চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে পহেলা বৈশাখ

১৪ এপ্রিল, ২০২৩ | ১২:৩০ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হলেও এবং চট্টগ্রামের জনসাধারণ পহেলা বৈশাখ ও দিনটির উদযাপন দ্বারা দারুণ প্রভাবিত হলেও প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে দিনটির উপস্থিতি খুবই কম। এটা আমাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ বটে।

পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষের প্রথম দিন। দিনটি উদযাপনের অর্থ মূলত বাংলা নববর্ষ উদযাপন। কৃষি পণ্যের খাজনা আদায়ে মোগল সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকার দিন-তারিখ অনুসরণ করতেন বিধায় কৃষকরা খাজনা পরিশোধে নানা অসুবিধার সম্মুখিন হচ্ছিল। যেহেতু চন্দ্রের উপর হিজরি সনের নির্ভরতা। ফলে মোগল সম্রাট আকবর  কৃষিকাজের সুবিধার্থে বাংলা বর্ষ প্রবর্তন করেন। ৯৬৩ হিজরি, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর আকবর  দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি এইদিনকে স্মরণীয় করে রাখার সংকল্পেও সনটির প্রবর্তন করেন বলে ইতিহাসসূত্রে জানা যায়। এই সনে দিন গণনা শুরু হয় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে। তাই একে সৌরদিনও বলা হয়।

৯৯৮ হিজরি, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ রাজ জ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী আকবরের নির্দেশে হিন্দু  সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ভিত্তিতে যখন বাংলা সন উদ্ভাবন করেন, তখন এই সনের বয়স ধরা হয় ৯৬৩ বছর। তখন নতুন সনটি ‘ফসলি সন’ নামে  পরিচিত ছিল। বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ নামে     পরিচিত হয় পরবর্তীকালে। বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। নক্ষত্রের নামের উপর ভিত্তি করেই এই নামকরণ। যেমন, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেকে মার্গশীষ বা অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী  থেকে ফাল্গুন, চিত্রা থেকে চৈত্র। বাংলা সনের সপ্তাহের সাতদিনের নামকরণ হয় গ্রহ ও দেবতাদের নামের আশ্রয়ে। যেমন, সোম বা শিব দেবতা থেকে সোমবার, মঙ্গল গ্রহ থেকে মঙ্গলবার, বুধ গ্রহ থেকে বুধবার, বৃহস্পতি গ্রহ থেকে বৃহস্পতিবার, শুক্র গ্রহ থেকে শুক্রবার, শনি গ্রহ থেকে শনিবার, রবি বা সূর্য দেবতা থেকে রবিবার।

বাংলা সনের প্রবর্তনের পরে বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা ঘটে। এটাও আকবরের আমলে। বলা বাহুল্য, বাংলা সন প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বে হিন্দু সৌরপঞ্জিকার আমলেও নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালিত হত। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, অনেক অনেককাল আগে থেকে এই সৌরপঞ্জিকায় বাংলার বারো মাস অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন বৈশাখের প্রথম দিনটি আসাম, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, বঙ্গ, নেপাল, উড়িষ্যা, কেরালা, মনিপুর, ত্রিপুরায় পালন করা হতো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশরূপে। কৃষিকাজ   ঋতুনির্ভর ছিল বিধায় আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে তখন এই নববর্ষ উদযাপিত হতো।

বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা ঘটার সম্ভবত অনেককাল পর চট্টগ্রামে এই নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালনের সূচনা ঘটে। পহেলা বৈশাখ পালন উপলক্ষে চট্টগ্রামে চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে জমিদার-তালুকদারদের কাছে চাষাদের খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। তখন বাংলা নববর্ষের প্রকৃত উৎসব বলতে হালখাতাকেও বুঝানো হতো। চট্টগ্রামের ব্যবসায়িরা চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে পুরনো খদ্দেরদের থেকে প্রাপ্য বা বাকি অর্থ বুঝে নিয়ে পুরনো হিসাবের খাতা বন্ধ করে পরদিন পহেলা বৈশাখে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন এবং নতুন-পুরনো খদ্দেরদের মাঝে সেদিন মিষ্টি ও অন্যান্য খাবারদ্রব্য পরিবেশন করতেন। সেদিন চট্টগ্রামের জমিদার-তালুকদার-ভূস্বামিরাও নিজ নিজ অঞ্চলের চাষা ও অধিবাসীদের মাঝে একই কাজ করতেন।

প্রাচীনকালে চট্টগ্রামে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মূল চিত্র এরকম হলেও এই নববর্ষ পালন উপলক্ষে পহেলা বৈশাখের দিনে জমিদার-তালুকদার-ভূস্বামিদের দ্বারা মেলা ও বিভিন্ন উৎসবও আয়োজিত হতো। বলেছি, চট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত এবং অঞ্চলটির    জনসাধারণ পহেলা বৈশাখ ও দিনটির উদযাপন দ্বারা দারুণ প্রভাবিত। আমাদের এই আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই তা উপলব্ধিযোগ্য। বলেছি, এই প্রভাব সত্ত্বেও প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে দিনটির উপস্থিতি খুবই কম। উক্ত মেলা ও উৎসবসমূহ সঙ্গীতমুখর কম হওয়াটাই প্রাচীনকালে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে পহেলা বৈশাখের উপস্থিতি খুবই কম হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে আধুনিকভাবে বাংলা নববর্ষ পালন আরম্ভ হয়। তখন পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হয়। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশের বিজয় কামনার উদ্দেশ্যে ছিল এই আয়োজন। পরবর্তীতে ১৩৭২ বঙ্গাব্দে, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে  ছায়ানট ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ শীর্ষক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটি গেয়ে রমনার বটমূলে, আসলে একটি পুরনো অশ্বত্থ গাছের ছায়ার নিচে উক্ত বর্ষকে বরণ করে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ছায়ানট অনেক জাঁকজমকপূর্ণভাবে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতা কিংবা সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদেই এভাবে আয়োজন করা হয়। আর এসময় থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন ব্যাপক সঙ্গীতমুখর হয়ে উঠে।

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে পহেলা বৈশাখ জাতীয় উৎসবের মতো পালিত হতে শুরু করলে, চট্টগ্রামেও তখন থেকে সেভাবে পালিত হতে থাকে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, তখন থেকে চমৎকার সঙ্গীতমুখর পরিবেশে চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হলেও তাতেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে তেমন প্রভাব পড়েনি, গীতিকারদের মাঝে এই গান রচনার মানসিকতা তেমন তৈরি হয়নি। উল্লেখ বাহুল্য, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে চট্টগ্রামের গ্রামীণ জনপদে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা প্রতিষ্ঠানে এবং চট্টগ্রাম শহরের ডিসি হিল, অভয়মিত্র ঘাট, রেলওয়ের সিআরবির শিরিষতলা, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতসহ বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চুয়েটের বৈশাখী অনুষ্ঠান খুবই চমকপ্রদ হয়। বর্তমানে চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহও পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠান করছে। এসব অনুষ্ঠানে কবিগান, গাজির গান, জারি গান, মাইজভা-ারি গান, পালাগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, আস্কর আলী প-িতের গান, সেকান্দর গাইনের গান, হাছন রাজার গান, কীর্তন, বাউল, মুরশিদি, মারফতি এবং রমেশ শীলের গানের পাশাপাশি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানও পরিবেশিত হয়। কিন্তু পহেলা বৈশাখ নিয়ে রচিত আঞ্চলিক গানের পরিবেশনা খুব একটা লক্ষ্যগোচর হয় না।

আমরা অনেক অনুসন্ধান করে পহেলা বৈশাখ নিয়ে রচিত তিনটি আঞ্চলিক গান সংগ্রহ করেছি। রচয়িতা এম এন আখতার। গানত্রয় উপস্থাপন করা যাক-

ক.

বছর ঘুরি আইস্যে আবার আইস্যে বৈশাখ মাস,

পত্তি ঘরত চ’ও  গৈ কি আনন্দ উল্লাস/ফরমাইশ

সাবধান কেয়ায় কোনদিন ন গরিবা কেয়র সর্বনাশ।

হাল খাতার দুয়া দুয়ি বড় বড় দোয়ানত,

দাওত দিয়ে বেয়াগ্ধসঢ়; গুনে যাইয়ম কোন্নানত,

রসগোল্লার ছড়াছড়ি জাম অই যার আঁর নিয়াশ।

নোয়া বছর আইস্যে বৌ-পোয়ার চিন্তা গর,

জীবন বাইসা দে এইবার শক্ত বৈঠা ধর,

মনে রাইখ্যো কাল বৈশাখ আইয়্যে যদি ঝড় তুয়ান।

খ.

আঁর বব্বু বৈশাখী হুরপরী/ফুলপরী

পান চাবাই মুখ লাল গরি

একখান বছর পরে আবার আইস্যে নাইয়রী,

ও ছকিনা ও জরিনা আগ বাড়াই ল তড়াতড়ি।

কত ছাম্মান রইস্যা মাঝি আনন্দে মাতাল,

জোরে জোরে সিঁয়া ফুঁয়ার মারের উয়া ফাল,

ফোয়ারে আইন্যে আমর ঝুড়ি

বাইল্যনিরে, খৈ লাড়ু কেলা মুড়ি।

গাছর আগাত কুইক্যা চড়ুই ফুইক্যাই চাই রইয়্যে,

আঁর বব্বু  বৈশাখীর কথা ডাকি কই গেইয়্যে,

বঁওটা উড়াই গুর গুরাই যা

কাইল্যনিরে, মানুষ লই যা তিন কুড়ি।

গ.

পয়লা বৈশাখ আইস্যে ঘরত মিডাইর পাইল্যা লই,

নাতী নাইত্যান খুশী হাতোত কেলা মোলা খৈ।

বুইজ্যা বুড়ী তঁওশা চার/হাসের দুইজন চুপ্পে বৈ বৈ।

মরা গাছত ফুল ফুইট্যে বৈশাখ মাইস্যা যাদু,

আম জাম কাট্টল ফাইক্যে খাই চও কি মধু,

ফুয়ানা ক্ষের তাজা হই যার গরের হৈ চৈ।

বাংলাদেশের বাঁলী আঁরা বারো মাইস্যা বছর,

গরি মনত এক এক ছবি দেখতে খুব সোন্দর,

বৈশাখ মাইস্যা কিস্তা আঁরা বিদেশত যাই কই।

তথ্যসূত্র :

১.ব্যক্তিগত অনুসন্ধান

২.বাংলাপিডিয়া

৩.উইকিপিডিয়া

৪.পহেলা বৈশাখের কথকতা, জামিউর রহমান রনিম, ১৩.০৪.২০১৪, বিডিনিউজ২৪.কম।
৫. মানবদরদী সুরসাধক এম এন আখতারের গান; মেসার্স পৃষ্ঠা এ্যাড, কম্পিউটার এন্ড প্রিন্টার্স, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম; ১ জানুয়ারি ২০১০।

লেখক :  কবি ও লোকগবেষক

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট