চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে

বঙ্গবন্ধু

এবং রহমত আলীর মস্তিষ্কাঘাতক

মহীবুল আজিজ

২ আগস্ট, ২০১৯ | ১:৪২ পূর্বাহ্ণ

গত সংখ্যার পর

রাস্তাঘাটে একটি/দু’টি রিক্সা চোখে পড়ে শুধু। পাড়ার সকলের পরিচিত ঠেলাগাড়িঅলা নুরুজ্জামানকে রাজি করিয়ে খলিফাপট্টির গলি তারপর দেওয়ানবাজার চন্দনপুরা প্যারেডের মাঠ পেরিয়ে ঠেলাগাড়ি নিয়ে তারা পৌঁছায় মেডিকেল কলেজের পূর্ব দিককার গেটে। পেছন-পেছন রিক্সা করে যায় রহমতের বউ আর ছেলে। বেঁচে যায় রহমত। কিন্তু মস্তিষ্কের ওপর মারাত্মক আঘাতের কারণে তার শরীরের ডান পাশটা অবশ হয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার তিন দিন পরে সে প্রথমবারের মতন বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে চায়। তার শরীরের মধ্যে বিশেষ করে বাম দিকটাতে একটা আন্দোলনের মত প্রবাহ লক্ষ করা যায়। তার ঠোঁট কাঁপে প্রবলভাবে। ডান দিককার ঠোঁট বেঁকে যাওয়ায় তার মুখাবয়বে আচমকা অপরিচিতির ছাপ পড়ে। অনেকক্ষণ ধরে বিড়বিড়-করা তার ঠোঁট থেকে উৎপন্ন শব্দগুলো একপর্যায়ে নার্সের বোধগম্য হলে সে সবাইকে লক্ষ করে বলতে থাকে, উনি একটা শব্দই বলতেছেন খালি, কিছুক্ষণ পর-পর ঐ শব্দটাই উচ্চারণ করছেন। মিনুর মা জানতে চায়, কী বলতেছে বলেন না। নার্স তখন বলে, ভাল করে শোনেন, উনি বলতেছেন, ব-ঙ্গ-ব-ন্ধু। নার্স শব্দটাকে ভেঙে-ভেঙে বলে যেমনটা বলে রহমত আলী। আসলেই তখন রহমত আলীকে বুঝতে পারা যায়- জড়িয়ে-জড়িয়ে কম্পিত ঠোঁট দিয়ে সে উচ্চারণ করে, বঙ্গবন্ধু। শুনে খুশি হয় মিনু। একটা শব্দ যেহেতু বলতে পারছে রহমত, নিশ্চয়ই অন্য সব শব্দও ধীরে-ধীরে তার আওতায় এসে যাবে। কিন্তু বজ্রাঘাতের মত নেমে এলো রহমতের আসন্ন ভবিষ্যতের দুর্যোগ-বার্তা। পক্ষাঘাত তাকে করে দিযেছে চলৎশক্তিরহিত। তবে, ডাক্তার বলে দেন, ধৈর্য্য ধরতে হবে। ঔষধ চলবে, ফিজিওথেরাপি চলবে। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে হয়তো একদিন রহমত আলীর আবার সুস্থ হয়ে উঠবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। কিন্তু নার্স বা ডাক্তার কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না পৃথিবীতে এত-এত শব্দ থাকতে রহমত আলী শুধু বঙ্গবন্ধু শব্দটাই কেন বলতে চায়।
বোঝে ঠিকই মিনু। কিন্তু বুঝলেও তার আর কীইবা করার থাকে। ধীরে-ধীরে চারপাশ ঘটমান বর্তমান দেশকালসমাজ সব হৃদয়ঙ্গমহতে শুরু করলে রহমতের বউ মিনু ঠিক বোঝে, প্রচ- শোকের আকস্মিকতায় তার স্বামী উত্তেজিত হয়ে রক্তের চাপ সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারায়। আর জ্ঞান ফিরে সে পায় শরীরের একটা অংশ উৎসর্গ করে দিয়ে। দুই মাস আগে এমনই এক দিনে, মিনু ভাবে তার স্বামীটির মধ্যে লক্ষ করা গিয়েছিল এক প্রবল উত্তেজনা। কিন্তু সে-উত্তেজনা ছিল সুখের প্রকাশ। সে-উত্তেজনা তাকে এই পৃথিবীর সবচাইতে সুখি মানুষে পরিণত করেছিল। ঠিক দুই মাস পরের এই ভয়ংকর কষ্ট আর যন্ত্রণার উত্তেজনা তাকে পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখি মানুষে পরিণত করেছে। সমস্ত কষ্ট বুকে পুষে নিয়ে অসুস্থ স্বামীর সেবা করতে থাকে মিনু। এদিকে তার চারপাশের সবকিছু কেমন যেন দ্রুত বদলে যেতে থাকে। আগে রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ছবি একাত্তরের যুদ্ধের কথা-ছবি এসব কতকিছু কত-কতভাবে ভেসে উঠতো কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেসব আর চোখে পড়ে না। তার বদলে নতুন-নতুন সব নেতাদের মুখের আওয়াজ কাঁপিয়ে দিতে থাকে রেডিও আর টিভিপর্দায় মুহুমুর্হূ শোনা যায় তাদের তীক্ষè গলার স্বর। তীক্ষè চেরা সেই ধ্বনি কঠোর আদেশের মত মাইকেও বেজে চলে। যে-গানগুলো শুনে রহমত মিনু আর দিনারকে সামনে বসিয়ে যুদ্ধের স্মৃতিচারণায় বসে যেত সে-গান আর কোথাও শোনা যায় না। ডাক্তার বলেছেন, সুচিকিৎসা করাতে পারলে রহমত ভাল হয়ে যেতে পারে। মিনুর এক চাচাত ভাই একদিন মিনুকে বললো, বোন তুমি এককাজ করো, রহমত ভাই তো বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী, তুমি পার্টির লোকেদের কাছে গিয়ে একটু বলে দেখো, ওরা যদি কিছু টাকা সাহায্য করে তাহলে ভাইকে নিয়ে আমরা একবার ইন্ডিয়া যাই।
বলা যত সহজ করা ততই কঠিন। পার্টির পরিচিত দুয়েকজনের কাছে ধর্না দিতে গেলে তারা বলে, রহমত আলী তো আমাদের পার্টির মেম্বার না। মেম্বার না হলে তো টাকা বা সাহায্য দেওয়া যাবে না। অথচ অনেকেই জানতো, রহমত আলীর চোখে সবচাইতে দুর্জন বলে পরিচিত একটা লোক যে সকাল-বিকাল ইন্ডিয়াকে গালি দিত সেই লোক সাহায্য নিয়ে ইন্ডিয়াতে গিয়েই সুচিকিৎসা নিয়ে ফিরেছে। তখন আবার কেউ-কেউ বলে, থাক পার্টির সাহায্যের দরকার নাই। বরং এক কাজ করা যাক। রহমত আলী তো মুক্তিযোদ্ধা। সেই সুবাদে নিশ্চয়ই তার জন্যে কিছু একটা করা যাবে। অন্তত মুক্তিযোদ্ধারা একজোট হলে তাদের একজন দুঃসময়ের সহযাত্রীর জন্যে তারা কিছু না কিছু নিশ্চয়ই করতে সক্ষম হবে। সেখানেও সমস্যা। কী সমস্যা, রহমত আলী তার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটটাই নাকি নেয় নি সরকারের কাছ থেকে। বউ মিনু তাকে বলেছিল কয়েকবার, অনে দেশর লাই যুদ্ধ গইয্যোন্ হিয়ান আঁরা জানি। কিন্তু ভবিষ্ষতোর মাইন্ষোর জানিবার লাই অনে সাট্টিঅট্কান লওন না! লইয়ুম লইয়ুম, সাট্টিঅট কডে যার গই না- বিস্ময় আর প্রশ্ন মিশিয়ে বলতো রহমত। এখন তারই কথা যদি তাকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাও তো রহমত সেসব কথার অতীত। আজ যদি সে সার্টিফিকেটটা ঘরে এনে রাখতো নিশ্চয়ই কোন না কোন একটা কূল মিলতো এই অকূল পাথারে।
রহমতের দিন কেটে যেতে থাকে কষ্ট আরকাতরতার মধ্য দিয়ে। মাঝে-মাঝে বিড়বিড় করে যে বঙ্গবন্ধু শব্দটা বলতো তা-ও আর বলে না। ছেলে দিনার তাকে মাঝে-মাঝে পত্রিকা পড়ে শোনায়। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ আছে, উত্তেজিত হওয়া যাবে না। তাহলে আবারও বিপদ নেমে আসতে পারে। মিনু তাই ছেলের পত্রিকাপাঠ নিয়ন্ত্রণ করে। যারা যোদ্ধা রহমত ও তার সঙ্গীসাথীদের হত্যা করবার জন্যে যুদ্ধের দিনে খুঁজে ফিরতো তখন তারাই নাকি দেশের সব কিছুর পরিচালক। তাদেরই ছবি ছাপে পত্রিকার পাতায়-পাতায়। সেসব ছবি দেখে উত্তেজনায় কাঁপে রহমত। তার ঠোঁট মারাত্মকভাবে কাঁপে, কাঁপে চিৎকারের সম্ভাব্যতায়। কাজেই ছেলেকে নির্দেশ দেয় মিনু, পত্রিকা-পাঠ বন্ধ। তবে কালক্রমে রহমতের শরীর একটু-একটু ভাল হতে থাকে। শরীরে তার জোর সৃষ্টি হয়। আঘাতগ্রস্থ ডান হাতটা একটু-একটু জোরালো বোধ হতে থাকে। এদিকে দেশের পরিস্থিতিও বহু ঝড় আর ঝঞ্ঝার শেষে একদিন সুদিনের ইশারা নিয়ে আসে। সবাই মিলে একজোট হয়ে ভয়ংকর স্বৈরশাসককে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে দিলে মানুষ আশায় বুক বাঁধে, দিন ভাল হবে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত রহমতের ডান হাত অবশ হয়ে যাওয়ায় তাকে বাম হাত দিয়ে সই করার অভ্যেস চালিয়ে যেতে হয়। কাঁপা-কাঁপা হাতে সে সই করে- রহমত আলী। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কথা বলতে অক্ষম রহমত আলী ছেলে দিনারের লেখার খাতায় তার কম্পিত বাম হাতের প্রবল প্রচেষ্টায় কেবল একটিমাত্র পঙ্ক্তি লিখে দেয়- এইবার শেখর মাইয়া দেশ চালাইবো। দেখে মিনু হতবাক। পাড়ার লোকেরা ভাবে, রহমতের মত এমন অসহায় একজন মানুষ যখন এরকম একটি কথা বলেছে নিশ্চয়ই তেমনটাই বাস্তবে ঘটবে। রহমতকে নিয়ে পাড়ার লোকেরা গল্প করতে তাকে। বহুদিন ধরে অসুস্থ রহমত লোকেদের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। তারা ভাবে, অসুস্থ হয়ে চলমানতার অতীত হয়ে পড়লেও দেশকালসমাজের সঙ্গে লোকটার আত্মার সংযোগ ঠিকই রয়ে গেছে। তার শরীর ক্রমে নিস্তব্ধতার অভিমুখী অথচ এই শরীরই একদিনপ্রাণঘাতী সব অস্ত্র বয়ে শত্রুকে বধ করেছে প্রচ- আক্রোশে।
বাস্তবে হয় উল্টো। রহমতের মত অনেকেই যা ভাবে সেটা আদতে ঘটে না। বরং দেশের আকাশে আরও কালো মেঘ দেখা দেয়। যে-লোকেরা শৈশবে উৎসবে-সংক্রান্তিতে রহমতদের বাড়িতে নিয়ে আসতো মিষ্টান্ন আর যত উপাদেয় খাবার, যে-লোকেদের বাড়ি ডেকে এনে ঈদে-উৎসবে খাওয়াতো রহমতরা তখন তাদের চোখের দিকে আর তাকানো যায় না। তাদের চোখেমুখে ভীতি। কোথাও যেন একটা অবিশ^াস একটা ভয়ংকর কিছুর পূর্বাভাস সারাক্ষণ ঝুলতেই থাকে। খবর আসে নানা দিক থেকে। কত-কত লোক সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেছে- কোথায় কে জানে। কে জানে আদৌ তাদের আশ্রয় জুটেছিল কিনা। যারা একদিন ছিল রহমতদের অন্তরের তীব্র ঘৃণা আর ক্রোধের লক্ষ্য তখন তারাই ছড়ি ঘোরায় চতুর্দিকে। তারা গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়। তাদের গাড়িতে শোভিত দেশের পতাকা যে-পতাকা রহমতদের চোখের সামনে মৃত হয়ে যাওয়া সহযোদ্ধাদের রক্তে লাল। তবু কোথাও একটা আশা ঝিলিক দেয়, দিন ভাল হবে। এরিমধ্যে রহমতের ছেলে দিনার লেখাপড়া শিখে বিয়ে সেরে ফেলে। একজন নতুন সদস্য রহমতের ঘরে ঢোকে- ছেলের বউ। বউটা তার শ^শুরের সেবা করতে প্রাণপণ। কখন তার ঔষধ কখন তার পথ্য কখন তার ব্যায়াম সব হিসেব মুখস্থ।
তারপর আসে আরেক জুন মাস। এক জুনের শনিবারে রহমতের জীবন সার্থকতা পেয়েছিল তার জীবনের সবচাইতে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর দর্শনে। সেরকম আরেক জুন আসে তার জীবনে বড় করুণ পরিণতি নিয়ে। কিছুদিন থেকে রহমতকে বেশ চনমনে দেখাচ্ছিল। ততদিনে তার বাম হাতে লেখার অভ্যেস অনেকটাই রপ্ত হযে গেছে। ইচ্ছে করলেই সে পূর্ণ বাক্যে ভরিয়ে তুলতে পারে তার ছেলে দিনারের লেখার খাতা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বহুকাল আগেকার সেই বাক্যটাই আবার ছেলের খাতায় লিখে রাখে রহমত- এইবার বঙ্গবন্ধুর মাইয়া দেশ চালাইবো। উৎসাহী লোকেরা ফের বলাবলি করতে থাকে, রহমত ঠিক এরকম একটি বাক্যই তার ছেলের খাতায় লিখে দিয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। পাঁচ বছর পরে আবার তার সেই বাক্যটি এক ভবিষ্যদ্বাণীর মত দেখা দেয়। কেউ বলল, রহমতের কথা ফলবেই এবার। আবার, কারও-কারও ধারণা, রহমত যা বলে ঘটে তার উল্টো, কাজেই দেখা যাবে এবারেও ঘটেছে উল্টোটাই। দেশে তখন প্রবল কোলাহল চলমান। চারদিকে গুঞ্জন আর কলস্বন- কী হবে এবার, কী হবে এবার। তাহলে কী শেষ হবে না দুঃখের দিন। শেষ হবে না রহমত ও তার সঙ্গীসাথীদের ব্যঙ্গ করে গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ানো ক্ষমতাধারীদের দিন! এমনই দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর সংশয়ের দোলা নিয়ে সবাই এসে পড়ে সেই দিনটিতে যে-দিনটি রহমতের জন্যে আরেক জুন এবং আরেক পরিণতি হয়ে আবির্ভূত হয়।
ক’দিন ধরেই কষ্টকাতর-ব্যাথাক্ত রহমতকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। ছেলে দিনারকে ইশারায় ডেকে বলে, পত্রিকা এনে বড়-বড় হেডলাইনগুলো যেন তাকে শোনানো হয়। টেলিভিশনের সামনে বসে-বসে সারাক্ষণ গান শোনে খবর দেখে আর ঠোঁটে তার অজ¯্র বিড়বিড় কিন্ত বোঝার উপায় নেই কারও। যখন বহুকাল আগেকার সাদা-কালো রংয়ে কোন যুদ্ধদিনের প্রামাণ্য চিত্র ঝিকিয়ে ওঠে আর জনপদের প্রাচীন সব সংবাদ নিয়ে আসে তখন রহমত হাত-চোখ নাড়িয়ে এবং কণ্ঠে আবেগ এনে অনেক কথা বলতে চায়। টিভিতে তখন অনেক কাল আগেকার সব গান দেখাচ্ছে যেসব গান একুশ বছর ধরে ছিল নিষিদ্ধ বিষয়বস্তুও তালিকায়। একটি জাতির গৌরবের সমস্ত উপাদান কেমন অগৌরবের জঞ্জালে পরিত্যক্ত করে রেখে দিয়েছিল এতদিন। অথচ তখন দেখাচ্ছে গান বিজয় নিশান উড়ছে ঐ, বাংলার ঘরে-ঘরে, খুশির হাওয়ায় উড়ছে। কিংবা তীরহারা ঐ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে। একটা গান খুব প্রিয় ছিল রহমতের। মনে পড়ে ট্রেঞ্চের মধ্যেও ট্রাঞ্জিসটরে সে-গান তারা শুনেছিল একদা- ও চাঁদ, তুমি ফিরে যাও। শিল্পীর নামটা পর্যন্ত মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল রহমতের, মালা খুররম। অথবা, ভরাট গলায় আবৃত্তি-করা আশরাফুল আলমের কবিতা-পাঠ। সংবাদ পড়তেন আবুল কাশেম সন্দীপ। আর সেই বিখ্যাত জল্লাদের দরবার তো যাকে বলে তুলনাহীন। পরে তার নাম জেনেছিল- এম আর আখতার মুকুল। ফিরে আসছে আবার সেসব দিন। জুন মাসের ২৩ আসতে আসতে রহমত আলীর উৎসাহের জোয়ার কানায় কানায় পরিপূর্ণ। যেন আবার, পাল ছেড়ে নৌকা বাওয়ার দিন ফিরে এলো।
সকাল থেকেই টিভি-সেটের সামনে বসে ছিল রহমত। যদিও জানা ছিল নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নেবেন সন্ধ্যায়। কিন্তু সারাদিন টিভি’র সামনে বসে অনুষ্ঠান দেখতে-দেখতে রহমত কল্পনায় ভাসিয়ে দিতে থাকে কত স্বপ্নের তরি। শারীরিক অক্ষমতার কারণে বন্ধুদের বাসায় যাওয়া বন্ধ। হয়তো বন্ধুদের কেউ-কেউ আসে মাঝেমধ্যে। তারা বলে যায়, এবারে দিন অনেক অনেক ভাল হবে। বাংলাদেশ এবার কোথায় যায় দেখবে। বাম হাত দিয়ে ছেলের খাতায় নিজের আবেগের বহিপ্রকাশ ঘটিয়ে লেখে রহমত, এবার বঙ্গবন্ধুর কন্যার নৌকা কেউ ডুবাইতে পারিবে না। দেখে হাসে বন্ধুরা, হাসে বউ মিনু। ভাবে, বঙ্গবন্ধুর কন্যার এমন এক ভক্তকে যদি কখনও তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া যেতো তাহলে নিশ্চয়ই একদিন এক জুন মাসের ১৪ তারিখে খুব কাছ থেকে নিজের চোখে দেখা প্রিয় নায়কের ছবির পাশে তারই কন্যার মুখ আটকে রাখতে পারতো চিরকালের ফ্রেমে। সন্ধ্যের দিকে প্রচ- গরমের ভাঁপ নামে। পাড়াজুড়ে ছেলে-ছোকরাদের উল্লাস আর জয়ধ্বনি। অনেকটা সময় ধরে মাইকে বেজে যায় বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ৭-মার্চের বক্তৃতা যেটি শুনেই রহমত মনে-মনে প্রস্তুতি নিয়েছিল যুদ্ধের। বক্তৃতাটির সব লাইন থেকেই ছিটকে বেরোয় আগুন। … তোমাদের যাকিছু আছে তা-ই নিয়ে… আসলেই তা-ই নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল রহমত। কী নিয়ে- শুধু কিচ্ছু-না সঙ্গে নিয়ে। অথচ ফিরে এসেছিল বিশাল এক অর্জন নিয়ে। সবার কিচ্ছু-না জোড়া দিয়ে-দিয়ে এত বড় অর্জন মিলেছিল শুধু ঐ বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার সেই আগুনের ডাকের ফলেই। রহমত আবারও লেখে, ছেলে দিনারের খাতার পাতায়, যা সে বলতে অক্ষম, যা সে এতটাকাল বলতে পারে নি, তার ২১ বছরের সমস্ত অবদমনের সে প্রকাশ ঘটায় লেখার খাতায়, খাতার শাদা পৃষ্ঠায়, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়।
টেলিভিশনের সেটের সামনে বসে রহমত বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে চায়। ছেলের বউ জানতে চায়, বাবা, কিছু লাগিবো না। রহমত জানায়, লাগবে না। একসময় বউ মিনু এবং ছেলে দিনারও দিনের কাজ গুছিয়ে নিয়ে সঙ্গ দিতে বসে বাপকে। ততক্ষণে সন্ধ্যের রক্তিমাভা নেমে পড়েছিল পাড়ার ঘরবাড়ি আর গাছপালার ওপর দিয়ে। ঘরে-ঘরে সবাই যার-যার মত করে এক নতুন ইতিহাসকে বরণ করে নেবার জন্যে অপেক্ষারত। একদিন যাঁর ডাকে দেশ স্বাধীন হয়েছিল আজ এতকাল পরে তাঁরই আত্মজাকে দেশবাসী দায়িত্ব দিয়েছে- দেশ পরিচালনার জন্যে। তারই আনুষ্ঠানিক মুহূর্তের জন্যে অধীর প্রতীক্ষা সকলের। সবার মত রহমত আলীরও। কয়েকটা গান দেখায় পর-পর, অগ্নিযুগের গান। হঠাৎ-হঠাৎ মাঠ-ঘাট-প্রান্তর বিল-ঝোঁপঝাড় পেরোনো কিংবা সশস্ত্র অবস্থানে ক্ষিপ্র মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি পর্দা ভেসে উঠলে উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে ওঠে রহমত। মনে হতে থাকে যেন বলতে চায়, আমিও সেদিন ঐ যোদ্ধাদের মধ্যে ছিলাম। তোমরা জেনে রাখো আজ আামকে যত অসহায় অক্ষম আর পরিত্যক্তই মনে হোক না কেন সেদিন আমার এই অস্ত্রের সামনে লুটিয়ে পড়েছিল বাংলা-মাকে আঘাত-অপমান করতে আসা শত্রুর দল। ঘোষক জানান, আর অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখানো হবে প্রধানমন্ত্রীর শপথ-অনুষ্ঠান। রহমতের মনে পড়ে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ উদ্বোধনের ফলে বিশ^কাপের কত-কত খেলা সে উপভোগ করেছিল টিভির সামনে বসে। ১৯৭৮ সাল- মনে আছে স্পষ্ট- মারিও কাম্পোস। কী তার গতি কী তার চলা যেন আরবি ঘোড়া চলছে জীবন-জাগানো ছন্দে। আর্জেন্টিনার খেলা দেখেছিল রহমত টিভির সামনে বসে। এরিমধ্যে আরেকটা গান দেখায়- শোনো একটি মুজিবরের গানটা… । শুনে বিছানায় বসে থাকা রহমত বৈদ্যুতিক আবেশেই যেন উৎক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তার ঠোঁট কাঁপে কিন্তু বোধ্য শব্দে তার রূপান্তর ঘটে না। দেখে একটু ভয়ের কাঁপন ধাঁই করে বয়ে যায় বউ মিনুর মধ্যে। ডাক্তার বলেছেন, বেশি উত্তেজিত হওয়া চলবে না। যতটা সম্ভব ঠা-া মেজাজে থাকা চাই। উত্তেজনা রক্তের প্রবাহকে সহসা ভিন্নভাবে চালাতে শুরু করলে তার গতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। আড়চোখে তাই স্বামীর গতিবিধির ওপর বাড়তি নজর রাখে মিনু। কিন্তু নিজেও তো মিনু উত্তেজিতই। এতটাকাল স্বামীর সঙ্গে থেকে-থেকে স্বামীর সমস্ত ভাল-মন্দ সমস্ত আশা-নিরাশার সেও তো এক স্থায়ী সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। কাজেই একদিক থেকে স্বামীর উত্তেজনা তারও উত্তেজনা। গান শেষ হতেই হঠাৎ করে বিদ্যুতের তরঙ্গের মত টিভি-পর্দায় ভেসে ওঠে এক বিশাল সমুদ্রের ছবি। হ্যাঁ, সমুদ্রের ছবি। তবে সেখানে নেই জলরাশি, তার পরিবর্তে মানব শুধু মানবের মুখ। কত-কত সে মানুষ তার কোন ইয়ত্তা নেই। যেন সেদিন একটি মানুষও ছিল না ঘরে। সবাই এসে হাজির হয়েছিল সেই রেসকোর্সে। সকলের একমাত্র কাজ একমাত্র সংসারের নাম ছিল সেদিন রেসকোর্স। রেসকোর্সটা ছিল ব্রিটিশদের ঘোড়দৌড়ের মাঠ। ঘোড়ার ওপর বাজি ধরতো মানুষ। আজ তারা বাজি ধরতে এসেছে জীবনকেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে পুঁজি করে। রহমত আলীর সিটিজেন-টিভি-পর্দায় ভেসে ওঠে মার্চের ৭ তারিখ, ভেসে ওঠে জলবিহিন এক অপরূপ সমুদ্রের ছবি। আর সেই সমুদ্রে কোটি-কোটি জীবনের একমাত্র কা-ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুবিজুর রহমান। এই তো তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন, দাঁড়ানো ঠিক আমার চোখের সামনে- রহমত আলী ভাবে, যেমনটা দাঁড়িয়েছিলেন আরেক জুনের ১৪-তে, ঐ যে আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি, ভাবছি পাইপটা তিনি ধরাবেন বহু পথ পেরিয়ে আসবার ক্লান্তি কাটানোর জন্যে। কিন্তু না, পাইপ তিনি জ¦ালান নি। আমার নেতা পাইপ হাতে দাঁড়িয়েই রইলেন, কেন দাঁড়িয়ে রইলেন, রহমত নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে, কারণ সেখানে মঞ্চের মধ্যে তাঁকে ঘিরে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের কোমলমতি ছাত্ররা ছিল। একটু আগে যারা ফুলের সৌরভ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুড়ে দিয়েছিল তাদের সেই অপূর্ব সুগন্ধের স্মৃতি পাইপের উদগীরণ দিয়ে ম্লান করে দিতে চান নি বঙ্গবন্ধু। এই সোজা কথাটাই আমি বুঝি- রহমত বউকে বলছিল, পাইপ-হাতেই তিনি তাঁর হাল্কা নীল রংয়ের মার্সিডিজ গাড়িটাতে গিয়ে উঠলেন।
আবার আরেক জুনে ফিরে এলেন মহান নেতা। আর মাত্র দুই মাসের মধ্যেই রহমত দেখলো সমস্ত স্বপ্নকে এক ঝটকায় ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে হায়েনার হাসিতে ফেটে পড়ছে শত্রুরা। তারা ভেবেছিল, সব শেষ, সমস্ত ইতিহাস সমস্ত গৌরবআর সমস্ত প্রাপ্তিকে এক লহমায় এমনই মিলিয়ে দেওয়া গেল আর সেসবের উত্থান কখনোই কোনদিনই সম্ভব হবে না। অথচ দেখো, বিড়বিড় করে রহমত, বাইরে তা ঠোঁটের বিড়বিড়ই বটে কিন্তু ভেতরে এক অনুপম অনুবাদ তার- দেখো আরেক জুনে তিনি কী সুমহান গৌরবে ফিরে এলেন, ফিরলেন তাঁরই আত্মজার অমল চেতনাকে কেন্দ্র করে। এভাবেই পুনরুজ্জীবিত হয় চেতনা, এভাবেই চিরজীবন্ত হয়ে জেগে থাকে মহাজীবন। টিভি-পর্দায় তখন জনসমুদ্রের মাঝখানে বঙ্গবন্ধুর মুখ ভেসে উঠেছে। মহাকালের স্রােত ঠেলে আবার জেগে উঠেছে জীবন। রহমত আলী তখন কাঁপছে, হয়তো এক অনিবার্য ক্রন্দনও তাকে মুহুর্মুহু কাঁপায়। তার দুটি হাত একসঙ্গে সক্রিয় হতে চাইলেও কেবল বাম হাতটাই সে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে। তার সারা শরীর একজোট হয়ে অনেক নয় শুধু সজোর একটিমাত্র শব্দে প্রকাশিত হতে চায়। সেই চেষ্টার প্রাবল্যেই হয়তো রহমত বউ মিনু তার ছেলে দিনার আর ছেলের বউ সবাইকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে- ব-ঙ্গ-ব-ন্ধু…। তারপর তার দুই ঠোঁট প্রবলভাবে কাঁপে। তার মুখের ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের উচ্চারণে অন্যরা আশ্চর্য হয় না কারণ টিভিতে তখন বঙ্গবন্ধুকেই দেখায়- মার্চের সাত তারিখে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কী কিছুর থাকবার কথা। কাজেই টিভির সর্বত্র বঙ্গবন্ধুই। কিন্তু মিনু দিনার আর দিনারের বউ আশ্চর্য ও হতবাক, এত স্পষ্ট একটি শব্দ কী করে উচ্চারণ করে মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া এক রোগি। কিন্তু অবাক তাদেরকে হতবাক করে দিয়ে বিছানার ওপর কাত হয়ে পড়ে রহমত। তার ঠোঁট অল্প-অল্প কেঁপে তারপর স্থির হয়ে যায়।
২৩ জুন সন্ধ্যেবেলা শপথ নেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। সেই রাতেই কবর দেওয়া হলো রহমতকে। পক্ষাঘাতের রোগি তার সারা মুখে তার বউ মিনু দেখে একটা মৌন প্রশান্তি লেগে রয়েছে। ভাবে, স্বামীর একুশ বছরের অপেক্ষা সার্থক হলো। মরেও রহমত আলীর আত্মা আসলে শান্তি পেয়েছে। মনে পড়ে, একদিন কাঁপা-কাঁপা বাম-হাতে ছেলের খাতার পৃষ্ঠায় লিখে দিয়েছিল রহমত, বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশ চালাবে। বাস্তবে হলোও তাই। কিন্তু রহমত মুক্তিরযুদ্ধ করলেও সরকারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট না নেওয়ার কারণে তার সমাহিতি-পর্বে কোন বিউগল বাজে না, কেউ তার আবৃত মৃতদেহটিকে সামনে রেখে স্যালুট দেয় না। কেবল রাতের প্রশান্ত নিরবতাকে কিছুটা সময়ের জন্যে চাঞ্চল্যে ভরিয়ে তোলে তার পাড়া-প্রতিবেশি। মৃত্যুর সপ্তাহখানেক পর মিনু তার স্বামীর স্মৃতির তোরঙ্গটা মেলে ধরে। একটা টিনের বাক্সের মধ্যে কিছু কাগজপত্র বন্ধুদের চিঠি কিংবা পুরনো দিনের টাকা। মিনু জানতো, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত যেসব ব্যাংকনোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপানো হয়েছিল তার সবই রহমত আলীর সেই টিনের তোরঙ্গের মধ্যে সযতেœ সংরক্ষিত রয়েছে। ধীরে তোরঙ্গের ঢাকনাটা ওল্টায় মিনু। ন্যাপথলিনের ঝাঁঝালো একটা ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে ধাক্কা লাগায় প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে। সবকিছুর একেবারে ওপরেই একটা পেপারকাটিং- সাদাকালো। সুন্দর করে কাঁচি দিয়ে কেটে সেটা এ্যালবামে যেমন ফটো সংরক্ষিত রাখা হয় ঠিক তেমনিভাবে রাখা। আয়তাকার সেই ছবিতে অনেকগুলো মানুষের ছবি দেখা যায় আর সেই সঙ্গে সকলের সেই পরিচিত মুখ উদ্ভাসিত। ১৪ জুন ১৯৭৫ শনিবারের ‘দৈনিক আজাদী’-পত্রিকার সেই পেপার-কাটিংটার নিচে বিবরণ দেওয়া রয়েছে। তাতে লেখা- “গতকাল রাঙামাটির বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহকেন্দ্র উদ্বোধনে যাওয়ার পথে লালদীঘির মাঠে যাত্রাবিরতিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।” চোখ থেকে টপটপ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মিনুর। সাঁই করে মনে পড়ে যায় একটা আলোর টুকরোর কথা। ১৪ তারিখ সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না রহমতকে। সে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে দেখতে। মিনু নিশ্চিত আজ যদি রহমত আলী বেঁচে থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই সে ছবিটা দেখিয়ে বলতো, দেখো-দেখো ঐ ভিড়ের মধ্যে আমিও ছিলাম। পরক্ষণে মিনুর মনে হতে থাকে, লোকটা তো আসলে কথার অতীত হয়ে গিয়েছিল। তবু মিনু নিশ্চিত, আজ পক্ষাঘাতগ্রস্থ রহমত আলীর সামনে এই টিনের তোরঙ্গটা খুলে পেপার-কাটিংটা তার সামনে তুলে ধরলে অন্তত একটা বোধ্য শব্দ সে উচ্চারণ করতো- ব-ঙ্গ-ব-ন্ধু…
মে ২০১৯
সমাপ্ত

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট