চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রিজিয়া রহমানের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

একটি ফুলের জন্য

শ্রদ্ধাঞ্জলি

রাফেয়া আবেদীন

২৩ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০০ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ত্যাগ ও গৌরবের উজ্জ্বল অধ্যায়। আমাদের সাহিত্যও সমৃদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি ও চেতনায়। সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতা রিজিয়া রহমানের [১৯৩৯-] একটি ফুলের জন্য [১৯৮৬] উপন্যাসটি এই ধারায় বিশেষ সংযোজন। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপন্ন জীবন এবং রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মৃত্যুজনিত মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন। ছোট পরিসরে রচিত এই কাহিনির মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমানের মানবিক বোধ ও রাজনীতিচেতনার স্ফুরণ লক্ষ্য করা যায়।

দুই.
একটি ফুলের জন্য উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯৮৬। এই সময়কালটি আমাদের বিবেচনার বিষয়। তখন বাংলাদেশের ক্রান্তিকাল চলছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন তৎকালীন প্রধান সামরিক প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। দুর্নীতি, গুমখুন, অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যবোধের চরমতম অবক্ষয়, লুটপাট তখন বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। এরকম একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উত্তাল সময়ে রিজিয়া রহমান একটি ফুলের জন্য উপন্যাসে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার বিপন্ন ও বিপর্যস্ত মুখচ্ছবি, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির কাছে তাদের পরাজয় এবং দেশজুড়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থানের ঘটনা তুলে ধরেছেন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়েও মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদ, আলফু, আমজাদ, মুনির, বুলু, সানু, নিয়াজ, সাবের প্রমুখের আদর্শ, আত্মজিজ্ঞাসা ও জাগরণের বয়ান তুলে ধরেছেন। তৎকালীন রাজনৈতিক টানাপড়েন ও ঘটনাপ্রবাহ এই কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সময়ের প্রতিচ্ছবি ব্যক্তিকে আলোড়িত না করে পারে না। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের এই আত্মজিজ্ঞাসা অনেকটাই সময়ের নির্মাণ। সময় এবং এই আত্মজিজ্ঞাসার ভেতরই পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রকৃতি মুক্তিযুদ্ধে সব হারানো মানুষগুলোর জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে।
একটি ফুলের জন্য উপন্যাসে বর্ণিত মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশের ভেতর দিয়ে উঠে আসা পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতিই আমরা দৃষ্টিপাত করব। কাহিনি নির্মাণে কখনো কখনো রিজিয়া রহমান অতি আবেগী, কখনো কিছু মাত্রায় রোমান্টিক, কিন্তু অসহায়, পঙ্গুত্ব বরণ করা, যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়ানো এসব মানুষের জীবন যে পরিবেশে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা লেখিকা তুলে এনেছেন তা আমাদের দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাছাড়া এই পরিবেশ ও প্রকৃতি তৎকালীন ঢাকা শহরের কঠিন ও রূঢ় বাস্তবতাকেও প্রতিনিধিত্ব করে।

তিন.
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এত দ্রুত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে যে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ রাতারাতি হয়ে ওঠে অবৈধ সম্পদের মালিক। অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী যোদ্ধা, শহীদ পরিবার, সন্তানহারা বাবা-মা এমন অসংখ্য মানুষ যারা আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্বল করে দেশ গড়ার কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছিল তারাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে অবহেলিত, অপমানিত, দঃখ-দারিদ্র্যের আঘাতে জর্জরিত। তারা হন চাকরিতে অযোগ্য, চাকরিচ্যুত, বেকার, রিকশাচালক। তাদের অনেকেরই ঠিকানা হয় আশ্রয় কেন্দ্রে, বস্তিতে। এই সূত্রে রেললাইনের পাশের বস্তি এলাকার পরিবেশ মূর্ত হয়ে উঠেছে। স্টেশনে সারাদিনরাত চলে রেলগাড়ির আনাগোনা। রাতের অন্ধকারে রেললাইনের ‘খোয়া আর নুড়ীর ওপর’ বন্দুকওয়ালারা বুটের মচমচ শব্দ করে হেঁটে বেড়ায়। যেমন মনোরম তেমনই কঠিন-সুন্দর সেই পরিবেশ :
“দুটো অতিকায় কেউটের মতো পড়ে আছে চকচকে রেললাইন। ও পাশের ঝিলে দু-একটা মাছ ঘাঁই মারে। সবুজ বদ্ধ জলাশয় থেকে পচা ভ্যাপসা গন্ধ আসে। …‘গুম গুম করে রেল গাড়ির শব্দ বেজে উঠল। ডোবার পচা গন্ধময় অন্ধকারে আলোর তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসছে গাড়িটা। …দূরে সিগনালের ডানা লাল আলো নিয়ে আনত হয়েছে। অন্ধকারে আবার ছুরি বসাল আলোর ফলা। মালগাড়ি আসছে।”
এখানে, এই রেললাইনের ধারে ঝুপড়ি ঘরে বাস করে মুক্তিযোদ্ধা আলফু। রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, একটি হাত সে হারিয়েছিল যুদ্ধের সময় গ্রেনেডের আঘাতে। রেললাইনের ধারে যে বস্তিতে আলফু থাকে সেখানকার পরিবেশ ঢাকা শহরের প্রায় সব বস্তিরই সাধারণ চিত্র :
“রেললাইনের ঢালু জমির শরীরে বিষ ফোঁড়ার মতো ফুটে আছে বাস্তুহারাদের ডেরা। অনেকে ডেরার ওপর খুঁটি গেড়ে জলটঙ্গীর মতো মাচা বেঁধেছে। এখন অন্ধকারে সেগুলো নিঃসাড়। মাঝে মাঝে ঝুপ করে শব্দ ওঠে। হুটোপুটি ডাকাডাকি কিছুক্ষণ। হয়তো নবীর সাত মাসের ভাইটা ঘুমের মধ্যে গড়িয়ে পড়েছে ডোবায়।”
শহরের একদিকে সুউচ্চ আকাশচুম্বি ভবন, অন্যদিকে রেললাইনের ধারের জমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ ডেরা। অর্থাৎ বস্তির চাইতে আরো নিচু স্তরের পরিবেশ এখানে। নিচে বদ্ধ জলাশয়, নোঙরা পানি যেখানে দূষিত হতে হতে সবুজ রং ধারণ করেছে, যেখানে বৈদ্যুতিক আলো নেই, অন্ধকারে শিশু সন্তান পানিতে পড়ে যায়। তবু জীবন সেখানে থেমে থাকে না। এমন দুর্গন্ধময় পরিবেশে বাস করে দলে দলে উদ্বাস্তু মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে একটি হাত হারানো আলফুও সেই মানুষদের দলে। এইসব ডেরা বা তথাকথিত বস্তিঘর ঘেঁষে চলাচল করে রেলগাড়ি, মালবাহি গাড়ি। এই রেললাইনেই চলে এসব বস্তিবাসীদের প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পাদন :
“ঘরে ফেরা মানুষেরা রেললাইন ধরে হেঁটে যায়। ঝুপড়ির ন্যাংটো ছেলেমেয়েরা লাইনের ওপর পেসাব-পায়খানা করতে বসে। ঝমঝম ঝমঝম শব্দ করে মাঝে মাঝে রেলগাড়ি যায়। রাতের রেলগাড়িতে আজকাল আলো থাকে না। ইঞ্জিনটা এক চোখো দৈত্যের মতো আলোর ফলায় আঁধার ছিঁড়তে ছিঁড়তে আলোহীন বগিগুলোকে টেনে নিয়ে যায়। তারপর রেললাইনের শব্দ কমে আসে।”

এসব বস্তিতে বাস করে ভূমিহীন, বাস্তুহারা মানুষেরা। মুক্তিযুদ্ধে একটি হাত হারানো আলফু, কেরামত, হারমতী তাদেরই এক-একজন প্রতিনিধি। এদের অনেকেরই চালচুলো নেই। যেমন কেরামত। চুরি করাই যার পেশা। অসুস্থ। ‘চালচুলো ছাড়া হতভাগাটা সারাদিন রেললাইনের ধারে পড়ে থাকে।’ ঝুপড়ির সামনেই মজীদের চায়ের দোকান। এখানেই ঝুপড়ির অনেকে সকালের নাস্তা সেরে নেয়। ড্রাম ফ্যাক্টরির পাশের বস্তিরও একই পরিবেশ। সেখানে থাকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সামাদের মা। যেখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। তাই রোগশোকে জীর্ণ, ক্ষুধায় কাতর বৃদ্ধাকে খাবার পানি আনতে হয় রাস্তার কল থেকে। আর বস্তির যে ঘরে তিনি থাকেন, সেটিও ভেজা স্যাঁতসেঁতে।
মুক্তিযোদ্ধা আলফুর দৃষ্টিতে ঢাকা শহরের পরিবেশ যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা, যারা থাকে আশ্রয় কেন্দ্রে। তাদের দৃষ্টিতেও ফুটে উঠেছে যেমন আশ্রয় কেন্দ্রের পরিবেশ তেমনি জানালা দিয়ে দেখা এই শহরের ব্যস্ততম সড়কের ছবি। বাড়ির পরিবেশে বিষণœ আমজাদ আশ্রয় কেন্দ্রে এসে ওঠে। এখানে থাকে মুনির, সাবের, নিয়াজ, বুলু, সানু, আলম প্রমুখ। এদের সকলেই মুক্তিযুদ্ধাহত। মুক্তিযোদ্ধাদের এই আশ্রয় কেন্দ্রের পরিবেশও বেশ মানবেতর। এখানে একটা ঘরে চারটা খাট। ‘কোনো ঘরেই আলনা নেই। যার যার কাপড় তার খাটের রেলিংয়ে থাকে।’ কোনো টেবিল নেই। একটি টিভি আছে। নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে হয়। শোনা যায় ক্রাচের খট খট আওয়াজ। বাইরের পৃথিবীর পরিবেশ তাদের চোখে ক্রমশ ধূসর। কাচঘেরা জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই তাদের বাস্তব পৃথিবী। তাই ‘বিছানায় শুয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে কাচের ব্যবধানটা বার বার অনুভব করে’ এরা। ‘আমজাদের ঘরটা একেবারে একধারে। এখান থেকে কয়েক ফুট দূরেই গতিশীল পৃথিবী তার সচলতার গর্ব নিয়ে সারাক্ষণ বয়ে চলেছে। সে জগতটাকে এ বাড়ির সবাই যেমন ঈর্ষা করে তেমনি প্রচ- একটা আকর্ষণ বোধ করে।’
ঢাকার অভিজাত এলাকার পরিবেশ একেবারেই ভিন্ন। যেমন ধানমন্ডি। সেখানে ভীষণ চুপচাপ নিরিবিলি বাড়ি। যান্ত্রিক কোলাহল নেই। চারপাশে গাছপালা। সেখানে পাখি ডাকে। ভবনগুলোতে ঝকঝকে মোজাইকের করিডোর, দেয়ালে বিশাল ওয়েলপেইটিং, ফোমের সোফা, মেঝেতে কার্পেট বিছানো। প্রধান ফটকে পাহারাদার আর জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে ঘোরে কুকুর। আর ফরহাদের ভাই আহাদের চোখে গুলশানের ঢাকাকে সিঙ্গাপুর-হংকং মনে হয়। সেখানে বাড়িতে চলে দামি ড্রিংকসের পার্টি, ভিসিআর-এ অশ্লীল সিনেমা। ফরহাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বান্ধবী নাজমার বাড়িটিই যেন সমগ্র অভিজাত ধানমন্ডির প্রতিচ্ছবি :
“নাজমার বাড়িটা ভীষণ চুপচাপ নিরিবিলি। বাইরে শীত বাতাসের মর্মর। কোথায় বুঝি একটা ঘুঘু ডাকছে। ঝকঝকে মোজাইকের করিডোর পেরিয়ে ড্রইংরুমে এল ফরহাদ।”…

চার.
প্রকৃতি একটি শহরের পরিবেশকে বাসযোগ্য রাখে। ঢাকা শহর একসময় ছিল প্রকৃতিশোভিত। কিন্তু ক্রমশ ঢাকার সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরিকল্পিত শহরায়নের ফলে হারিয়ে গেছে। একটি ফুলের জন্য উপন্যাসে আশির দশকের ঢাকার যে পটভূমি ফুটে উঠেছে, সেখানে দৃশ্যমান প্রকৃতি নিবিড় নয়। তবু যে দু-একটা চিহ্ন এখানে দৃশ্যমান তাতে ঢাকা শহরের তৎকালীন প্রকৃতির উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিবেশের রূঢ় ও কঠিন রূপের মতোই এই প্রকৃতিও কখনো বিবর্ণ, কখনো সজীবতায় স্নিগ্ধ :
“বিরাট আকাশটা একটা কালো নদী হয়ে ঝুলে থাকে। রাতের মাছ ধরা নৌকার আলোর মতো টিম টিম করে তারা। রেললাইনের ধারের দুর্গন্ধময় পরিবেশটা কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়।”
রেললাইনের ধারে জলাশয়, গড়ে ওঠা ঝুপড়ি বস্তির দুর্গন্ধ বাতাসকে দূষিত করে তোলে। এখানে যতটুকু সবুজ প্রকৃতি থাকলে একটি ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য সৃষ্টি হতে পারত তা নেই। তবু সারি সারি বস্তির মাঝে নিম বা শিরিষের গাছে পাখির কিচিমমিচির শব্দ পাওয়া যায়। কলরব করে কাকের দল। অদূরে ঝিল। চারপাশের স্তূপীকৃত ময়লা আবর্জনা যতই দুর্গন্ধ ছড়াক ভোরের বাতাসে কিছুটা স্নিগ্ধতা থাকে। যেমন রিজিয়া রহমান লিখেছেন :
“রাত শেষ প্রহরের সীমানায় পৌঁছেছে। নিমগাছে কিচিরমিচির করছে পাখির ঝাঁক। হালকা আঁধারে একটা মানুষের অবয়ব স্পষ্ট দেখা গেল।…
ভোরের বাতাসে যথেষ্ট দুর্গন্ধ থাকলেও কিছুটা স্নিগ্ধতা আছে। ঝিলের ওপারে বড় শিরিষ গাছটার মাথায় এক ঝাঁক কাক প্রভাতী কলরব ছড়াল।”
আহত মুক্তিযোদ্ধদের আশ্রয় কেন্দ্রের বাসিন্দাদের চোখেও ফুটে উঠেছে প্রকৃতিতে রোদ-বৃষ্টির খেলা। গাছ নেই, গাছ বলতে একটি শিউলি গাছের উপস্থিতি আছে আশ্রয় কেন্দ্রে। দূরে এক টুকরো সবুজ মাঠ, কাচের জানালায় বাইরে রোদ, বিকেলের রোদ ছিন্নভিন্ন করে চলে শহরের গণপরিবহন ও অন্যান্য যানবাহন, অন্ধকার আকাশে তারা জ্বল জ্বল করে- এমনই, কিছুটা বিবর্ণ, ম্লান, প্রাণহীন। এতটুকুই এই শহরের প্রকৃতি। যেমন :
“হলুদ বাড়ির ওপর বিকেলের নিরীহ নরম আলো। কাল রাতে হঠাৎ ঝড়ের ঝাপ্টা দিয়ে কিছু বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ এখন মেঘের ঠিকানা মুছে ফেলেছে। তবু সবুজ মাঠের টুকরো গত রাতের বৃষ্টির স্মৃতিতে উজ্জ্বল।… রক্তচক্ষু হাসপাতালটা পা-ুরুগীর মতো অসুস্থ রঙের বাড়িটায় সর্বক্ষণ চোখ মেলে রাখে। তবু পথের এ ধারে শিউলী গাছটায় শিউলী ফোটে। ভোরের তারুণ্যদীপ্ত ফুল ঝরে। আর লোভী রোদ তাদের সবটুকু শুভ্রতা মুছে নিয়ে পান্ডুর করে তোলে। জমাদারের ঝাড়ুর মাথায় আবর্জনা হয়ে যায় তারা।”
হৃদয়ের গভীরতর দায়বোধ ও আন্তরিক দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রিজিয়া রহমানের একটি ফুলের জন্য উপন্যাসটি। শিল্পবিচারে হয়ত উপন্যাসটি সফল নয়, কিন্তু এই কাহিনির পরতে পরতে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় মূল্যবোধ ধ্বংস করার ফলে যে আক্ষেপ, যন্ত্রণা, গ্লানি, অপরাধবোধ ঔপন্যাসিকের অন্তরে জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠেছে তারই স্বতঃস্ফূর্ত গল্প তিনি তুলে ধরেছেন। মুক্তধারা প্রকাশিত উপন্যাসটির শেষ প্রচ্ছদে রিজিয়া রহমান লিখেছেন : ‘স্মৃতিভ্রষ্ট অপরাধী/আমরা সেই জাতি/গৌরবের রক্তে/ঢেলেছি লাশের কলঙ্ক/বার বার। তাই/ক্ষমাপ্রার্থী,-/হে আমার দেশপ্রেমী/গর্বিত শোণিত,/তবু জানি সত্য অনির্বাণ।’
হৃদয়ের রক্তক্ষরণ এবং অনির্বাণ সত্যের প্রতি দায়বোধ- এখানেই এই কাহিনির গুরুত্ব। অবশ্য আমরা এই উপন্যাসের কাহিনিতে যে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের ভেতর কতিপয় মুক্তিযোদ্ধার আদর্শ লালন ও একটি আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পল্লবিত হয়েছে সেটি নয়, আমরা অনুসন্ধান করেছি তৎকালীন ঢাকা শহরের পরিবেশ ও প্রকৃতির বাস্তবতার স্বরূপ।
যদিও পরিবেশ ও প্রকৃতির স্বরূপ তুলে ধরা ঔপন্যাসিকের লক্ষ নয়, কাহিনির প্রেক্ষাপট ও পটভূমি এবং চরিত্রের মনস্তত্ত্ব শিল্পময় করে তুলতে যতটুকু প্রয়োজন এই উপন্যাসে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভূমিকা ততটুকুই। তবু আমরা পরিবেশ ও প্রকৃতির রংহীন, প্রায় বিবর্ণ, বলা চলে বৃক্ষশূন্য শহরের পটভূমির মতোই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ যেন আশির দশকের ধ্বংস হতে বসেছিল। আলফু-আমজাদের মতো অনেকেই সেই চেতনাকে জ্বালিয়ে রেখেছেন।

# সংক্ষেপিত

শেয়ার করুন