চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

নৈনিতালের দিন পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া

তৌহিদুল আলম

১৬ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪১ পূর্বাহ্ণ

মানব সমাজের সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য-শিল্পকলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সমাজে রাজনীতি, অর্থনীতির যত দ্রুত পরিবর্তন ঘটে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে তত দ্রুত হয় না। বলা চলে কবিতার বাঁকবদলের গতি আরো মন্থর। বাঁকবদলের ধারায় সামিল হয়েছেন কবি মানিক বৈরাগী। মানিক কবিতালোকে ‘গহীনে দ্রোহনীল’ কাব্যের যে বীজ বপন করেছিলেন, ‘শুভ্রতার কলঙ্ক মুখস্থ করেছি’ কাব্যে দেখি তার অঙ্কুরোদ্গম আর ‘নৈনিতালের দিন’ কাব্যে বিস্তৃত হয়েছে তার ডালপালা। প্রেম ও প্রকৃতি, নাগরিক ও রাজনীতির প্রতি তার যে আগ্রহ পূর্ববর্তী গ্রন্থে আমরা দেখেছি, এর আরও বলিষ্ঠ নিরীক্ষণ দেখি ‘নৈনিতালের দিন’ কাব্যে।
‘নৈনিতালের দিন’ মানিক বৈরাগীর তৃতীয় কবিতা গ্রন্থ। এখানে ৪টি পর্ব ভাগ আছে। মোট কবিতার সংখ্যা ৬৯টি। প্রথম পর্বের নাম ‘রোদের ভিড়ে একা’। এ পর্বে কবিতা আছে ৩০টি। মুখবন্ধ কবিতা ‘নৈনিতালের দিন’। এই নামেই কাব্যের নামকরণ।
‘নৈনিতাল’ নামের সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে মহাকাব্য ‘মহাভারত’ এর একটি পৌরাণিক রাজ্য হিসেবে। সেখানে আমরা দেখি রাজ্য গঠনের যে ইস্তেহার রাজা প্রদান করেছিলেন, তা আর বাস্তবায়ন করতে পারেননি অমাত্যবর্গের নৈতিক স্খলনের কারণে। স্বাধীনতা পরবর্তী বন্ধবন্ধু দেশ গঠনের যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তা বাস্তবায়িত না হওয়ার মূলে ছিল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও অমাত্যবর্গের নৈতিক অধঃপতন।
‘নৈনিতালের দিন’ কাব্যনামের মধ্য দিয়েই আমরা মানিকের পুরাণ মনস্কতার পরিচয় পাই। ‘নৈনিতালের দিন’ কবিতায় অনুযোগ-অভিমান-শ্লাঘার রসায়নে কবি প্রতিক্রিয়ার মার্জিত কাব্যভাষা এবং সহজ আয়াসে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন- “আমি বুঝে গেছি বহুকাল আগে/তুমি তোমরা আস তোমাদের প্রয়োজনে।”
কবিতার শেষ স্তবকে কবি ঐসব কুটিল মানুষদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মারফতি ভাষার, যাকে প্রতীকীও বলা যায়। আসলে দেহ-মন এক না হলে সত্যিকার অর্থে তাকে মানুষ বলা যায় না। এই প্রশ্নই কবি দ্ব্যর্থহীনভাবে ছুড়ে দিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে। কবির ভাষায়- “কায়া আছে ছায়া আছে/কলব গেছে কই/দেহ কলব এক না হলে/বানর গোত্র কই।”
মানিক ‘বানর গোত্র’ শব্দদ্বয় মানব জাতির প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছেন, যা আমাদের বিজ্ঞানী ডারউইনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে মানিক স্বীয় অভিজ্ঞতার যে অভিযোজন ঘটিয়েছেন, তা কবিতাকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে।
যুগে যুগে আমরা দেখেছি কবিগণ প্রেমকে বিচিত্রভাবে কবিতায় চিত্রিত করেছেন। ইরানি কবি তো প্রিয়তমার চিবুকের একটি তিলের জন্য সমরকন্দ বিলিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। মহাদেব সাহাও ছিলেন প্রেমকাতর। ‘চিঠি দিও’ কবিতায় তাকে অসম্ভব কাতরগ্রস্ত হতে দেখি প্রেয়সীর চিঠি পাওয়ার জন্য। মানিকের প্রেম উচ্ছ্বাসে তেমন হিন্দোলিত হয় না। তার মধ্যে দেখতে পাই সুশীল পরিমিতবোধের প্রকাশ। তাই আষাঢ়-শ্রাবণের ধারাজল এবং বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির সামনেও তার অধর শুকিয়ে আসে প্রিয়তমার অনুপস্থিতিতে। এই কবিতার তৃতীয় স্তবকের শব্দগুলো তাদের অঙ্গীকারের অতন্দ্র সাক্ষী বলে মনে হয়। যেমন-
“কথা ছিল মানকচু পাতার ছাতায় লুকাবো আমরা/ খালি পা, ভাঁটফুল, ঝাউবীথি, মাসির গরম পিঁয়াজু,/
মাধুরী রাখাইনের দুচোয়ানি/থুড়ি থুড়ি চিয়ার্সির পিয়ারিতে/ ঘোলাটে হবো চোখে ও মুখে”
চূড়ান্তভাবে আশায় আশায় বেড়ে উঠে কবির বিরহ, প্রেম থেকে যায় অধরা। বলা হয়ে থাকে আধুনিক কালে শিল্পের স্তব্ধতা নেই। অর্থাৎ শিল্প গতিময়। কবিতার ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। কেননা একযুগ থেকে অন্যযুগে ঘটে কবিতার প্রসার। যুগের ঘটনা পরম্পরাকে স্পর্শ করা, যুগসত্য ও প্রাণধর্মকে আবিষ্কার করা বা করবার চেষ্টা করা হচ্ছে কবির দায়িত্ব। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনীতির নামে মানুষের ওপর হিংসাত্মক নিষ্ঠুরতা ইত্যাদির প্রভাব কবি চৈতন্যে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। ফলত কবি হন যুগের সাক্ষী। ‘জ্বলন’ কবিতায় মানিক তেমন একটি যুগসত্যকে তুলে ধরেছেন। অগ্নিদগ্ধে অঙ্গার হওয়া মানুষদের তিনি তুলনা করেছেন কাঠ-কয়লার স্তূপের সাথে। তাই তিনি সখিকে সতর্ক করছেন এই বলে-
“আমি সেই বিশুদ্ধ বিসুভিয়াস/পুড়িয়ে নতুন সম্ভাবনা দিই,/মানুষ স্বপ্ন দেখে মানুষ পুড়িয়ে/কাছে এসো না, পুড়ে যাবে সখি।”
এমন রাজনৈতিক অবক্ষয়ের পরও কবি ভুলে থাকেননি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস ২৫ বৈশাখের কথা। বেলা যায় ২৫ শে বৈশাখকে উপজীব্য করে দায়িত্ববান অগ্রজ কবির নির্লিপ্ততায় মানিকের চিত্তপ্রদাহের প্রকাশ ‘রজনী ও যামিনীর আলাপন’ কবিতাটি। তাই বেদনা ভারাক্রান্ত মানিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে ওঠে-
“কবিতা মঞ্চটি এখন নীরব, ঝাউয়েরা সরব/ চা খেতে খেতে কুয়াশা মিশ্রিত বাতাসের আর্দ্রতার লোবান চুষি”
কবিতার এক অপরিহার্য প্রকরণ হচ্ছে মানুষ। কবি যেমন মানুষ, তেমনি তিনি যাদের নিয়ে ভাবেন তারাও মানুষ। মানুষ আছে বলেই প্রকৃতি সুন্দর। কবি নজরুলের কণ্ঠে ছিল মানুষের জয়গান। তিনি মানুষকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলেছেন-‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। বিষ্ণু দে মানুষকে আবিষ্কার করেছেন প্রাত্যাহিক কর্মব্যস্ততায়। ‘প্রকৃতি আমি মানুষ ভালোবাসি’ কবিতায় দেখি মানিকের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এখানে তিনি মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেন। তিনি মানুষকে ভালোবেসে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তারই সাবলীল স্বীকারোক্তি আছে এই কবিতায়। মানুষের আদর-স্নেহ, অভিনন্দন-শুভেচ্ছা পেয়েছেন বলেই তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, তার কবি হয়ে ওঠার মূলে মানুষের অবদানের কথা। যেমন-
“আমি মানুষের কোন কোন অবদান অস্বীকার করব/মানুষকে ভালোবাসি, মানুষের জন্য লড়ি।”
‘রৌদ্র করোটিতে’ আমরা শামসুর রাহমানকে রৌদ্রদগ্ধ হয়ে পুরো শহর চষে বেড়াতে দেখেছি। ‘রোদের ভিড়ে একা’ কবিতায় মানিকও প্রখর রোদের ভিড়ে শহর ঘুরে নির্মাণ করেন আত্মবিরহ পুরাণ। আজকাল ভোরের হাল্কা রোদও প্রচ- তাপদাহ ছড়ায়। তিনি বিজ্ঞানের দৃষ্টান্ত টেনে বলেন, এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল। কবির ভাষায়- “প্রচ- রোদের ভিড়ে জনজটে তবুও নিঃসঙ্গতা/ আমাকে ঘিরে নির্ঘুম চোখে পাহারা লেখা মানুষের প্রয়োজনে।”
‘নৈনিতালের দিন’ কাব্যের দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘খুন হয়ে যায় তোমার অতীত’। ৮টি কবিতা দিয়ে পর্বটি সাজানো হয়েছে। এই পর্বের প্রথম কবিতার নাম ‘পুরুষ’। আমাদের সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক। মোদ্দাকথা সারা পৃথিবীতে জারি আছে পুরুষতন্ত্র। পুরুষের স্বভাবধর্ম সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করা। নারীর ওপরও চলে তাদের আধিপত্য। সক্রেটিস বলেছিলেন- নিজেকে জান। কিন্তু আমরা ক’জন আর নিজেকে জানি ! জানলেও তা প্রকাশ করার সৎসাহস থাকে না। কিন্তু মানিক ব্যতিক্রম। ‘মনুষ্যচারী’ কবিতায় তিনি নিজেই দিলেন তার চারিত্রিক সনদ।
‘মনুষ্যচারী’ কবিতায় আমরা যে অনুশোচনা-দগ্ধ কবিকে পাই, ‘সেই সব মানুষেরা ফিরে আসে’ কবিতায় দেখি তার বিপরীত চিত্র। এখানে কবির মধ্যে জেগে ওঠে দ্রোহ ও প্রেম। কবিতাটি বেশ দীর্ঘ। দীর্ঘ কবিতার বেলায় দেখা যায় কবি যথেষ্ট সচেতন না হলে বাঁধন আলগা হয়ে যায়। কবি নজরুলের দীর্ঘ কবিতাগুলোতেও সেই সমস্যা আছে। শামসুর রহমানের অনেক দীর্ঘ কবিতা পাঠকের কাছে ক্লান্তিকর। তবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। মানিকের এই কবিতাটিও পাঠ বিচারে উত্তীর্ণ এ কথা বলা যায়।
তৃতীয় পর্বের নাম ‘মৃত্যুর গান’। এই পর্বেও ৮টি কবিতা আছে। ‘সং অব ডেথ-৩’ থেকে ‘সং অব ডেথ-৬’ শিরোনামে ৪টি কবিতা আছে। কবিতাগুলোর মূল উপজীব্য মৃত্যু চিন্তা ও স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণের অভিলাষ।
চতুর্থ পর্বের শিরোনাম ‘মঞ্চের অনল বর্ষণে’। এই পর্বে কবিতা ২৩টি। উক্ত নামের মধ্যেই মানিকের রাজনৈতিক মনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থের মলাটে ছোট্ট পরিসরে মানিকের কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনের পরিচয় আছে।
কলাকৈবল্যবাদীদের ধারণা কবিতা ও রাজনীতির অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। দুটিকে এক করতে গেলে কবিতা হয়ে পড়বে স্লোগান সর্বস্ব। বুদ্ধদেব বসুও ছিলেন কবিতায় রাজনীতির অনুপ্রেবেশে ঘোর বিরোধী। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের এই ধারণা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। আমরা দেখেছি নজরুল ও সুকান্তের মধ্যে প্রখর রাজনৈতিক চেতনা। মানিকের এই ঘরানার কবিতাগুলো বেশ সমৃদ্ধ। যেমন- ‘বিশ্বায়ন’, ‘যমজ বটবৃক্ষ’,‘পথিক’ ইত্যাদি।
শব্দ হচ্ছে কবিতার প্রধান উপাদান। ইটের ওপর ইট না বসালে যেমন ইমারত হয় না, তেমনি পরিকল্পিত শব্দ-বিন্যাস ছাড়া উৎকৃষ্ট কবিতা হয় না। আধুনিক কবিতায় যতটা না ছন্দ থাকে তার চেয়ে অধিক থাকে শব্দ বিন্যাসের কলা-কৌশল। ফরাসি কবি মালার্মে বলেছেন- শব্দ হচ্ছে বক্তব্য প্রকাশের পরিসীমা। তিনি দৈনন্দিন প্রচলিত শব্দকে কবিতার উপযোগী করে ব্যবহার করেছিলেন। মানিকও সচেতনভাবে শব্দ আহরণ করেছেন মিথ, আরবি, ফার্সি, লোকজ ও প্রতিদিনের ব্যবহার থেকে। যেমন-দুচোয়ানি, কিটকট, চিয়ার্সি, নহর, মৌতাত, ধোঁই পিঠা, কুদঙ গুহা, তাড়িখোলা, ফানা, ইশকে সুফিয়ানা, লোবান, কামোষ্ণ, গোমরাহি ইত্যাদি। কবির শব্দজ্ঞান ও ব্যবহারের দক্ষতা নিঃসন্দেহে কবিতাকে সমৃদ্ধ করে, যা আমরা এই গ্রন্থে অবলোকন করেছি। উপমা-রূপকের সাবলীল প্রয়োগ এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অনুরণনে ‘নৈনিতালের দিন’ কাব্যকে সুপাঠ্য গ্রন্থের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট