চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

শহীদ কাদরী

বৃষ্টিস্নাত পঙ্ক্তির দিকে তাকিয়ে

কুমার দীপ

২ আগস্ট, ২০১৯ | ১:৪২ পূর্বাহ্ণ

অতঃপর শহীদ কাদরীও চলে গেলেন। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের মহতীবৃন্দের মৃত্যুমাস আগস্টেই! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, নীহাররঞ্জন রায়, হুমায়ুন কবির, সিকান্দার আবু জাফর, হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান, তারেক মাসুদ প্রমুখের মতো বিখ্যাত বাঙালি প্রতিভাদের পর কবি শহীদ কাদরীও যুক্ত হলেন আগস্টের সমাধিবেদিতে। ২৮ আগস্ট ২০১৬ খিস্টাব্দে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের একটি হাসপাতালে তিনি মারা গেলেন। অবশ্য কাদরীর জন্মও এই আগস্টেই। ১৪ আগস্ট ১৯৪২ সালে কলকাতায়। সেই যে ১৯৭৮-এ দেশ ছেড়েছেন, প্রবাসকে নিজের বাস করে নিয়েছেন, সেই প্রবাসেই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। দেশে ফেরার আকাক্সক্ষা ছিলো। নানা প্রতিকূলতায় পারেননি। এ নিয়ে আক্ষেপ ও অভিমান ছিলো। মাঝে-মধ্যে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন কিছুটা। কিন্তু দেশকে ভালোবাসার কথা কখনও ভোলেননি। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধির চেতনার প্রতি অগাধ আস্থাশীল এই কবি প্রবাসে বসেই দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ব্যক্ত করেছেন সব সময়। প্রবাস-জীবনের যন্ত্রণাখচিত শেষ প্রকাশিত কাব্য আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও-এর পাতায় পাতায় প্রবাসের বেদনার পাশাপাশি স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির প্রতি অশেষ ভালোবাসা। ভাবলে অবাক হতে হয়, এত বছর আমেরিকার মতো উন্নত দেশে থেকেও সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি! দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকেই তিনি অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে এলেন, কিন্তু প্রাণহীন হয়ে। এই প্রাণহীন রাজকীয় ফিরে আশাটা জন্মভূমির প্রতি প্রগাঢ় প্রেমকে তুলে ধরে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বিকারত্বের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্র্রতিবাদও।
শহীদ কাদরী একেবারে শৈশবেই নাটক ও কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন। প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘পরিক্রমা’ ছাপা হয়েছিলো স্পন্দন নামে একটি পত্রিকায়। আর রচনাক্রমের দিক থেকে পাঁচ নম্বর, ‘এই শীতে’ নামক কবিতাটি ছাপা হয়েছিলো সে যুগের বিখ্যাত পত্রিকা ‘কবিতা’-য়। অগ্রজ কবি শামসুর রাহমান নিজের হাতে কবিতাটি কপি করে বুদ্ধদেব বসুর কাছে পাঠিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কবি হিসেবে প্রথম পদক্ষেপেই শামসুর রাহমানের মতো বড়ো কবির সাহাচর্য পেয়েছিলেন শহীদ কাদরী। আল মাহমুদ, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, ফজল শাহাবুদ্দিনসহ আরও অনেক সমসাময়িক অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকদের নিকট থেকে সমীহ আদায় করে নেওয়া শহীদ কাদরীর কবিতা দৃঢ় নাগরিকচেতনা ও গভীর প্রগতিশীলতাকে ধারণ করে সম্মুখবর্তী হয়েছে।
শহীদ কাদরী কবি হিসেবে বিরলপ্রজ। বাংলাদেশের যে কোনো কবি, অল্পকবি কিংবা অকবির তুলনায় তাঁর কবিতা ও কাব্যসংখ্যা শোচনীয়ভাবে অল্প। কবিতার সংখ্যাগত দিক থেকে কেবল তিরিশোত্তরকালের অন্যতম প্রধান কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সাথেই তাঁর তুলনা চলে। ১৯৬৭ সালে প্রথম কাব্য উত্তরাধিকার প্রকাশের সাত বছর পর ১৯৭৪ সালে ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’; পাঁচ বছর পর তৃতীয় কাব্য ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’; এর তিন দশকেরও বেশি সময় পরে ২০০৯-এ মার্কিন প্রবাসে অবস্থানকালে প্রকাশিত হলো ‘আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও’। কাব্য প্রকাশে এমন দীর্ঘ বিরতি যে তুলনারহিত প্রায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও কাব্যের শেষ কবিতা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় কাদরী লিখেছিলেন :
আমার মতন ভ্রাম্যমাণ এক বিহ্বল মানুষ
ঘরের দিকেই
ফিরতে চাইবে
হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে সুস্থ
সহজ এবং স্বাভাবিক।
আমার নিজস্ব ঘরে প্রতিষ্ঠিত হব বলেই
আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়েছিলাম একদা
আমার আজন্ম-চেনা গৃহচ্ছায়া থেকে-
আমার প্রথম কৈশোরের রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভোরে।
কিন্তু তিন তিনটে মহাদেশ ঘোরা শহীদ কাদরীর পক্ষে ‘প্রথম কৈশোরের রৌদ্রকরোজ্জ্বল’ সে ভোর আর দেখা হলো না। প্রবাসের নানা ঘর ঘুরে ঘুরে পরগৃহেই চিরবাসী হলেন। মানসিক অতৃপ্তির পাশাপাশি দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভোগার পরে বিদায় নিলেন নশ্বর এই জগৎ থেকে। বলা ভালো, নিয়মিতভাবেই তিনি যে উন্নতমানের ডায়ালিসিস সুবিধা পেতেন, তা স্বদেশে ওভাবে সম্ভব হতো কি না সে সন্দেহও হতে পারে।
কবিতায় শহীদ কাদরী অনিন্দ্য নান্দনিকতার ভাষাচিত্রী। উপমা-চিত্রকল্পের অসামান্যতা তাঁর কবিতার একটি বিশেষ গুণ। গদ্য কথোপকথনের ঢঙেও তিনি ছন্দ-অলঙ্কারাদির নান্দনিক ব্যবহার করেছেন। নাগরিক কবি হলেও নিসর্গের উপাকরণগুলো অবহেলিত থাকেনি তাঁর কবিতায়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অপূর্ব চিত্রকল্পঋদ্ধ পঙ্ক্তিগুচ্ছরূপে ধরা দিয়েছে পাঠকের কাছে। চর্মচক্ষের বাইরে মানসচক্ষে যে অপরূপ সৌন্দর্য দোলা দেয় তার অপূর্ব রূপায়ণ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। প্রথম কাব্যের প্রথম কবিতা ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’র দিকে তাকালেই একজন আনকোরা পাঠকেরও অনুমান হয়ে যায়, কী অপূর্ব সৌন্দর্যাভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে তার জন্যে। শহরের বুকে হঠাৎ বৃষ্টি নেমে এলে, বিদ্যুৎ চমকালে বা বজ্রপাত হলে যে চিত্র তৈরি হয় তার অনুপম উপাখ্যান। অনিন্দ্য সব উপমা-চিত্রকল্পে ঠাসা কবিতাখানিতে দেখা যায় সন্ধ্যায় সহসা সন্ত্রাসে আক্রান্ত মানুষের মতো বৃষ্টি আক্রান্ত মানুষগুলো, কবির ভাষায় ‘ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মতো দৌড়াচ্ছে’। এমন সময় সবাইকে ঘাবড়ে দিয়ে চমকে বিদ্যুৎ। কবির কলমে চিত্রায়িত হলো ভয়ঙ্করের নান্দনিক চিত্রকল্প :
সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে
বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম!
লক্ষ লেদ মেশিনের শব্দ সৃষ্টিকারী এই বজ্রের আবির্ভাব, মেঘ, জল, হাওয়া সবকিছু মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে বিপদগ্রস্ত হয় ঘর-দোর, ডানা মেলে দিতে চায় জানালা কপাট, শহরের প্রাচীন বাড়িটি যে টিরোনসিরসের মতোন নড়ে ওঠে! আর জল! ‘বিমর্ষ স্মৃতির ভার নিয়ে সহর্ষে সদলবলে/বয়ে চলে জল পৌরসমিতির মিছিলের মতো নর্দমার ফোয়ারার দিকে’। বৃষ্টির জলের বয়ে চলা দেখেছি আমরাও, এমন মিছিলের মতো অনুভব করেছি ক’জন? আর সেই জলে, সিগারেট টিন, ভাঙা কাচ, সন্ধ্যার পত্রিকা, রঙিন বেলুন…ইত্যাদি ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো! বৃষ্টিজলের চিত্র শেষ পর্যন্ত নৈঃসঙ্গ চেতনায় এসে মোড় নেয়।
এইক্ষণে আঁধার শহরে প্রভু, বর্ষায়, বিদ্যুতে
নগ্নপায়ে ছেঁড়া পাৎলুনে একাকী
হাওয়ায় পালের মতো শার্টের ভেতরে
ঝকঝকে, সদ্য, নতুন নৌকোর মতো একমাত্র আমি,
আমার নিঃসঙ্গে তথা বিপর্যস্ত রক্তেমাংসে
নূহের উদ্দাম রাগী গরগরে লাল আত্মা জ্বলে
কিন্তু সাড়া নেই জনপ্রাণীর অথচ
জলোচ্ছ্বাসে নিঃশ্বাসের স্বর, বাতাসে চিৎকার,
কোন আগ্রহে সম্পন্ন হয়ে, কোন শহরের দিকে
জলের আহ্লাদে আমি একা ভেসে যাবো?
কাদরীর কবিতায় বৃষ্টির ছবি মেলে বার বার; ভিন্ন ভিন্ন রূপে। ‘ভরা বর্ষায় : একজন লোক’ কবিতায় বৃষ্টি তার লম্বা আঙুল দিয়ে একজন লোককে হাতড়ে দেখে- ‘লম্বা লম্বা সরু বৃষ্টির আঙুল লোকটাকে হাতড়ে দেখেছে/তার জ্বলজ্বলে জামা শপশপে ভেজা। তার স্বপ্নের দেয়ালে হলদে স্যাঁতসেতে চিত্র আঁকে। কিন্তু এখানেও শেষাবধি নৈঃসঙ্গ চেতনা আর মৃত্যুভাবনা উপস্থিত হয়েছে অনুভনীয় চিত্রকল্পনায় !
লোকটা আরেকটু সরে বসলো জানালার কাছে,
আর তার মার্বেলের মতো ঠা-া নিরেট চোখে ঔৎসুক্য
একজোড়া রাঙা মাছের মতো হঠাৎ নড়ে উঠলো :
দূর একটি ম্যানসনে, গাড়ি বারান্দায়
হল্লামুখর জনতার অংশ গল্পগুজবে ভরা
এই রাত্রিতে, যখন আকাশ মেঘার্দ্র, দুর্মুখ আর নিচু,
উৎসবের নাগরদোলায় অন্তহীন মানুষের ওঠা-নামা
শাদা-শাদা নিষ্করুণ বিষণœ, ঠা-া, মরা জামা!
আর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র ‘ছুরি’ কবিতায় কবি বলেন, ‘জলও আপন স্রোতের ভেতর লক্ষ কোটি বর্শা পোষে’। সেখানে দ্যাখা যায়, ‘বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে/তীক্ষè কালো ছুরির মতো চতুর্দিকে বৃষ্টি পড়ে’। এই বৃষ্টিই আবার অগ্নিময় হয়ে ধরা দিয়েছে কোনো কোনো পঙ্ক্তিতে- ‘অগ্নিময় বৃষ্টিতে তুমি হিম, সোনালি ছুরি প্রিয়তমা !’ (এই সব অক্ষর)। ইতিবাচক-নেতিবাচক যে অনুভূতিই প্রকাশ করুক না ক্যানো, বৃষ্টি যে শহীদ কাদরীর প্রিয় একটি বিষয় তা বিভিন্ন কবিতাতেই বোঝা যায়। ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ কাব্যের ‘আজ সারাদিন’ কবিতাতে বৃষ্টিভেজা একটি কালো কাক কবিকে অপরাধীর ভাবনা দিলেও ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ কাব্যের ‘প্রবাসের পঙ্ক্তিমালা’ নামক কবিতায় সেই বৃষ্টিরই প্রসূতি মেঘকে আহ্বান জানিয়েছেন গভীর মমতায় :
হে মেঘ! হে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। তুমিও ঠকাবে নাকি
হে নিরুদ্দেশগামী?
কাউকে বিশ্বাস নেই আর এই বিরূপ বিদেশে।
তবু বলি : যদি পারো,
হে নন্দিত মেঘ তুমি নেমে এসো
ঘন ও নিবিড় হয়ে, করুণা ধারায় নেমে এসো
শ্রাবণে শ্রাবণে তুমি, হে বন্ধু স্পন্দিত করে দাও
এই অফুরান পরবাস।
মেঘ-বৃষ্টি আছে আরও দু-একটি কবিতায়। কিন্তু সেকথা বলবার জন্যে এই গদ্যে হাত রাখিনি। প্রিয় কবির জন্যে শোকাহত হয়েই কবির বৃষ্টিস্নাত পঙ্ক্তিগুচ্ছের দিকে চোখ রাখতে চেয়েছি। কাগজে-কলমে শরৎ শুরু হলেও এখনও আকাশে বর্ষার মেঘই ভেসে বেড়াচ্ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছেও মাঝে মাঝে। এরই মধ্যে আমাদের হৃদয়ের সবুজ উপত্যকাকে সিক্ত করে দিয়ে গেলেন শহীদ কাদরী। আগস্টের অগস্ত্যযাত্রার ভিড়ে তিনিও শরিক হলেন। রক্তমাংসের শরীর থেকে তিনি বিদায় নিলেও কবিতাশরীরে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তিনি যে দেশকে প্রিয়তমা জ্ঞানে অভিবাদন জানিয়েছেন, সেই দেশের মানুষও তাঁকে অভিবাদন জানাবেন অমূল্য সব পঙ্ক্তির জন্যে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট