চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

হুমায়ূন আজাদের নারী এবং অন্যান্য

মেহেরুন্নেছা মেরী

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:২২ পূর্বাহ্ণ

হুমায়ুন আজাদ ছিলেন বাংলাদেশি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার। তিনি বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কার বিরোধিতা, নিরাবরণ যৌনতা, নারীবাদ, রাজনৈতিক এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য ১৯৮০ সাল থেকে পাঠক গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গতানুগতিক চিন্তাধারা তিনি সচেতনভাবে পরিহার করতেন। তাঁর ‘নারী’ (১৯৯২), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (২০০১) এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪) গ্রন্থ তিনটি বিতর্কের ঝড় তোলে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির বেশি। ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁকে ১৯৮৬ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।

হুমায়ুন আজাদের অন্যতম প্রণোদনা ছিল প্রথা-বিরোধিতা। কবিতা, উপন্যাস ও রচনা সর্বত্রই তিনি প্রথাবিরোধী ও সমালোচনা মুখর। সর্বপ্রথম গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের আদলে ১৯৯১ প্রকাশিত প্রবচনগুচ্ছ এ দেশের শিক্ষিত পাঠক সমাজকে আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। একটি বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তাঁর স্বপ্ন ছিল। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেই তিনি মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ গড়ার পক্ষে অনুকূল বলে মনে করতেন। গদ্যের জন্য বেশি জনপ্রিয় হলেও হুমায়ুন আজাদ আমৃত্যু কাব্যচর্চা করে গেছেন। তিনি ষাটের দশকের আধুনিক কবি। ১৯৯০ সালে ঔপন্যাসিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই ‘নারী’। এই বইয়ের প্রকাশের পর তিনি মৌলবাদীদের তীব্র রোষানলে পড়েন। মৌলবাদীদের চেষ্টার ফলে ১৯৯৫ সালে নারী বইটি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ সরকার। অবশ্য ৪ বছর পর ২০০০ সালে বইটি আবার পুনর্মুদ্রিত হয়। তাঁর ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের দুরবস্থার সাহসী বর্ণনা আছে।

‘নারী’ বাংলাদেশের অন্যতম প্রথাবিরোধী এবং প্রগতিবাদী লেখক হুমায়ুন আজাদের একটি নারীবাদী রচনা। এটি সর্বপ্রথম ১৯৯২ সালে ঢাকার একুশে বইমেলাতে নদী প্রকাশনী দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীতে আগামী প্রকাশনী প্রকাশ করতে থাকে। বাংলা ভাষায় নারীবাদের সূচনা হয় বেগম রোকেয়ার হাতে যদিও সেটি ছিল অবিভক্ত ভারতীয় বঙ্গে, আর হুমায়ুন আজাদের লেখা এই বইটিই হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে নারীবাদ বিষয়ক প্রথম বই। এই বইয়ে মোট একুশটি অধ্যায় ছিল। এই অধ্যায়গুলো হলও আমি খুব সংক্ষেপে একটু আলোচনায় তুলে আনতে চাই । এমন কি লিখলেন তিনি এই নারী বিষয়ক রচনা গ্রন্থে ? যার কারণে তিনি মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ে প্রাণ দিলেন।

প্রথম অধ্যায় এ তিনি নারী ও পুরুষের তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন- পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় এবং সমাজে পুরুষেরা বিধাতার সমান। তার পরের অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন লৈঙ্গিক রাজনীতি- এই অধ্যায়তে বলা হয়েছে যে, পুরুষেরা যৌনতার ক্ষেত্রেও রাজনীতি করে। দেবী ও দানবী-পুরুষতন্ত্র নারীদেরকে একভাবে দেবী’র স্থান দেয় আবার দানবীও করে তোলে। নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়-প্রাচীন সভ্যতায় নারীদের অবস্থানের বিষয় এখানে বর্ণিত হয়েছে। পিতৃতন্ত্রের খড়গ আইন বা বিধিবিধান- মুসলিম এবং হিন্দু পিতৃতন্ত্র নারীদের ওপর কিভাবে খড়গ নামায় তার কথা বলা হয়েছ।

নারীর শত্রুমিত্র:
রুশো, রাসকিন, রবীন্দ্রনাথ এবং জন স্টুয়ার্ট মিল- ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাঁক রুশো, ইংরেজ সমাজপতি জন রাসকিন এবং বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সমালোচনা করা হয়েছে এঁদের পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতার কারণে এবং ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের পক্ষে কথা বলা হয়েছে তার নারী-অধিকার বিষয়ক লেখনীর জন্যে। ফ্রয়েডীয় কুসংস্কার, ও মনোবিশ্লেষাণাক-সমাজ বৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীলতা- প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড নারীদেরকে কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতেন তা এই অধ্যায়তে লিখিত হয়েছে।
নারী, তার লিঙ্গ ও শরীর- নারীদের শরীর যে নিষিদ্ধ কোনও জিনিস নয় তা এখানে বোঝানো হয়েছে।
বালিকা- এই অধ্যায়ে বালিকার বেড়ে ওঠার বর্ণনা রয়েছে।
কিশোরী তরুণী- কিশোরীদের জীবন কোথায় কেমন তা বলা হয়েছে।
নষ্টনীড়- নারীদের মাসিক ঋতুস্রাব সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
প্রেম ও কাম- প্রেম এবং যৌনতার ক্ষেত্রেও যে পুরুষেরা আধিপত্য বজায় রাখে এটা বলা হয়েছে।
বিয়ে ও সংসার- পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় বিয়ে নারীদের জন্য যে একটি পেশা এবং এতে নারীরা যেয়ে একটি পুরুষের সঙ্গে সংসার করে তাদের জীবন অবিকশিত করে দেয় তা বোঝানো হয়েছে।
ধর্ষণ- পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় নারী ধর্ষণ যে একটি সাধারণ বিষয় সেটা বোঝানো হয়েছে।
মেরি ওলস্টোনর্ক্যাফট: অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু- প্রখ্যাত ইংরেজ নারীবাদী ম্যারি ওলস্টোনর্ক্যাফট এর সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী এই অধ্যায়ের মূল বিষয়।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর:
প্রাণদাতা ও জীবন দাতা- ব্রিটিশ আমলের দু’জন বাঙালি রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করা হয়েছে, রামমোহন সতীদাহ প্রথা বাতিলের পক্ষে ছিলেন আর ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন বিধবা-বিবাহ প্রচলনের পক্ষে।
পুরুষতন্ত্র ও রোকেয়ার নারীবাদ- বাংলাদেশ ভূখ-ে জন্মগ্রহণকারী প্রথম পুরাদস্তুর নারী-অধিকার বাদী লেখিকা ছিলেন রোকেয়া, এই অধ্যায়তে তার সম্বন্ধে কিছু তথ্য আছে।
বঙ্গীয় ভদ্রমহিলা:
উন্নত জাতের নারী উৎপাদন- উনিশ শতকের বাংলার সমাজে নারীরা কিরকম জীবন-যাপন করতো তার বর্ণনা এই অধ্যায়ের বিষয়।
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা – নারীবাদী সাহিত্যের মূল্যায়ন-অবমূল্যায়ন রয়েছে এই অধ্যায়ে।

নারীদের নারীরা:
নারীদের উপন্যাসে নারী ভাবমূর্তি-নারী কেন্দ্রিক উপন্যাসে নারীকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয় বা হয়েছে সেটা এই অধ্যায়ের বিষয়।
নারীর ভবিষ্যৎ:
বাংলায় নারীর ভবিষ্যৎ কিরূপ হবে তার বর্ণনা রয়েছে এখানে। ২০০৪ সালে ২৭ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণে মারাত্মক জখম হন তিনি। কিন্তু এরপর আর বেশি দিন বাঁচেননি তিনি। ৭ আগস্ট জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান। ১২ আগস্ট নিজের ফ্ল্যাটে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া, শত বছর পূর্বেই তিনি বলে গেছেন, ‘আপনারা হয়তো শুনিয়া আশ্চর্য হইবেন যে, আমি আজ ২২বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি। ভারতবর্ষে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীব কাহারা জানেন? সে জীব ভারত নারী। এই জীবগুলির জন্য কখনও কাহারও প্রাণ কাঁদে না।’ তাঁর এই কথাকেই আবার সামনে নিয়ে আসেন প্রথাবিরোধী লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ। তিনি তাঁর ‘নারী’ বইতে লিখেছেন আমাদের দেশের শৃঙ্খলিত নারী সমাজের কথা। বলেছেন, ‘নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত পশু।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘পুরুষ নারীকে দেখে দাসী রূপে, করে রেখেছে দাসী; তবে স্বার্থে ও ভয়ে কখনো কখনো স্তব করে দেবীরূপে। পুরুষ এমন প্রাণী, যার নিন্দায় সামান্য সত্য থাকতে পারে; তবে তার স্তব সুপরিকল্পিত প্রতারণা।
হুমায়ুন আজাদ তার নারী বইতে লিখেছেন আমাদের দেশের শৃঙ্খলিত নারী সমাজের কথা। বলেছেন নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক আচরণের কথাও। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের নারীদের কথা বলেছেন, তুলে এনেছেন বিভিন্ন প্রান্তের নারীবাদীদের কথাও। এই বইয়ে নারী অধিকার নিয়ে হুমায়ুন আজাদের পরিপাটি দৃষ্টিভঙ্গির দেখা পাওয়া যায়। যদিও তিনি বলেছেন তিনি নারীবাদ নিয়ে লেখেননি

এমনকি নারীর উন্নয়নের উদ্দেশ্যেও লেখেননি। তিনি যা লিখেছে, তা একটি মহা রচনা, একটি বই। তবে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, বইটি পড়ে হয়তো বাঙালি নারী-পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে।

শেয়ার করুন