চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পহেলা বৈশাখ ও তারুণ্যের ভাবনা

১৪ এপ্রিল, ২০২২ | ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

ভগীরথ দাশ

‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো
তাপস নিশ্বাস বায়ে মূমূর্ষূরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’
বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরোনো। আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সূচনালগ্ন থেকেই নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে। কালের বিবর্তনে নববর্ষ উদযাপনে বহুমাত্রিকতা যোগ হয়েছে। প্রতিদিনের যাপিত জীবনের বাইরে উৎসবের রঙে মেতে উঠে সারা দেশ। গ্রাম-শহর সবখানেই উৎসবের ঢেউ আছড়ে পড়ে। যে ঢেউয়ে গা ভাসায় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই। কালের পথ পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ ফিরে ফিরে আসে আর আমাদের রাঙিয়ে দিয়ে যায়। আমাদের ঘুমন্ত চৈতন্য রেখাপাত সৃষ্টি করে। বাঙালিয়ানার স্বাদ নিতে উন্মুখ হয়ে উঠি আমরা। মাটির সানকিতে পান্তা ইলিশ খেয়ে নববর্ষকে বরণ করি। আয়োজন করি বিভিন্ন ধরণের গ্রামীণ খেলা ও বৈশাখী মেলার। হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে মেলাগুলোতে। হরেক রকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে ব্যবসায়ীরা। ভালোই চলে বিকিকিনি।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে সূচনা হয় নববর্ষ উৎসবের। নানা আয়োজনে বর্ণিল হয়ে উঠে দিনটি। উৎসব স্থলগুলোতে লাখো মানুষের ঢল নামে। সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে সার্বজনীনতা পায় নববর্ষ উৎসব। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে যে সুরের আগুন জ্বেলেছিলো ছায়ানট তা আজ বিশাল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ লাভ করেছে। পহেলা বৈশাখ মানে শেকড়ের কাছে ফিরে যাবার দিন। বাঙালি প্রাণ ফিরে পায় মিলন মেলার এই উৎসবে। এই উৎসব নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসমূল থেকে শক্তি লাভের উৎসব, যে উৎসব জাগরণের পথে নিয়ে যায় বাঙালিকে। অন্ধকারের জীবেরা তাই ভয় পায় এই জাগরণকে। বাঙালির অসম্প্রদায়িক চরিত্রের উপর তারা কলঙ্ক লেপন করে। রমনার বটমূলে বর্ষবরণের উৎসবে বোমা ফাটিয়ে সাংস্কৃতিক জাগরণকে তাই স্তব্ধ করে দিতে চায়। ১৪২২ বঙ্গাব্দে ঢাকায় কিছু মানুষরূপী নরপশু নারীদের উপর হামলে পড়েছিল। বর্ষবরণ উৎসব সংঘবদ্ধ হওয়ার উৎসব। দানবের বিরুদ্ধে মানবের লড়াইয়ের অনুষঙ্গ। তাই ফের উঠে দাঁড়ায় বাঙালি। তাইতো বর্ষবরণে উৎসবের ব্যাপ্তি প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আসুন এই উৎসবে সবাই হাতে হাত রেখে শপথ নিই, এ দেশকে প্রতিক্রিয়াশীলদের অভয়ারণ্য হতে দেবো না।
বছর ঘুরে আবার এলো বাংলা নববর্ষ। চারদিকে উৎসবের আমেজ, নানা প্রস্তুতি চলছে নববর্ষকে বরণ করে নেবার জন্য। পহেলা বৈশাখ মানে এখন বর্ণিল মঙ্গল শোভাযাত্রা, বলিখেলা, কবিতাপাঠ, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও বৈশাখী মেলা। কিন্তু করোনার করাল গ্রাসে গত দু-বছর ছন্দপতন ঘটেছে। পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো। বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক প্রাণঘাতি ভাইরাস স্তব্ধ করে দিয়েছে মানব জাতিকে। চারদিক কেবলই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। ইতোমধ্যে বাষট্টি লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বিশ্বব্যাপী। দুবছরের অধিক সময়কাল কোভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাস তার ভয়াল থাবা অব্যাহত রেখেছে। ভ্যাক্সিন আবিস্কার হলেও ভাইরাসটি তার চরিত্র বদল করেছে অনেকবার। প্রতিষেধক টিকা নেবার পর অনেক দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু প্রাণঘাতি এই ভাইরাসটি এখনো পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। বলা যেতে পারে আমাদের চলার পথের সাথী হয়ে আরো কিছুকাল থাকবে।
করোনাভাইরাসের কারণে বিগত দুই বছর বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করা সম্ভব হয়নি। ভয়ঙ্কর এই ভাইরাসটি মানুষকে ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য করেছিল। রাষ্ট্রীয়বিধি নিষেধের কারণে কোন ধরণের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এবার সেই দমবন্ধ অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। চেনা ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। নতুন বছরকে বরণ করে নেবার জন্য তাই নানা আয়োজন চোখে পড়ছে। পবিত্র মাহে রমজানের জন্য সীমিত আকারে হলেও পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। এ ব্যাপারে সংস্কৃতিকর্মী খেলাঘর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ডীন প্রফেসর এ.বি.এম. আবু নোমান বলেন, ‘বর্ষবরণ আমাদের প্রাণের উৎসব। করোনার কারণে গত দুই বছর বর্ষবরণ উৎসব হয়নি। এবার বাঙালিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি পালনে বরাবরের মতো মিলন মেলায় মিলিত হবেন। করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে নতুন ভাবে জেগে উঠবে মানুষ।’

 লেখক : কলেজ শিক্ষক ও সংস্কৃতিককর্মী

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট