চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অনাহুত

আহমেদ মনসুর

১৬ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪১ পূর্বাহ্ণ

বহু ঘাটের পানি খেয়ে মাঝবয়সে চাকরি নিলাম একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কাজ মেলেনি তিন বছর। যতগুলো কড়ইবীচি খেয়েছি, তারচেয়ে বেশি সংখ্যক নিয়োগ পরীক্ষায় বসেছি জীবনে। মামার জোর না থাকায় চাকরি জোটেনি। অগত্যা নামমাত্র বেতনে স্থানীয় একটা ছোটখাট প্রতিষ্ঠানে কেরানির কাজ নিতে হয়েছিলো। এরপর এফার্ম থেকে ওফার্ম করতে করতে এসে জুটেছি বদিউল আলম প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড-এ। মাঝখানে বেশি আয়ের ধান্ধায় ইউনিপে টু, স্পিক এশিয়ার মতো খায় খায় কোম্পানির সাথেও কাজ করেছিলাম। ভাগ্যদেবতা সহায় হবেন কি, কুম-ক্যাপিটাল যা ছিলো সমস্ত খুয়ে পথের ভিখেরী হয়েছি। এরমধ্যে বিয়ে, এমনকি একে একে তিন সন্তানের জনকও যে কখন হয়ে গেলাম বেমালুম বুঝতেই পারিনি। নিজেকে ইদানিং কলুর বলদ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। ছাপোষা কেরানি। কপালে বউটা ভালো জুটেছিলো বলে রক্ষে। দিনান্তে পান্তা ফুরালেও তার কোন অভিযোগ থাকে না। লোকে বলে জাতের মেয়ে কালো ভালো/ নদীর পানি ঘোলা ভালো। তাই বলে ভাববেন না বউ আমার কাউয়া সুন্দরী। রূপে যেমন মাশাল্লাহ, গুণেও তেমনি বে-মেছাল।
অফিসে বেতন বাড়েনি টানা চার বছর। কোম্পানি এবার ভালো ব্যবসা করেছে বলে সবাই আশায় বুক বেঁধেছি অল্প হলেও বাড়বে। রতন সাহেব গরীবুল্লাহ শাহ্ (র.) এর মাজারে দশটা টাকাও মানত করেন। আল্লাহ যেন রহম করেন মালিকের অন্তরে। জাফর সাহেব রসিক মানুষ। নিচুলয়ে গান ধরেন- ‘আপনার দিল কি দয়া হয় না/ মালিক আপনার দিল কি দয়া হয় না।’ আমরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। কিন্তু না, এ গানের সুর মালিকের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হলো না। এইচ.আর থেকে খবর এলো ইনক্রিমেন্ট এবারও হচ্ছে না। গরীবুল্লাহ শাহ্ (র.) গরিবদের দিকে মুখ তুলে তাকাননি। এনায়েত সাহেব মা মরা এতিম ছেলেটির মতন ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে বলেন- ‘ঈশ^র এখানে নয়, থাকেন এলিট সোসাইটিতে।’ রসিকবন্ধু জাফর সাহেব বলেন- ‘আমরা বোধহয় গরিবের কাতারে পড়ি না, গরীবুল্লাহ শাহ্ (র.) তাই মুখ তোলেননি। আগামীবার মানত করতে হবে মিসকিন শাহ্ (র.) এর মাজারে।’ যথারীতি হাসির ফোয়ারা ফোটে।
আজ সবার শেষে অফিসে আসেন মকবুল সাহেব। প্রতিদিন সবার আগে আসায় তার নাম থাকায় রীতিমত হতবাক হলাম সকলে। দেরির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘গতরাতে দীর্ঘ এক স্বপ্নে ডুবেছিলাম, ঘুম ভেঙেছে দেরিতে।’ জাফর সাহেবের মুখে কথা প্রস্তুত- ‘স্বপ্নটা নির্দোষ ছিলো তো?’ সাতসকালে সকলে হো হো করে হেসে উঠি। মকবুল সাহেব চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলেন- ‘একেবারে দোষহীন বলি কি করে, তবে জাফর সাহেব যে দোষ বুঝাতে চান সেরকম কিছু নয়।’
পকেট গড়ের মাঠ হলেও, মাসের শেষ দিকে টান পড়লেও, তথা টানতে গিয়ে ছিঁড়ে গেলেও আমাদের বাঁধভাঙা উল্লাস দেখে কে বলবে সুখে নেই। আমাদের মধ্যে দার্শনিক টাইপ মানুষ কায়সার সাহেব। মাঝেমধ্যে কবিতা-টবিতাও লেখেন। সুযোগ পেলে দর্শনের ঝাঁপি খুলে বসেন বলে সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলতে পারলেই বাঁচে। আমায় সেদিন কাছে ডেকে বলেন- ‘জিবরান সাহেব, আসার সময় কি এনেছিলেন সঙ্গে করে? আনেননি, বিবস্ত্র এসেছিলেন। এখন তো মাশাল্লাহ কত সুন্দর জামা কাপড় পড়ে আছেন। পৃথিবীর জন্য কিছু আনেননি, অথচ সে আপনাকে অনেককিছু দিয়েছে। বেঁচে যে আছেন, সে কম কি! যেকোন কিছু সরাসরি ভোগ করতে না পারেন, দিল খুলে উপভোগ করুন। চোখ মেললেই অনন্ত আকাশ দেখতে পান, তেপান্তেরের মাঠ দেখতে পান, সবুজে আচ্ছাদিত অরণ্য দেখতে পান, নদীর ধারে দাঁড়িয়ে খোলা হাওয়া খেতে পান।’ মনে মনে বলি- ‘তোর মু-ু দেখতে পাই সালা; বাকিসব বাদ দিয়ে শুধু আকাশটা দেখতে চাইলে তাকাতে হয় ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে, চোখ মাথার তালুতে তুলে।’
সরাসরি কিছু বলে নতুন করে হাজারো তথ্য ও তত্ত্বের সমুখে দাঁড়িয়ে পড়ার মতো ঝুঁকি নেবো ততটা হাধারাম অন্তত আমি নই। ‘আচ্ছা এখন আসি, আজকের আকাশটা অনেক সুন্দর, একটু দেখি গিয়ে।’ এ বলে মানে মানে কেটে পড়ি।
মধ্যবিত্ত মানুষেরা দুঃখ ভুলে হাসতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মে থাকে, নাকি এ আশ্চর্যজনক অলৌকিক ক্ষমতাটি আমাদের বহুল সাধনায় অর্জিত সম্পত্তি? সে প্রশ্ন থাক। ভোগবাদী সমাজে দিনে দিনে সবকিছুই পণ্য হয়ে উঠে। আলো পণ্য, বায়ু পণ্য, আরো পণ্য পানি/ কাঁন্দে বগা দিবারাতি টানতে গিয়ে গ্লানি। এরপরও আমরা আনন্দে মাতি, প্রাণ খুলে হাসি।
আমি একটু মুখচোরা স্বভাবের হলেও কৌতূহল বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারি না। মকবুল সাহেবকে তাই বলি- ‘স্বপ্নে কি দেখলেন বললেন না তো মকবুল ভাই।’ হেলান দিয়ে মকবুল সাহেব আয়েশ করে বসেন প্রথমে, তারপর বলেন- ‘দেখলাম পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে নিক্ষেপ করলেন অন্ধকার কারা প্রকোষ্টে।’ এ শুনে মুহূর্তেই সকলের চক্ষু চড়কগাছ। স্বাভাবিক চপলতা উবে গেলো কর্পুুরের মতো। সকলের দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হলো মকবুল সাহেবের ওপর। সমস্বরে বলে উঠি- ‘আমাদের অপরাধ?’ মকবুল সাহেব বলেন- ‘রাঘববোয়াল তো হতে পারিনি যে পুকুর চুরি করেও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবো, চুনোপুটিদের লঘু অপরাধেও ভোগ করতে হয় গুরুদ-।’ জাফর সাহেবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ‘আরে ভাই, মালঞ্চের জিলাপির মতো কথারে না প্যাঁচিয়ে পরিষ্কার করে বলুন তো ব্যাপারটা কী?
আমার দিকে তীর্যক দৃষ্টি ফেলে মকবুল সাহেব বলেন- ‘বুদ্ধিটা ছিলো জিবরান সাহেবেরই। দিনে দুই বেলা করে ৩০ দিনে আমাদের খেতে হয় ৬০ বেলা। তা যদি মুফতে খাওয়া যায় খরচের চাপ কিছুটা হলেও কমে। চট্টগ্রাম শহরে অনেকগুলো কমিউনিটি হল। বিয়ে, গায়ে হলুদ, মেজবান, জেয়াফত, কুলখানি এসব তো লেগেই থাকে সবসময়। আমাদের কাজ হলো খবর নিয়ে খেয়ে আসা। শুরুতে কম-বেশি সবার আপত্তি থাকলেও পরে রাজি হয়ে যাই। যে কথা সে কাজ। দল বেঁধে খেয়ে আসি, আজ এখানে তো কাল ওখানে।
শুক্র-শনিবার আর সনাতনী ভাইদের বিয়ের লগ্নের দিন খাবারের মহোৎসব চলে। গোল টেবিল বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন ক্লাবে খাবো। যে ক্লাবের বাবুর্চির রান্নার হাত যশ ভালো আর অনুষ্ঠানটা থাকে পয়সাওয়ালা লোকের সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয় সে ক্লাবটি। প্রায় সময় রবি থেকে বৃহস্পতিবার কমিউনিটি হলগুলোতে বসে ভূতেদের আড্ডা। যেন নিষ্ফলা মাঠ। চিরুনি অভিযান চালিয়ে বের করতে হয় খাবারের মঞ্জিল।
দীর্ঘ আট মাসে এ লাইনে আমাদের অম্লমধুর অভিজ্ঞতা অল্প নয়। আমাদের মতো সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় না হলেও ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক ছাত্র আর ছাপোষা লোকজনও একাজে ন্যস্ত। খাবারের টেবিলে বসা লোকদের চেহেরা দেখেই আমরা বলে দিতে পারি কোন লোকটি দাওয়াতি আর কে অনাহুত। তবে আমরা তা কখনও করি না। কথায় আছে না- ‘চোরে চোরে খানাতো ভাই।’ নিজেরা যেখানে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মনে মনে সর্বদা কুলহু আল্লাহ পড়তে থাকি অবিরত সেখানে পরের ছিদ্রান্বেষণে সময় ব্যয় করবো তা হয় কি করে?
ধরা পড়তে পড়তে বেঁচেছি অসংখ্যবার। তবে কথায় আছে- ‘চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন।’ দিনটা ছিলো মঙ্গলবার। জাফর সাহেব মজা করে বলেছিলেন- ‘একি উরকা বলা! শনির দশা মঙ্গলবারে।’ কনের বাপ পুলিশের জাদরেল অফিসার পড়ে যাবে কে জানতো! রাশি খারাপ হলে জল ত্যাগে বসে মল ত্যাগ করার মতো অবস্থা। তাঁর কাছে নাকি খবর ছিলো- সংঘবদ্ধ একটি চক্র বিনা দাওয়াতে খেয়ে কনের বাপদের মুছিবতে ফেলে রেখে যাচ্ছে প্রতিদিন। সৈন্য-সামন্ত সমবিব্যহারে অনেকবার অভিযান চালিয়েও কোন কিনারা করতে পারেননি তিনি। নিজের মেয়ের বিয়েতে তাই তক্ষে তক্ষে ছিলেন।
শুরু থেকেই আমাদের উপর তাঁর যে কড়া নজরদারী ছিলো আমরা লক্ষ করিনি। চোখের ইশারায় জিবরান সাহেব যেই খেতে বসে যাওয়ার হুকুম জারি করলেন কনের বাপ এসে চীনের মহাপ্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে যান সমুখে। রিমান্ডে নেয়া খুনের আসামিকে যেভাবে ইলেক্ট্রিক শক দিতে দিতে প্রশ্ন করেন আমাদের দিকের ছুঁড়ে দিলেন তেমনি এক প্রাণঘাতী তীর। এ যেন বুকের মধ্যখান দিয়ে প্রবেশ করে এফোড়-ওফোড় করে বেরিয়ে গেলো পিটের দিক দিয়ে।
-‘আপনারা কোন পক্ষের লোক?’
জবাব দেবো কি, মুহূর্তে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাথায় বাজ পড়লো যেন। আমরা থতমত বনে যাওয়া একদল মানুষ ওই বেটার সামনে কাতলা মাছের মতো খাবি খেতে থাকি আর শত চেষ্টা করেও হাত-পায়ের কাঁপুনি থামাতে ব্যর্থ হই। কোথায় গেলো দীর্ঘদিনের ফাউ খাওয়ার অভিজ্ঞতা? ধরা খেতে খেতে রক্ষা পাওয়ার রপ্ত করা গোপন রহস্যের দম্ভও বা উড়ে গেলো কোখায়? লজ্জায় অপমানে ইচ্ছে করছে মাথার সমস্ত চুল টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। জাফর সাহেবের প্রথম ছোঁত ফেরে। অস্ফুট স্বরে জবাব দেন- ‘আমরা কনে পক্ষের লোক।’ ওই লোক বিলম্ব না করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন- ‘কনের কী নাম?’ জাফর সাহেব একটা ঢোক গিলে খানিকক্ষণ আমতা আমতা করে বলেন, ‘কনের নাম কার্ডেই তো ছিলো, কি যেন নাম! দেখুন, আমরা কনের বাবার কলিগ। তার দাওয়াতেই তো এসেছি।’
এবার দারোগা বাবুর মনের আকাশের সমস্ত সন্দেহের মেঘ দূরীভূত হয়ে গেলো। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যে, আমরাই সে চক্রটি, যার সন্ধানে মহামূল্যবান সময় ব্যয় করে দীর্ঘদিন শহরময় ঘুরেছেন হন্য হয়ে। তার মুখম-লে রাজ্য জয়ের আনন্দ। তিনি ইশারা করতেই এদিক ওদিক থেকে একদল সাদা পোশাকের পুলিশ এসে ঘিরে ফেললো আমাদের। সবাইকে একরশিতে বেঁধে তুলে ফেললো পুলিশ ভ্যানে। বিয়ে বাড়ির লোকজন আমাদের দিকে এমন শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন আমরা খুনের আসামি কিংবা ঘুষখোর কিংবা ঋণখেলাপি কিংবা ডাকাতি কিংবা ধর্ষণ মামলার দাগী আসামি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট