চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

কবি জিললুরর রহমানের আত্মজার প্রতি কবিতার পাঠক্রিয়া

ইকবাল আহমেদ খান

২ আগস্ট, ২০১৯ | ১:৪২ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীব্যাপী কবিতার পাঠকের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। কবিতা যদি দীর্ঘ হয় তবে বিষয়টা কবির জন্য আরও দুঃচিন্তার। কারণ, শুধু পাঠক কেন? কবিরাও দারুন অসহিষ্ণু দীর্ঘ কবিতা পাঠনে-লিখনে। একটি মাত্র কবিতা নিয়ে কবিতার বই।
জীবন যন্ত্রণায় মানুষের অবস্থা অথৈবচ। রোমান্টিক কিংবা প্রেমের দীর্ঘ কবিতায় মানুষ পেলেও পেতে পারতো যন্ত্রণা লাঘবের পরিসর। কিন্তু কবি জিললুর রহমানর কবিতা ‘আত্মজার প্রতি’ পাঠকদের মোটও সে দিকে ধাবিত করবে না।
নিজের ওপর ভর করবে স্পেস শিপ, সময় ঘড়ির বিপরীত আপনার যাত্রা শুরু হবে, আধুনিক মানুষের যে সব নতুন নতুন সংকট, তার আদি উৎস খুঁজতে খুঁজতে নিয়ে যাবে বিশ্ব ব্রহ্মা- সৃষ্টির শুরুর দিকে। যেখানে বিজ্ঞান, পুরান একেকার হয়ে এমন এক জগৎ হাজির করাবে যখন ‘এক মহাসময়ের আঙিনায় ঈশ্বরের সুনিদ্রার কালে’
মানব সভ্যতার নানা বাঁকে বাঁকে আপনাকে নিয়ে গিয়ে ফেলবে এবং আপনাকে বের হয়ে আসতে হবে নিজ যোগ্যতাবলে পরবর্তী ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে। তা নাহলে আপনি হারিয়ে যাবেন মানব সভ্যতার পরিত্যক্ত কোনো শহরের অন্ধকার গলিতে। বিশ্বের আদি অবস্থা, সভ্যতার উত্থান, কিংবা উপকথার বলাচ্ছলে কিংবা তৃতীয় বিশ্বের কোন পোড়খাওয়া চরিত্রের ওপর ভর করে বলবেন- আমি কী তৃতীয় বিশ্বের চালচুলোহীন কোনো হাড্ডিখিজির/হেঁটে যাচ্ছি বলাকার ডাহুকের সাথে পুদিনার ঘ্রাণে/ঘোর পূর্ণিমায় এমনকি ভূমধ্য-দিবসে/ইথিওপিয়ায় সুদানে সিরিয়ায় লেবাননে রণে কিংবা বনে/আমাদের আদিগন্ত রোদের আস্তিন ধরে/ঘুরে ফিরে বেড়াবার অসমাপ্য দিবস যাপনে
আমরা ফিরে তাকাই, কি বলতে চান কবি ? কেন এতো রক্ত ক্ষরণ? বুঝা যায় না। আতসী কাঁচ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে মানব সভ্যতার সে মহান চরিত্র নারী আর তার রূপমুগ্ধ পুরুষ অথবা কামান্ধ পুরুষ। নারীর সৌন্দের্যে সবাই মাতোয়ারা, মানব, দেবতা, কেউ তার বাইরে নয়। মুখোশের অন্তরালে খলনায়ক। সংঘাত অবধারিত। ভুলুণ্ঠিত তার সম্ভ্রম মান মর্যাদা। বীরভোগ্য নারীর অন্তরক্ষরণ গুমরে মরছে পাষাণপুরীতে। তারপরেও সে প্রেমে আর উৎপাদনে জাগিয়ে রাখে অমিত সম্ভবনা- এশিয়ায় আফ্রিকায়, গ্রিসে ও ট্রোজান হৃদয়ে/
প্রেম ও ফ্যাসাদ তারা একাকার করে রাখে/সকল প্রেমের বিন্দু জন্ম দেয় দামামার নতুন কুচকাওয়াজ।
আমরা জানি না মানুষ কতকাল ধরে চাঁদ, সূর্য, ফল, ফুলের আরাধনা নিবদ্ধ ছিল, আরো পরে আসেরিও, সুমেরীয়, মায়া, কিংবা, এজটাক সভ্যতার চরম শিখরে নারী কতটুকু আদৃত ছিল কিংবা প্যাগানরা কতটুকু দিয়েছিলো তার প্রাপ্য সম্মান? সে প্রশ্ন গবেষকের, কবি বা কবিতার নয়- আসমান থেকে ঝর ঝর করে গায়েবী কিতাব নেমে আসে/কিতাবের ভাষাগুলো মানুষের-মানুষীর-ফলেদের-প্রাণীদের নয়/মেঘমন্দ্র স্বরে গায়েবী বয়ান যেন কোন সুদূরের পার থেকে আসে/আমাদের চলাতে বলাতে তারা স্বর্ণময় রজ্জু টেনে ধরে।
কিন্তু কেতাবি ধর্মের ইতিহাসও বেশি দিনের নয়। এখানে মানুষের জীবন অনেক শৃঙ্খলিত, প্রণালীবদ্ধ। নানান পয়গাম্বরের কিতাব নানা ভাষায়, মানুষের হাতে পৌঁছায়। ঊর্ধ্বলোক হতে নেমে আসা বাণী মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, বা কম্যুনিকেশন গ্যাপ । এই সুযোগে মনপছন্দ ব্যাখ্যাদেয় তেঁতুল হুজুরেরা সাথে জুটে যায় তার চেয়ে চতুর সব নেতা, উপ-নেতা। এই সব কালে পুরুষতন্ত্রের চরম বিকাশ। নারী উপেক্ষিত। বেড়ি পড়ে নারীর মননে মগজেও।
সেলফে রাখা ইতিহাসের বইয়ের পাতায় যখন চোখ রাখি, মহেঞ্জোদারো কিংবা আলেকজান্দ্রিয়ায় মেসোপটেমিয়ায়, পারস্য, কিংবা ভারতে যারা পুড়িয়েছিলো জ্ঞানের ভা-ার,নদীর জল প্রবাহ স্থবির হয়ে পড়েছিল কাগজের কিতাবে কিতাবে, নরহত্যা আগুনে, জনপদ হয়ে পড়েছিল মানব শূন্য তখন কবির কাছে প্রশ্ন রাখি, তার সব দায় কি শুধু কিতাবীদের ? এট্টিলা ,আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস,অশোক কিংবা সুলতান মাহমুদ এরাতো কিতাবের ধারক বাহক নয়। তবে এটা ইতিহাসের প্রশ্ন, কবিতার নয়। কবিরা ইতিহাস রচনা করনে না, খুঁজে বেড়ান ইতিহাসের পিছনের প্রাণের স্পন্দন। যেমন-কিতাবের পৃষ্ঠাগুলো প্রতিদিন নতুন মাত্রায়/নতুন শব্দে যেন অলংকৃত হয়ে/নতুন ঝংকার তোলে বাউল বাতাসে/কখনো সে দেখে না কী রোদের কিনার/শিশিরের গায়ে রোদ কী ঝলকানি দেয়/কী আনন্দে ভেসে বেড়ায় নদীর দুধার কাশবন জামরুলের ডাল/কেবল প্রেমের নামে খুলে যায় আসমানের হাজারো কবাট
ইতিহাসের নানা পর্বে মানুষ জীবনধারণের নানা উপায়, হাতিয়ার আবিষ্ককার করে, জীবনের মৌলিক ক্ষুধা মিটিয়ে স্বস্তি খুঁজে দ্রাক্ষা রসে মজে। নাচ, গান, ছবি এঁকে রাখতে ভালোলাগে। পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে শান্তিকামী মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কোথাও কোথাও সাম্যবাদের দামামা বেজে ওঠে। সাম্যবাদের গান তাদের উদ্বেলিত করে, এই বুঝি ঘটেগেল ফসলের সুষম বণ্টন। এখানেও হানা দেয় কুশলী শকুন, এখন আর তরবারি অথবা বারুদ নয়, মগজের কূটচালে ভেস্তে পড়ে শান্তিকামী মানুষের আশা ভরসা। মানবতাবাদী কবিরাতো হতাশ হবেন- সাম্যের শ্রমিক মন্ত্র যে-কদিন আলোয় আলোয় ছড়িয়েছে সোনা/সে কদিন পৃথিবীর মানুষেরা মঙ্গলে আনন্দে ছিলো/তারপরে একদিন বর্গীদের দখলে ফের চলে যায়/সোনালী সে শস্য ফলে মাঠে মাঠে শনির আছরে/
আবারো নির্বাসনে যেন পৃথিবীর দখিনের আলো
‘ভলগা থেকে গঙ্গা’ হয়ে কর্ণফুলির বন্ধুর পথে কোথাও শান্তি নেই। এই যে আমাদের নরম পলিমাটির বদ্বীপ, এখানেও অশান্তি হানা দিয়েছে তার সারা পথ পরিক্রমায়। অথচ আমরা কতো শান্তি প্রিয়। হানা দেয়নি কখনো কারো বাসভূমে, কারো ধানে ভরা গোলায় দিয়নি মই। তবুও কখনো আক্রান্ত হয়েছে ভাষা, দেশ, নারী, নারী তো আমাদের প্রাণ প্রিয় কন্যা। আমাদের কন্যারা একদিন হয়ে উঠবে মা, তার হাত ধরে এগিয়ে আমাদের বংশধর,আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা। নারী শাসন করছে দেশ, অথচ নারীরা পদদলিত, লাঞ্চিত, রক্তাক্ত এবং প্রতিকারহীন।অভিজাত এলাকা, সংরক্ষিত এলাকা, রাস্তা, যানবাহনে কোথাও আজ নিরাপদ নয়। সভ্যতার এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় কবি তার আত্মজাকে স্মরণ করে দিয়েছেন, ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু পরাজিত হবে না,’ তার শারীরিক মৃত্যু হতে পারে, আপাত দুর্বল মনে হতে পারে। তার স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষার অপমৃত্যু ঘটানো কঠিন। তার, মাতৃত্বে, মমতায়, সৃষ্টিশীলতায় আস্থা রাখতে হবে।
তোমার কান্নার জলে নব জন্ম নেবে গঙ্গা ভগিরথী/পদ্মা কর্ণফুলীর জলে বেদেনৌকার বুকে/জন্ম নেবে নতুন সংগীত নতুন স্রোতধারা/শুধু জেনে রাখো, মুকুন্দরামের মাটি তোমারও জন্মভূমি/সূর্যসেন প্রীতিলতা এরকম কতো না সাহস/আমাদের শক্তি তুমি খুঁজে পাবে সুলতানের চাষার বাহুতে/এসবই শক্তিপুঞ্জ একদিন শূন্য থেকে/ছড়িয়ে পড়েছে এই মহাশূন্য পরে/পৃথিবীর পথে ও প্রান্তরে।
জিললুর রহমানের ‘আত্মজার প্রতি’ এক অসাধারণ কবিতা। এই কবিতাটি মূল্যায়ন করার মতো, মেধা,মনন, পড়াশুনা যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। যতবার পাঠ করেছি, ততোবারই নতুন নতুন বোধোদয়ের উন্মেষ ঘটেছে। বোধগম্য হয়নি এমন অনেক প্রপঞ্চ রয়ে কবিতাটির পথেঘাটে। বুঝতে পারছি না কবিতার পাঠ প্রতিক্রিয়া যথাযথভাবে হয়েছে কিনা। তাই ক্ষমা প্রার্থী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট