চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিপ্লবী নজরুল

রতন কুমার তুরী

৩০ আগস্ট, ২০১৯ | ১:১৮ পূর্বাহ্ণ

কবি নজরুল ইসলাম। সাহিত্যকাশে এক দ্যুতিময় সাহিত্যকের নাম। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের জন্ম না হলে আমাদের বাংলা সাহিত্য অপূর্ণই থেকে যেতো। এই অসম্ভব ধীমান সাহিত্যিক তার সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি নিজের দেশ এবং সমাজ নিয়ে চিন্তা করে গেছেন চিরকাল। প্রকতপক্ষে খুব ছোটো বয়সে ‘ভোর হলো দোর খোলো’ কবিতা পড়ে আমাদের বাঙালি ছেলে-মেয়েদের নজরুলের কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তারপর ‘কাঠবেরালি’ ‘দেখবো এবার জগৎটাকে’ পড়ার বয়স পেরিয়ে এসে একদিন পরিচিত হয় কবির সেই বিখ্যাত কবিতা ‘বলো বীর চির উন্নত মম শির’-এর সঙ্গে। জানতে পারে এই নজরুল কবিতা লিখে, কাগজ বের করে এক সময় জেল খেটেছেন, ভোগ করেছে বিদেশী ব্রিটিশ সরকারের অকথ্য ঘৃণ্য নির্যাতন। আরো জানতে পারে, অনেক জ¦ালাময়ী কবিতা ও গান লেখার জন্য এই কবি নজরুলকে বলা হয় ‘বিদ্রোহী’ কবি। প্রকৃতপক্ষে একাল এবং সেকাল কোনো কালই নজরুলকে খুব ভালো করে মূল্যায়ন করা হয় নাই। অন্যান্য সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যাপকভাবে গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে নজরুলকে নিয়ে তেমন একটা চোখে পড়ে না। অথচ নজরুল সাহিত্য গবেষণায় বেরিয়ে আসতো তার নতুন নতুন দিক। তবুও এ পর্যন্ত যা গবেষণা হয়েছে তাতেই অনন্য নজরুল। নজরুলের প্রথম যৌবনে ইচ্ছা জেগেছিলো পৃথিবীর রণক্ষেত্র পরখ করার। তাই তিনি স্বজনদের সাথে বিদ্রোহ করে প্রথম বিশ^যুদ্ধে বাঙালি পল্টনের সৈনিক হলেন কবি নজরুল। হাতে তার রণতুর্য। যুদ্ধ হতে ফিরে এসে গান কাব্যে আবৃত্তিতে দেশাময় একটি বিদ্রোহী আবহ সৃষ্টি করার স্বপ্ন দেখলেন কবি-সৈনিক। ১৯২২ সালে কিছু বন্ধুদের সাথে নিয়ে প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’। শৌর্যের বার্তাবহ সে কাগজ তরুণ-চিত্তে অপূর্ব আত্মদানের আহবান নতুন করে জাগানো। বাংলার বিপ্লবী-মন বিস্ময়ে ‘ধূমকেতু’র প্রতিটি অক্ষরে প্রাণের কথা পাঠ করে উৎসাহিত হল। ‘ধূমকেতু’ বেশি দিন চললো না। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের রুদ্রদৃষ্টি ধূমকেতুর ওপর পড়লে ধূমকেতু বন্ধ হয়ে যায়। নজরুলের তাতে ক্ষতি নেই। এ সময় হঠাৎ করেই তার কণ্ঠে উদিত হলো ‘মার্চিং সঙ’ বা চলার সঙ্গীত। তরুণ সমাজ তার ‘মার্চিং সঙ’ কণ্ঠে ধারণ করে তার চারিদিকে প্রকাশ ঘটাতে লাগলো। বাংলা ভাষায় সামরিক পদ্ধতিতে চলার সঙ্গীত ছিলো না। নজরুল ছিলেন সেই অমর সঙ্গীত: অভিযাত্রীরা পদছন্দে তালে তালে গাইতে লাগলো-

“চল্ চল। চল্!
ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল
নি¤েœ উতলা ধরণী-তল
অরুন প্রাতের তরুন দল’-”
নজরুলের এই অগ্নি চলার গানের মাধ্যমে বাংলার বিপ্লবীরা তাদের দুরন্ত আদর্শকে আপন করে লাভ করলেন। নজরুলের যাত্রা শুরু হলো বিপ্লবপন্থার পুরো ভাগে। বিপ্লববাদের চারণ কবির ভূমিকার। এর পরবর্তীতে কবি আরো বলেন-
“প্রার্থনা করো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় কাতের সর্বনাশ।”
কত গভীর অনুভূতি কতো ব্যাপক ও নিবিড় বেদনা থেকে যে কবির অন্তরে বিপ্লব সত্তার জন্ম। তার মর্মবাণী রয়েছে এসব কথামালার মধ্যে। মানব পূজারী নজরুল বলেন-

“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
তাই তিনি বলেছেন-
“গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে রঙ কিছু নাই, নহে কিছু মাহিয়ান।”
নজরুল দেশের জন্য খাঁটি বিপ্লবী বলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দেখেননি। কারণ, তার কাছে:
“নাই দেশ-কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সবকালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”
তাই কবি সাম্যের গান গাইতে পারলেন। তার কাছে হিন্দু-মুসলমান জাতি একাকার হয়ে গেছে। তাই বিপ্লবী কবির কণ্ঠে শুনি:
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায় কে দেয় সেথায় তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!”
আবার মানুষের অন্যায় আচরণে দুঃখ পেতে কবি বলেছেন:
“মানুষেরে ঘৃণা করি
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!”
মহাবিপ্লবী নজরুল বিপ্লবীর কণ্ঠে আবার সাম্যের গান গাইলেন:
“যত্র পাপীতাপী-সব মোর বোন, সব মোর ভাই।”

প্রকৃতপক্ষে-বিপ্লবী নজরুল বিশ^মানবের প্রেমে অভিষিক্ত হয়ে বাংলার এক প্রান্ত থেকে সমাজের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবের প্রত্যয়ে বিভিন্ন গণজাগরণী গান গেয়েছেন। আর সেই আত্মবিশ^াস থেকেই বিপ্লবী কবির রক্তে জাগো প্রত্যয় লিখা:
“আমার সৃজিব নতুন জগৎ, আমরা গাহিব নতুন গান প্রকৃতপক্ষে নজরুল কবি ও দ্রষ্টা। কবির বাণী এবং দ্রষ্টার উক্তি সে যুগে সফল হয়েছিল। রুদ্রের সাধনায় সিদ্ধ শহীদকূল সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয় বসু, প্রদ্যোৎ, ভবানী, ভগৎ সিং,আসফাক উল্লা, উর্ধম সিং যতীন দাস, সাতঙ্গিনী, কনকলতা এবং সর্বোপরি নেতাজী পরিচালিত আজাদ হিন্দ ফৌজের অগনিত মৃত্যুঞ্জয়ী বীর এবং কুইট ইন্ডিয়ার সংগ্রামী দল এই বিপ্লবী চারণ কবির ছন্দোবদ্ধ গান এবং কবিতাকে অনুস্মরণ করেই ভারত বর্ষকে স্বাধীন করেছিলো।”

প্রকৃতপক্ষে নজরুলের বিপ্লবী পটভূমিকা সে সময়ের সমস্ত ভারতবাসী অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিলো এবং তার পদাংক অনুস্মরণ করেই বিপ্লবীরা পথ চলেছিলো।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট