চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাম্যের গানে জ্বলে দাসখতে লাথি মারি

মঈন ফারুক

৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১৫ পূর্বাহ্ণ

কবি প্রতিনিয়ত খুঁজেন নতুন নতুন আবহের ঘ্রাণ, যে মাতাল ঘ্রাণে ডাহুক সেজে কোমল জোছনায় হরণ করে সুন্দরীর কুহর মন। কখনো দেখেন বৃষ্টিভেজা বালিকার দেহে সাগর ঢেউ, আবার কখনো-সখনো ঢেউয়ের ভাঁজে-ভাঁজে খুঁজেন নিকষ আঁধার। কখনো বা নববধূর ঘোমটা তুলে খুঁজে পান এক আকাশ ভালোবাসা। সে ভালবাসাই মুগ্ধ হৃদয় লিখে যান মেঘ-বৃষ্টির মধুর ইতিকথা।
শব্দের আবহে শব্দ গেঁথে কবি এগিয়ে যান সুন্দর দৃশ্যায়নে। তাই একজন কবি বারেবারে বোঝেন শব্দের ভাষা। শব্দের অফুরান শক্তিতে নিজেকে বলীয়ান করে আঁকেন কাজল কালো আঁখির চমকপ্রদ লাইন। যার প্রতিটা লাইনে লুকিয়ে থাকে অনাবিল সৌন্দর্যের ভরাডুবি।

কবি আতাউল হাকিম আরিফ। যার কবিতাগ্রন্থ ‘দাসখতে লাথি মারি’ চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাবা-মা’কে। গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, মৌমিতা কর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লিখে হাত পাকিয়েছেন অনেক আগে। এবার কবিতাগ্রন্থের কবিতার দিকে ফেরা যাক। কবিরা যে প্রেমিক হয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় কষ্ঠনদী কবিতায়, প্রেমিকাকে হারানো বেদনায় সবই যে ম্লান হয় তা ফুটে উঠেছে এই কবিতায়-
‘আজ তুমি নেই, মূল্যহীন শুধুই আমি।/এ বুক আজ এক বহমান কষ্টনদী!/নিরবধি কষ্টের স্রােতধারা বয়ে যায়।’
(কষ্টনদী, পৃষ্ঠা-১৫)
প্রেম হল শাশ্বত, প্রেম হল অদ্ভুত এক শক্তি। কবির প্রেম যে নিখাদ তার প্রমাণ মেলে উপরের উল্লেখিত কবিতায়। মানুষের রূপ বহু ধরনের। একেক মানুষের রূপ একেক রকম। কারও সাথে কারও কখনোই মিলবে না। এই না মিলার জগতে খারাপ মানুষের অভাব নেই বরং ভালো মানুষের অনেক অভাব। তাইতো বর্তমান সময়ে মানুষের আচরণ, রঙ, রূপ কবি বুঝেছেন, ঠকেছেন নিশ্চয়। তাই কবি বলেছেন-
‘অদ্ভুত এক অমানিশার কাল,/জীবন যেনো এক গিরগিটি/রঙ পাল্টায়, পিচ্ছিল হয়ে থাকে।’
(জীবন যেনো এক গিরগিটি, পৃষ্ঠা-১৯)

এই কবিতায় কবি জীবনকে গিরগিটির সাথে তুলনা করেছেন। কারণ আমরা মানুষের আচরণে যে ভয়াবহ রূপ তাতেই কবি ক্লান্ত। কবিরা সাধক হয়, তা না হলে ভবিতব্য কথা বলে কিভাবে! কবি রহস্যেও জাল উন্মোচন করতে গিয়েই ‘নারী ও সভ্যতা’র কবিতার জন্ম। কবি বলেছেন কিভাবে এক দেবশিশুর জন্ম হয়। যার হাতেই আগামী পৃথিবী ন্যস্ত থাকে। এক নারীর গর্ভেই বেড়ে ওঠে সভ্যতা নিমার্ণের কারিগর। তাই কবি বলেছেন-
‘খুব সহজে প্রতিউত্তর খুঁজে পায়/নারীর তলপেট ফুলে-ফেঁপে আগন্তুক/নতুন সভ্যতা নিমার্ণের কারিগর!’
(নারী ও সভ্যতা, পৃষ্ঠা-২৯)
একজন নারী মানে বিশাল কিছু। নারী এই শব্দের বিশালতা অনেক এবং নারীর ধারণ ক্ষমতাও কম নয়। এই সুনিপুণ চিত্রকল্প নির্মাণ যার-তার দ্বারা সম্ভব নয়। কবিরা সাধক হয় বলেই এমন সুন্দর ক্যানভাস তৈরি করা সম্ভব।
আমাদের পূর্ব-পুরুষদের হাত ধরে আমরা আজও পথ চলছি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলছে দাসত্বের ঘেরাটোপে। সময় চলছে, বাড়ছে মানুষের বয়স। সেই ব্রিটিশদের শাসন হতে মুক্ত হতে হতে তবুও পারি নি মুক্ত হতে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারি নি বলেই কবি বলেছেন-
‘পূর্বপুরুষের দেখানো পথে এখনো/কুঁজো হয়ে হাঁটছে একদল।/বোধহীন চেতনার জাল বিস্মৃত এবং/ক্রমেই স্পষ্টত শয়তানের প্রতিবিম্ব।/প্রান্তজন এখনো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে পূর্বপুরুষের দাসত্ব।’
(পূর্ব পুরুষের দাসত্ব- পৃষ্ঠা-৪২)

কবিতাগ্রন্থের ৫৬ পৃষ্ঠায় ‘ফিরে আয়’ কবিতায় দেখি, দিন দিন বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের বাঙালির সংস্কৃতির যে বেহাল দশা তার বর্ণনায় পাওয়া যায়। বিদেশী আচার-ব্যবহার থেকে শুরু করে বিদেশি চলা-ফেরা সবই অনুকরণ করছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। বিনষ্ট হচ্ছে এবং হারানোর পথে আমাদের চিরায়ত বাংলা সং¯ৃ‹তি। বিদেশি সংস্কৃতির করাল গ্রাসে গিলে খাচ্ছে হাজার বছরের পুরনো এই সংস্কৃতি। তাই কবি খুব আক্ষেপ করে বলেছেন- ‘কেবলি একখ- মাটিতে শুয়ে আছি,/সবুজ ঘাস নেই, মাদুর নেই/এই মাটি নীরব, হিমশীতল/
একটিও ঘড়ি নেই, নৃত্যকলা নেই।’
(একখ- মাটিতে শুয়ে আছি, পৃষ্ঠা-৬৩)
মৃত্যুও পর প্রতিটা মানুষের জায়গা হবে সাড়ে তিন হাতের মাটির ঘর। যে ঘরে কাটাতে হবে সহ¯্র বছর। যেখানে থাকবে না কিঝুই। তার বর্ণনায় খুব সুন্দর করে তুলে এনেছেন এই কবিতায়। বাস্তব জীবনের এতসব আয়োজনের কিছুই থাকবে না ওই ঘরে। সে ভবিতব্যের কথা যদি মানুষ ভেবে থাকে তাহলে এসব অপকর্মের কথা চিন্তাই করতে পারবে না। তবুও মানুষ চলছে ভয়হীন ভাবে।

এভাবে কবিতা ধরে ধরে আলোচনা করতে গেলে লেখার ইতিটানা হবে না। আর সব কবিতা আলোচনা করাও সম্ভব নয়। কবি আতাউল হাকিম আরিফ নিঃসন্দেহে একজন কবি। তার চিন্তার গভীরতার বিশলতা আছে। যা সহজেই বলে যেতে পারেন কাব্যিক ঢঙে। কবির কবিতায় প্রেম যেমন আছে আবার প্রেমের ভাঙনও আছে। সমাজ-বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি আছে। আছে দেশ ও দশের কথা। আবার কখনো-সখনো দ্রোহের কথা আছে।

কবির চিন্তাকল্পের দিক দিয়ে কিছু বলার নেই শুধু এইটুকু বলা কবিতা গাঁথুনির দিক দিয়ে খানিক নজর দেয়া যেতে পারে। ৬৪ পৃষ্ঠার বইয়ে কবিতা আছে ৫৬টি। দাম রাখা হয়েছে ১৬০ টাকা। যে কোন পাঠককে কবিতাগুলো ছুঁয়ে যাবে এবং এই কবিতাগ্রন্থ কবিতামোদীর আশা পূরণ করবে এই আশা করছি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট