চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ইতিহাস ও সমকালে সুলতানের

চিত্রকলার ভাষা ও বক্তব্য

শাহিদ হাসান

৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১৪ পূর্বাহ্ণ

এস. এম. সুলতান ১৯২৩ সালে ১০ অগাস্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের অধীনস্থ বর্তমানে বাংলাদেশের নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামের দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। ঔপনিবেশিক মানসিকতা সম্পন্ন স্থানীয় জমিদার অথবা অভিজাত শ্রেণী রাজমিস্ত্রীর পেশাকে সম্মানের সঙ্গে দেখতো না। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে তথাকথিত অভিজাতদের মধ্যে আজো অমন মানসিকতা বিদ্যমান।

আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সুলতানকে বিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো সামর্থ্য তাঁর পিতার ছিল না। তবুও বহু কষ্টে মেছের আলী তাঁর সন্তান সুলতানকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করান। এস. এম. সুলতান এখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। অভাবের কারণে স্কুলের পাঠ অসমাপ্ত রেখে বাবার সঙ্গে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। রাজমিস্ত্রীর কাজ করার পাশাপাশি তিনি দালানের ছবি আঁকতেন। স্কুলে অল্প সময়ে ছাত্র থাকা অবস্থায় ড. শাম্যপ্রসাদ মুখার্জী স্কুল পরিদর্শনে এসে তাঁর আঁকা ছবি দেখে প্রশংসা করেছিলেন। সুলতানের ইচ্ছা হলো ছবি আঁকা শিখবেন। পরবর্তীতে তাঁর এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। জমিদারের সাহায্য নিয়ে সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিন বছর পড়াশোনা শেষ করে ফ্রিল্যান্স চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

শৈশব থেকে সুলতানের চিত্রশিল্পী হবার বাসনা জন্মায়। কারণ, সাদা ফ্রেমে জলরঙের সুচারু ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে নিজের খ–অখ- নানা রকম অনুভূতি অংকিত চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালে কৃষকদের ওপর সামন্ত প্রভুদের শাসন-শোষণ স্বচক্ষে দেখেছেন এস. এম. সুলতান। তৎকালে কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় কৃষক অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে। কৃষকদের পাশাপাশি কৃষিকর্মে কৃষাণীদের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কৃষকদের ওপর জমিদারের অহেতুক ও অযৌক্তিক নির্যাতন-নিপীড়ন সুলতানের শিশুতোষ মনে গভীরভাবে রেখাপাত। তার ফলশ্রুতিতে ভাটি বাংলার কৃষাণ-কৃষাণী সুলতানের ক্যানভাসজুড়ে ব্যাপ্ত। রেনেসাঁর ভাবধারায় সুলতানের অংকিত চিত্রকলার ভাষা ও বক্তব্য অনুধাবন করতে হলে রেনেসাঁর বিষয়ে আলোকপাত অনিবার্য।

চিন্তাশীল মানুষ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার্থে গুহায় ছবি আঁকতো। মানুষের অংকনের আদি প্রচেষ্টার প্রধান উপজীব্য বিষয় পশু-পাখি। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানুষ আদিকাল পেরিয়ে মধ্যযুগের চিত্রকলার পরিধিতে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি-পরিবেশ যোগ করতে আগ্রহ বোধ করে। এ যুগের চিত্রকলার বিষয় মূলত পরলোকমুখিতা এবং দেব-দেবীর আরাধনা বা গুণকীর্তন চিত্রায়ন চিত্রকলার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। মধ্যযুগের চিত্রশিল্পীরা মনে করতো মনুষ্য-জীবনের নিয়ামক শক্তি দেব-দেবী এবং তাদের ইশারায় পৃথিবীতে ভালো-মন্দ সব কিছু ঘটে, চ্যালেঞ্জ বা তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা মানুষের নেই। তারা মনে করতো দেব-দেবী ঐশ^রিক শক্তির অধিকারী। এটাই ছিল মধ্যযুগের ধর্ম ও দর্শনের গতি-প্রকৃতি। রেনেসাঁস কালে চিত্রকলার অগ্রণী চিন্তার শিল্পীরা রং তুলির সংস্পর্শে ক্যানভাসে দেব-দেবীর বদলে প্রধান হয়ে ওঠে মানুষ এবং রেনেসাঁর বিষয় হয় মানুষের জাগরণ ও মানবতার বিকাশ। রেনেসাঁর চিত্রকররা মনে করতেন মানুষ-ই সমস্ত চিন্তা ও শক্তির মূল উৎস, যার রয়েছে বিশালত্বের মহিমা ও অসাধারণ প্রায়োগিক ক্ষমতা। এ চিন্তা থেকে রেনেসাঁর চিত্রশিল্পীরা মানুষের আদল এঁকেছেন বিশাল আকারে। এ বিশালত্বের ভেতর প্রতীয়মান হয় মানুষের চিন্তা ও শক্তির ব্যাপকতা। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মনে করতেন- “মানুষের চোখ হলো আত্মার জানালা”। চিত্রকরদের চোখ আর আত্মার সম্মিলন রেনেসাঁস যুগে চিত্রকলায় অকার্যকর প্রাচীনত্ব পরিহার করে মানবতার জয়ধ্বনি শোনা যায়। যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান মনস্ক মনুষ্যপ্রধান রেনেসাঁর শিল্পকর্মে সুস্পষ্ট হয় প্রাচীনত্ব, অন্ধত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মৌলবাদী প্রভাব মুক্ত করার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। রেনেসাঁবাদী শিল্পীদের সংস্কার মূলক ভাবধারা সহজে বুঝতে পারলো তৎকালে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় মৌলবাদী উগ্র সম্প্রদায়। তারা ঘোর আপত্তি তুললো- দেব-দেবীর পরিবর্তে মানুষকে প্রধান ও অফুরন্ত সম্ভাবনাময় শক্তির আধার হিসেবে দেখা সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতির প্রতি বিদ্রোহ স্বরূপ এবং আমাদের পূর্বপুরুষের চিন্তন-প্রক্রিয়াকে সজ্ঞানে অস্বীকার করা। ক্ষমতায় থাকা অথবা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সুবিধাবাদী সম্প্রদায় রেনেসাঁবাদী চিত্রকরদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো বারবার। কিন্তু রেনেসাঁবাদী ইহকাল-মনস্কশিল্পীরা দমে যায়নি। তারা স্বমহিমায় তাদের চিত্রকর্মের মাধ্যমে দিনের পর দিন দুর্বার গতিতে অপূর্ব অনুপম সত্তায় উদ্ভাসিত হচ্ছিল। সেকালের অগ্রগামী চিন্তার যুক্তিবাদী মানুষ রেনেসাঁসের চিত্রকর্ম দেখে জীবনের সমীকরণ নতুনভাবে মেলাতে শুরু করে।

এস. এম. সুলতানের শিল্পমনে রেনেসাঁর ভাবধারায় অংকিত চিত্রগুলো গভীরভাবে রেখাপাত করে। তিনি ভাটি অঞ্চলের গ্রাম-বাংলার পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটের প্রধান চরিত্র কৃষাণ-কৃষাণীদের তাঁর ক্যানভাসে উপস্থিত করেন বিশাল ফিগারে এবং সপ্রাণ সম্ভাবনায়। তার কারণগুলো নি¤œরূপ-
১. চিত্রে বিশাল ফিগারের ধারণাটি সুলতান পেয়েছিলেন ইউরোপীয় রেনেসাঁস চিত্রশিল্পীদের নিকট। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের শিল্পীরা ইউরোপীয় সমাজের প্রথাগত চিন্তা ও মৌলবাদিতাকে দৌর্দ- প্রতাপে রোধ করে দেব-দেবীর পরিবর্তে মানব-মানবীর বিশাল ফিগার এঁকেছে। তারা মনে করতো বিশাল ফিগারে দেখানো যায় মানুষের অফুরন্ত ইচ্ছাশক্তি ও অপার সম্ভাবনা। সুদৃঢ়ভাবে প্রাচীন চিন্তায় ও ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হলে এ ধরনের ফিগার সম্বলিত চিত্র প্রয়োজন এবং সমাজে প্রভাব বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখে বলে রেনেসাঁসের শিল্পীরা মনের করতো।
২. সুলতান শৈশবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন দেখেছেন। কৃষকদের শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল জমিদার, জোতদার বা তালুকদার, রায়ত ও নি¤œ রায়ত। ক্ষমতাবান এ হিন্দু সম্প্রদায় কৃষকদের ওপর অমানুষিক নিপীড়ন ও নির্যাতন চালাতো। তৎকালে কৃষকদের বিরাট অংশ ছিল অশিক্ষিত ও দরিদ্র মুসলমান। তারাও স্থানীয় শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা বাংলার ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন নামে সমধিক পরিচিত। সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে কৃষকদের অসম্ভব সাহসী কার্যক্রম সুলতানের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। সুলতানের কৃষকরা নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের সামর্থ্য অনুসারে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। এস. এম. সুলতানের চিত্রের মতো তার প্রতিচ্ছবিও আমরা দেখতে পাই কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লহ’র মিনি মহাকাব্যিক আমেজের ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতায়। চিত্রকর সুলতানের চিত্রভাষা ও বক্তব্যের সঙ্গে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লহ’র ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতার সাদৃশ্য ও বলার মেজাজের কিয়দাংশ উল্লেখ করছি- “আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।/তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল/তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।/তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন/অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন/পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন/তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।/জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,/কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।”

সুলতানের চিত্র এবং আলোচ্য কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় ভাটি বাংলায় আমাদের পূর্বপুরুষের প্রধান পেশা ছিলো কৃষি। কৃষি কাজে নিয়োজিত হাত দু’টিতে মাটির ঘ্রাণ সর্বদা লেগে থাকতো আর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালের জমিদারের চাবুকের আঘাত পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত হয়ে ফুটে উঠতো বারবার। তবুও তারা পতিত জমি আবাদে জন্য এগিয়ে আসতো নবোদ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম এবং ভেদাভেদহীন নতুন ভূমি গড়ার লক্ষ্যে। ভাটি বাংলার কৃষকসমাজ অনাবাদী জমি টি. এস. এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’-এর মতো ফেলে রাখতো না। শস্য ফলানোর মানসিকতায় সর্বদা বলীয়ান ছিলো।
সুলতানের চিত্র এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লহ’র কবিতাটি উত্তর প্রজন্মকে আত্ম-পরিচয় জানার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যে-জাতি তার সঠিক ইতিহাস জানে না সে-জাতি আত্ম-পরিচয় সংকটে ভুগে প্রতিনয়ত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ভাটি বাংলার তথাকথিত আজকের অভিজাত মুসলমান শ্রেণি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও এ ব্যাধি থেকে কখনো মুক্ত নয়! এক্ষেত্রে সুলতানের চিত্রের মাধ্যমে আত্ম-পরিচয় জানার দিকটিও অখ- গৌরবে সম্জ্জ্বুল।
৩. সুলতানের ক্যানভাসে বিশাল দৈহিক কাঠামো নিয়ে মহাকাব্যিক আয়তনে প্রকাশ পেয়েছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও আত্মপ্রত্যয় দীপ্ত কৃষক। উক্ত কৃষকের জীবনসঙ্গিনী বিশাল দেহের ভাটি বাংলার শক্তিময়ী ও পরিশ্রমী কৃষাণী। তারাও কৃষিনির্ভর ভাটি বাংলার অর্থনৈতিক পটভূমিতে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সুলতানের চিত্রে নারীশক্তি এবং তাদের কর্মপ্রত্যয় দেখা যায়। এখানে নারীর কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তাদের অধিকারের প্রসঙ্গটি সুস্পষ্টভাবে চলে আসে এবং নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে দেয় এটা কিন্তু সুলতানের চিত্রকলার অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। উদাহরণ হিসেবে প্রাসঙ্গিক যে, আজকের দিনে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার লক্ষ্যে এদেশের অধিকাংশ নারী গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে জড়িত। আজকে শ্রমজীবী নারীদের কর্মতৎপরতা অতীতের ভাটি বাংলার কৃষাণীদের কঠোর কর্মময় জীবন থেকে প্রাপ্ত। অনাদী কাল থেকে ভাটি বাংলার জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের দুর্বার অংশ গ্রহণ শিল্পী সুলতানের নজর এড়িয়ে যায়নি। তিনি কৃষাণীদের কর্মের মাধ্যমে সমগ্র নারী সমাজের সক্রিয়তার প্রকাশ করেছেন তাঁর তুলির সুনিপুণ স্পর্শে।

৪. উন্নয়নশীলের নামে তৃতীয় বিশে^র দেশে দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা দলীয় শাসনের অধীনে দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে জনগণের ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর জনগণের স্বার্থে বিপরীতে অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং জনগণ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলে তাদের অনুগত বাহিনী দিয়ে নিপীড়ন ও নির্যাতন চালায় এবং প্রতিবাদীদের শেষ আশ্রয় জেলখানা অথবা মৃত্যু। এ অরাজক পরিস্থিতিতে তথাকথিত সুশীল সমাজ ক্ষমতাসীন দলের সুযোগ-সুবিধার ছায়াতলে অবস্থান করে দলীয় মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। তারা দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে সভা-সমিতিতে জনস্বার্থ বিরোধী বক্তব্য রাখে। এক্ষেত্রে আরব দেশের ইতিহাসের পাতা থেকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উমাইয়া উৎপীড়ক শাসক মাবিয়া এবং তার পুত্র পরবর্তী শাসক ইয়াজিদ কঠোর ভাষায় বলেছিল, “আমাদের প্রশংসার জন্য তোমাদের মুখ সর্বদা খোলা, আর নিন্দার জন্য তরবারির খাপ খোলা।” এ নীতির সমর্থনে সেকালে সুবিধাভোগী তথাকথিত সুশীল সমাজ। তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে অুীত কাল থেকে আজ পর্যন্ত এ ধরনের নীতি বিরাজমান। ভাটি বাংলার দেশজ রেনেসাঁসের চিত্রকলার বরপুত্র সুলতানের কৃষকের প্রতিবাদ মুখর এবং সংগ্রামরত চিত্রগুলো অপশাসনের দেশে প্রাসঙ্গিক। এ কারণে সুলতানের চিত্রগুলোর আবেদন আজো ফুরায়নি, কালে থেকে কালান্তর পেরিয়ে আজ কালোত্তীর্ণ।
রেনেসাঁস চিত্রকলার প্রকরণ-প্রকৌশলটি সুলতান শুদ্ধরূপে আত্মস্থ করেছিলেন। ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীরা দৃঢ় চিত্তে অচলায়তন ভাঙার পণে মগ্ন ছিলো। তৎকালে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকসহ সর্বক্ষেত্রে দৌর্দ- প্রতাপে ছিলো মৌলবাদীচক্র। এদের বিরুদ্ধে

বৌদ্ধিকভাবে লড়াই করার জন্য পাল্টা শক্তিশালী ডিসকোর্স বা বাচন সৃষ্টির প্রয়োজন অনুভব করে রেনেসাঁসের শিল্পীসমাজ। এ ব্যাপারে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রেনেসাঁসের চিত্রকররা অচলায়তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ তাদের ক্যানভাসে বিশাল-বিশাল মানব-মানবীর ফিগার এঁকেছেন। সুলতান সজ্ঞানে তাদের কাছ থেকে বিশাল দেহের ফিগারটি গ্রহণ করে স্থাপন করেছেন ভাটি অঞ্চলের কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার প্রধান চরিত্র কৃষাণ-কৃষাণীর ওপর। তিনি কৃষাণ-কৃষাণীর ভেতর দেখেছেন ইচ্ছাশক্তির অমিত সম্ভাবনা। বাস্তবে বাংলার কৃষাণ-কৃষাণীরা ক্ষীণকায় হলেও আত্ম-প্রত্যয়ে কিন্তু সবল। তারা প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্যোগের সময়ও বুক চেতিয়ে মোকাবেলা করে সমস্ত বাধা। নিকট অতীতে ভাটি বাংলা সমস্ত রাজনৈতিক সংকটেও তারা আত্ম-প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে অখ- গৌরবে অংশ গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে সুলতানের চিত্র-চরিত্রের সঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির চরিত্র ও বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণকালে ‘বিদ্রোহ’ কবিতায় বলিষ্ঠ ও দীপ্তময় উচ্চারণের মাধ্যমে বাঙালির সাধারণ গড় পাঁচ ফুট পাঁচ বা ছয় ইঞ্চি উচ্চতাকে রেনেসাঁস চিত্রকলার শিল্পীদের মতো কল্পনায় কবিতার মাধ্যমে “ওই শিখর হিমাদ্রির” পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। কবিতাটির প্রথম স্তবক- “বল বীর-/বল উন্নত মম শির!/শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!/বল বীর-/বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!/ মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর-/আমি চির উন্নত শির!”
এখানে কবি নজরুলের সঙ্গে শিল্পী সুলতানের প্রকাশ মাধ্যম আলাদা হলেও চিন্তাগত দিক থেকে দু’জনেই সমমনা। দু’জনে বাউ-েলে, এক ধরনের উদ্বাস্তু। তাঁদের মতো মানসিকতার পক্ষে সম্ভব অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার জন্য দু’জনে চিত্র ও কবিতার মাধ্যমে বারবার বয়ান করেছেন।

শিল্পী সুলতান গ্রাম-বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও জনপদকে সবসময় ভালোবেসেছেন এবং যান্ত্রিক নগরের মেকি জীবনকে মনে-প্রাণে পছন্দ করতেন না। তাঁর চিত্রগুলো দেশজ আধুনিকতায় অবয়ব প্রধান। সুলতানের দেশজ আধুনিকতায় ছিলো এ অঞ্চলের জন-জীবনের শাশ্বত বোধ। তিনি কখনো বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি এবং ফর্ম নিরীক্ষার ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব দেননি। সুলতান বারবার তাঁর চিত্র-চরিত্রের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন মানুষের ভেতর-শক্তির উত্থান এবং ঔপনিবেশিকতাসহ কালে কালে শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামকে উপস্থাপন। তিনি ইউরোকেন্দ্রিক যান্ত্রিকনির্ভর নগর সভ্যতার পরিবর্তে এ অঞ্চলে বারবার অন্বেষণ করেছেন রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের সুসংহত কর্মময় প্রশান্ত পটভূমি।
সুলতানের ক্যানভাসের প্রধান বিষয়বস্তু গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ। জন্মের পর থেকে রোদ-বৃষ্টি ও কাদাজলের সাথে তাদের সম্পর্ক এবং রুটি-রুজির উৎস স্থল মাঠ, প্রান্তর, জলাশয় ও সবুজ ধানক্ষেত। যেখানে জমি কর্ষণরত চাষী, বাঁশিতে সুর তোলায় মগ্ন রাখাল, জেলে সম্প্রদায়ের মাছ ধরা, মাছকোটায় ব্যস্ত গ্রাম্যবালা। কুঁড়েঘর, উঠোন, খড়ের পালা, কলাগাছের সারি, অলস দুপুরে গৃহিণীরা খোশগল্পে মেতে থাকা, গোধূলি বেলায় মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে গ্রাম্যবধূর বাবার বাড়ি যাবার দৃশ্য। সুলতানের অংকিত চরিত্রগুলো মূলত কৃষিকর্মের কারণ মাঠে সর্বদা ব্যস্ত। তিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন, তাঁকে অনেক শিল্পবোদ্ধা বিশ্বজুড়ে কাল্পনিক কৃষিসভ্যতার জনকও বলে থাকে ।
এস. এম. সুলতানের আঁকা ছবিগুলোতে ভাটি বাংলার কৃষকরা দৈহিকভাবে বলিষ্ঠ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন- “আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ণ। কৃষি পেশার সাথে জড়িত কৃষকও খুব রোগা এবং তার হালের বলদ দুটো আরো রোগা। আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা আমার মনের ব্যাপার। আমি তাদের ভেতরের অফুরন্ত ইচ্ছাশক্তিকে চিত্রের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করছি মাত্র। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি সেভাবেই তাদের তুলে ধরি। নিকট অতীতে কৃষিনির্ভর দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি ছিল কৃষক সম্প্রদায়। আমার ছবিগুলোতে কৃষকের অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ণ কেন- যারা আমাদের অন্ন যোগায়, ফসল ফলায়। ওদের বলিষ্ঠ হওয়া উচিত।”
সুডৌল ও সুঠাম গড়নে গ্রাম্যনারীকে সুলতান উপস্থাপন করেছেন তাঁর ক্যানভাসে। তিনি নারীর মধ্যে চিরাচরিত রূপ-লাবণ্যের সাথে আত্মশক্তি প্রত্যয়ের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। এছাড়াও ছবিগুলোতে গ্রামসমাজের কৃষিনির্ভর প্রেক্ষাপটের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব এবং গ্রামের অর্থনৈতিক কঠোর ও নির্মম বাস্তবতা উঠে এসেছে। তাঁর এরকম দু’টি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে- ‘হত্যাযজ্ঞ’ (১৯৮৭) এবং ‘চরদখল’ (১৯৮৮)।

রেনেসাঁসের ভাবধারায় আঁকা ইউরোপীয় চিত্রকলার প্রকরণ-কৌশলটি ভাটি অঞ্চলের পরিবেশ-প্রেক্ষাপটে কৃষাণ-কৃষাণীদের মাধ্যমে বিনির্মাণের প্রক্রিয়ায় দেশজ করণ করতে সক্ষম হয়েছেন চিত্রকর সুলতান। এটা চিত্রকর সুলতানের চিত্রকলার একেবারে নিজস্ব পুঁজি। এক্ষেত্রে তাঁর চিত্রকলাকে ভাটি বাংলার দেশজ রেনেসাঁসের চিত্রকলা বলা যায়। তাঁর চিত্রকলায় দেখা যায়, সংগ্রামের মাধ্যমে বেঁচে থাকার সম্ভাবনার কৌশল উদ্ভাবন, যা ভাটি বাংলার বাঙালি জাতিকে আত্ম-প্রত্যয়ী করতে সাহায্য করে এবং সমকালে দৈশিক ও বৈশি^ক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও শোষণের বিরুদ্ধে যূথবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবার পাটাতন তৈরিতে প্রতিনিয়ত সাহস যোগায়। তবে একটা বিষয় আলোচনা না করলে চিত্রকর সুলতান সম্পর্কে অনালোকিত থেকে যাবে সেটি হচ্ছে- সুলতানের মহাকাব্যিক আয়তনের চিত্রগুলোতে বিষয়ের বৈচিত্র্য নেই। তিনি আজীবন মূলত কৃষাণ-কৃষাণীকে প্রধান করে ছবি এঁকেছেন। তাঁর চিত্রগুলো এক সঙ্গে দেখলে মন ও মননে ক্লান্তির ছাপ পড়ে। এর অন্যতম কারণ সুলতানের একরৈখিক চিন্তা। কালে কালে তাঁর চিন্তার আমূল কোন পরিবর্তন ঘটেনি, অন্তত তাঁর চিত্র দেখে তাই মনে হয়। একজন শিল্পীকে সময়ের পরিবর্তনটি সতর্কের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সময় সচেতনতা একজন শিল্পীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সর্বশেষে লেভ টলস্টয়ের ‘থ্রি কোশ্চেন’ গল্পের প্রশ্ন দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। লেভ টলস্টয় সময় সম্পর্কে বলেছেন- “১. হোয়াট ইজ দ্য মোস্ট ইম্পোর্টেন থিং? ২. হোয়াট ইজ দ্য মোস্ট ইম্পোর্টেন টাইম? এবং ৩. টাইম উইল সে, হোয়াট টু ডু অ্যান্ড হোয়াট নট টু ডু।”

সময় সচেতনতার ব্যাপারে সুলতানের সীমাবদ্ধতা লেভ টলস্টয়ের উল্লেখিত তিনটি প্রশ্নে নিহিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও সূচির পরিবর্তন ঘটে। এ কারণে বৈচিত্র্য আনার জন্য যে কোন শিল্পীর বিষয়বস্তু পরিবর্তন জরুরি, তা না হলে স্থবিরতার মাধ্যমে শিল্পে পুনরাবৃত্তি ঘটে অনিবার্যভাবে। চিত্রকর এস. এম. সুলতানের বেলায় তাই ঘটেছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট