।
………….
কানাই সেনের কবিতা অনুসরণে
শিশির ভেজা ঘাসের মত
স্নিগ্ধ দেহ নারীর
জঠরে তার স্বপ্ন-নেশায়
ভালবাসার ভিড় ॥

পারিপাশির্^ক নির্বিশেষে
যাকে বল স্ত্রী
অনুরাগের প্রেমিকারা
তবে অবৈধ কি?

রিরংসাতে শিথিল মনে
নারীর চিৎ অবয়
শ্রান্ত উদোম মাংসটা কি
বেশ্যা মনে হয়!
(ঢাকা : ৩১/ ১০/২০১৮)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট